স্টাফ রিপোর্টার : ভয়ঙ্কর মানব পাচারকারি চক্রের মূল হোতা রফিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৯। সে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার কাঠালীপাড়া গ্রামের মৃত চমক আলীর পুত্র। রফিকের মাধ্যমে স্বপ্নের দেশ ইতালীর যাওয়া পথে ভুমধ্যসাগরে ট্রলার ডুবির ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারান অনেক সিলেটি। এই ঘটনার পর দালাল রফিকের সন্ধান মিলে। বিশ্বনাথ সহ ভিবিন্ন থানায় মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। পরপরপ ৮টি মানবপাচার মামলা হলে সিলেট ছেড়ে পালায় রফিক। ওই সময় আইন শৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হন্য হয়ে খুজলেও তাকে পাওয়া যায়নি। অবশেষে (১লা জুন) সোমবার উপজেলার বৈরাগী বাজার এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মানব পাচার মামলায় রফিকুলের মেয়ে পিংকি অনন্যা প্রিয়াকেও গ্রেফতার করেছিল র্যাব। গেল ঈদের আগে জামিনে মুক্তি পায় পিংকি। এই সুবাদে বাড়িতে এসেছিলেন রফিকও। বাড়িতেই ঈদ কাটান বলে স্থানীয় সুত্রে জানাগেছে। সোমবার বিকেলে নিজ বাড়ি থেকেই র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে সে। এরপর র্যাব সদস্যরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এক বছর পলাতককালে ঢাকায় ছিলো সে। সেখানে বসেই দেশজুড়ে মানবপাচারের নেটওয়ার্ক গড়েছে।
ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির এ ঘটনায় এ পর্যন্ত র্যাব ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে বলেও জানিয়েছেন র্যাব-৯ এর সহকারী পুলিশ সুপার ও মিডিয়া কর্মকর্তা ওবাইন রাখাইন। তিনি বলেন, রফিকুলকে গ্রেফতারের পর সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের জালালাবাদ থানায় হস্তাস্তর করা হয়েছে। এর আগে, গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর মানব পাচার মামলায় রফিকুলের মেয়ে পিংকি অনন্যা প্রিয়াকেও গ্রেফতার করেছিল র্যাব।
২০১৯ সালের ৯ মে রাতে লিবিয়া থেকে নৌকাযোগে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় অন্তত ৩৭ জন বাংলাদেশি নিহত হন এবং ১৫ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে তিউনিশিয়া কোস্টগার্ড।
এ ঘটনায় নিহত রেদওয়ানুল ইসলাম খোকনের ভাই রেজাউল ইসলাম রাজু বিশ্বনাথ থানায় রফিকুল, তার ছেলে পারভেজ আহমদ, মেয়ে পিংকি ও আরেক মানব পাচারকারী এনামুল হক এনামসহ অজ্ঞাত কয়েকজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। এর পর দেশের আরও পাঁচটি থানায় রফিকুল ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মানব পাচারের মামলা দায়ের করা হয়।
৮ বছর আগে নিজ ছেলে পারভেজকে লিবিয়া পাঠান রফিক। লিবিয়া গিয়ে দেউলিয়া হয়ে মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে যায় পারভেজ। ওখানে বাংলাদেশের নেটওয়ার্কের পুরোটাই নিয়ন্ত্রন করে পারভেজ। দেহরক্ষী নিয়ে ঘুওে সে। সিলেট থেকে পাচার করা মানুষ গেলে সে প্রায়ই যায় এবং দেখা সাক্ষাৎ করে। জিম্মিকরে পরিবারকে টাকা দিতে চাপ প্রয়োগ করে। ছেলের সূত্র ধরে সিলেটে মানবপাচারের নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি ঘটায় রফিক। প্রথমে সে মানুষজন জোগার করতো। বিদেশ যেতে ইচ্ছুক মানুষ সংগ্রহ করতো। পরে সে মানুষ নিয়োগ করে এলাকায় এলাকায় তার নিয়োজিত এজেন্টরা এই কাজ করতো। আর বিদেশে পাচারের বিষয়টি দেখভাল করতো মেয়ে পিংকি। তার একাউন্টেই কোটি কোটি লেনদেন হয়। ভুমধ্যসাগরের নৌকাডুবে সিলেটী যুবকদের মৃত্যুর ঘটনায় পিংকির বিরুদ্ধেও ৬ মামলা হয়। এসব মামলায় পিংকি গ্রেপ্তার হয়। এরপর আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার তিনটি ব্যাংক একাউন্ট খুজে যান। এর ব্রাক ব্যাংকের একাউন্টে থাকা ৩২ লাখ টাকা খোজ পান। গ্রেপ্তারের আগেই পিংকি অগ্রনী ব্যাংকের শাখা থেকে ১ কোটি ৪৭ টাকা সরিয়ে ফেলে। পুলিশ জানায়- ভুমধ্য সাগর ট্র্যাজেডির পর রফিকের পর বিরুদ্ধে নতুন করে ৮টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে বিশ্বনাথ থানায় মামলা করেছিলেন মারা যাওয়া খোকনের ভাই রাজু। এছাড়া হবিগঞ্জে বানিয়াচংয়ে রানা নামে আরো এক জন মামলা করেন। এর বাইরে জালালাবাদ থানা, দক্ষিন সুরমা থানা ও গোলাপগঞ্জ থানা সহ সিলেটের আরো কয়েকটি থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এসব মামলা দায়ের প্রাক্কালেই সিলেট থেকে পালিয়েছিলো রফিক। ফলে ওই সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রফিকের খোজ পায়নি। সম্প্রতি সময়ে বাড়ি এলে গতকাল তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মানবপাচারের নির্মম ঘটনায় টাকাওলা বনে যাওয়া রফিক নিজ গ্রামে বানিয়েছে পাকা বাড়ি। দুটি বাস, দুটি মাইক্রোবাস ও তিনটি সিএনজি অটোরিক্সার মালিক সে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের মানবপাচার চক্রের অন্যতম শীর্ষ আসামি রফিকুলের বিরুদ্ধে মামলা করায় বাদীকে অস্ত্র দিয়ে মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা ও করেছিল মানবপাচার চক্র।
এই মামলায় গ্রেফতার করা হয় মানবপাচার চক্রের মূল হোতা রফিকুলের সহযোগী রাজনগর গ্রামের মৃত আতর আলীর পুত্র আবদুল কাদির, রামপাশা গ্রামের মৃত আবদুল মানিকের পুত্র আলী হায়দার মহুরী, বিশ্বনাথ নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা আসু মিয়ার পুত্র আবুল কালামকে। এছাড়াও ২০১৯ সালের ১৬ মে মানব পাচার প্রতিরোধ দমন আইনে মামলা হয় রফিকুলের বিরুদ্ধে (মামলা নং-৮)।