রমজান মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : এ এইচ এম ফিরোজ আলী

Uncategorized
শেয়ার করুন

আরবী ‘রমদ’ধাতু থেকে রমজান, শব্দটি উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, দহন, প্রজ্বলন, জ্বালানো বা পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলা। তার মানে হচ্ছে মানুষের যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি, নফসের দাসত্ব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় বলে এ পবিত্র মাসের নাম রমজান। রমজান রোজাদারদের গুনাহ পুড়িয়ে একেবারে ধ্বংস করে দেয়। ফার্সি, রোজা, শব্দের অর্থ উপবাস-মানে পানাহার না করা। আরবী, সওম, এর বহুবচন সিয়াম-এর অর্থ বিরত থাকা বা সংযম করা। অর্থাৎ রোজা রেখে রোজাদার পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং ধৈর্য্যশীল হওয়া। রোজা ছয় প্রকার ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল, মোস্তাহাব এবং মাকরুহ রোজা। রমজানের মাসের রোজা ফরজ। রমজান ক্ষমা ও মুক্তির মাস।
রমজান সবরের মাস, সবরের প্রতিদান হচ্ছে বেহেশত। রমজান মাসে মানুষের নেক কাজের প্রতিযোগিতা দেখিয়ে আল্লাহ ফেরেশতাদের কাছে গৌরব প্রকাশ করেন। এই জন্য বলা হয় রমজান আল্লাহর গৌরবের মাস। সারা বছরের মধ্যে রমজান মাসে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কোরআন তেলাওয়াত হয়। যে কারনে রমজান মাসকে কোরআন তেলাওয়াতের বসন্তকাল বলা হয়। আল্লাহ শুধু স্বীয় ওহী এবং আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করার জন্য রমজান মাসকে নির্বাচন করেছেন। প্রত্যেক রমজান মাসে রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত জিব্রাইল (আঃ) কে এক খতম কোরআন পড়া শুনাতেন এবং হযরত জিব্রাইল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.)কে ও এক খতম কোরআন পড়া শুনাতেন। হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে যে, রমজানের রোজা দশ মাসের রোজার সমতুল্য। আর শাওয়ালের ছয় রোজা দুই মাসের সমান-এই হলো এক বছরের রোজা। প্রকৃতপক্ষে মাহে রমজান মুসলমানদের জন্য একটি বার্ষিক প্রশিক্ষন কোর্স যার মাধ্যমে রোজাদারদের জীবন প্রভাবিত হয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও আত্মবিশ্বাসের সাথে রোজা রাখবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে (বুখারী ও মুসলিম)।
পবিত্র রমজান মাসে আসমানী কিতাব নাযিল এবং ইসলামের অনেক ঘটনা সংগটিত হয়েছে। আল্লাহ তালা রমজান মাসে সর্বপ্রথম কদরের রাতে গোটা কোরআন মজিদ লাওহে মাহফুজ থেকে, বায়তুলইযযাহ নামক স্থানে (প্রথম আসমানে একটি বিশেষ স্থান) নাযিল করেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কার অদূরে হেরা পর্বতের গুহায় গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকাবস্থায় আল্লাহতায়ালা চল্লিশ বছর বয়সে ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ২৭রমজান শবে কদরের রাতে সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াতের মাধ্যমে কোরআন নাযিল করেন। এ রাত হাজার রাতের চেয়ে ও উত্তম। মহানবীর জীবদ্দশায় মোট ২৩বছরের সম্পূর্ণ কোরআন নাযিল হয়। মহান আল্লাহ শুধু রমজানের রোজা আমাদের উপর ফরজ করেননি, পূর্ববতি সবার উপর ও রোজার বিধান ছিল। হযরত আদম (আঃ) এর উপর রোজার বিধান আরোপ করে মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম রোজার প্রচলন শুরু হয় এবং পরবর্তী সব নবী ও উম্মতের উপর রোজার বিধান আরোপ করা হয়েছিল।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরুপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা খোদাভীরূ হতে পারো (সূরা বাকারা আয়াত ১৮৩)। রাসূলুল্লাহ (সা.) মুসলমানসহ মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার পর তাদের অবস্থা যখন স্থিতিশীল হয়, তখন দ্বিতীয় হিজরী সালে আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের উপর রোজা ফরজ করেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, তোমরা যখন রোজা রাখবে, তখন তোমার কর্তব্য হবে চোখ, মুখ হাত, পা, কান এবং শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর সকল অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত রাখবে। রোজা হলো মুমিনের ঢালস্বরুপ। রোজাদারগণ বেহেশতের ৮টি দরজার মধ্যে ‘ রাইয়ান’ নামক দরজা দিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করবেন। রোজাও কুরান রোজাদারদের মুক্তির জন্য শাফায়াত করবেন।
নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর প্রতি রমজানের ১ম দিন সহিফা নাজিল হয়েছিল। রমজানের ৬ তারিখ হযরত মুসা (আঃ) এর উপর তাওরাত, ১৩ রমজান হযরত ইসা (আঃ) এর উপর ইঞ্জিল এবং ১২ রমজান হযরত দাউদ (আঃ) এর উপর যবুর নাজিল হয়েছিলো। ১৭ রমজান মক্কার কাফের মুশরিকরা মদিনায় নতুন মুসলমানদের নিশ্চিন্ন করতে বদর প্রান্তে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল, সে দিন মাত্র ৩১৩ জন ছাহাবী নিয়ে হযরত মুহাম্মদ বিজয়ী হয়েছিলেন। ২০ রমজান নবী পরিবারের ইমাম হাসান (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। ১৯ রমজান ইমাম আলী (রা.) কুফার মসজিদে ফযরের নামাজ রত অবস্থায় ছুরিকাহাত হন এবং ২১ রমজান নবী পরিবারের ১ম ইমাম (রা.) শহীদ হন।
রোজার যেমন ধর্মীয় ও গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি ভাবে সামাজিক, মানবিক এবং শারীরিক অনেক গুরুত্ব আছে। পবিত্র রমজান মাসে মুসলিম বিশ্বে আল্লাহর নৈকট্য লাভে শান্তির ধর্ম ইসলামের আলাদা এক আমেজ পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশ ও এর বাহিরে নয়। রমজানে মসজিদে মুসল্লিদের ভীড়জমে এবং অধিকাংশ লোক কোরআন তেলাওয়াত করেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছহী কোরআন প্রশিক্ষণ চালু করা হয়। ধনীরা গরীবদের সহায়তা, দান খয়রাত করেন। অনেকাংশে অপরাধ প্রবণতা কমে যায়, রোজাদারগণ অযতা গল্প কথা-বার্তা থেকে বিরত থাকেন। দেশের অনেক মসজিদ মাদ্রাসায় ছহি কোরআন প্রশিক্ষণ কাজক্রম চালু করা হয়। আগের কার দিনে যখন ঘড়ি রেডিও টেলিভিশন মোবাইল ছিলনা তখন রাতে চাঁদ বা তারা দেখে সেহরী এবং সন্ধার সময় মসজিদের আজান বা সূর্যাস্থ দেখে ইফতার করতে হতো। প্রতিটি গ্রামে রাতে টিনের চুঙ্গা দিয়ে সেহরীর কথা প্রচার করতেন এক শ্রেণীর লোক। ইফতার এর সময় একে অন্যের ঘরে ইফতার পাঠাতেন। মসজিদে মুসল্লিদের জন্যে ইফতার পাটানো চিলো বাধ্যতা মূলক এটা ছিলো রমজানের বড় একটা আদব। সে সময় অনেকে বুঝে না বুঝে রোজা পালনে ভুল ত্রæটি ও করতেন। কিছু লোক রোজা রেখে ধূমপান করতেন, হুক্কা দিয়ে তামাক খেতেন, অনেকে একটু সমস্যা হলে নানা অজুহাতে রোজা ভেঙ্গে দিতেন। এমন লোকদের ঈদের দিন পঞ্চায়েত মসজিদে কড়া সামাজিক বিচার করতেন। এখন এমন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে মানুষ ছহী শুদ্ধভাবে রোজা রাখতে অভ্যস্থ হয়েছেন। রোজার দিনে অন্য ধর্মের লোকেরা রোজাদারদের ভক্তি শ্রদ্ধা করেন, তারা কারো সামনে ধূমপান বা পানাহার করেন না। তবে বর্তমান সময়ে যেন আমাদের একে অন্যের প্রতি মায়া মমতা মানবিক বিবেচনা কমেগেছে। এখন সেহরী বা ইফতারের সময় কেউ কারো তেমন কোনো খুঁজ খবর নিতে দেখা যায় না। নিজের মা বাবা ভাই বোন আপনজন কী দিয়ে সেহরী খাচ্ছে, কীভাবে ইফতার করছে অনেকেই তার খুঁজ খবর রাখেন না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু ইসলাম কখনো এসব সমর্তন করে না। গরীবের দুঃখ বুঝাই রমজানের বাণী। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যাক্তি কোনো রোজাদারদের পিপাসা মিটাবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন থাকে হাউজে কাউছার এর সবরত পান করাবেন-আল্লাহ আমাকে, কাউছাড় নামক যে হাউজ দান করেছেন তার দৈর্ঘ একমাসের পথের সমান। হারামবক্কনকারী, অপবাধী, মিথ্যুক অন্যায় অত্যাচারি ব্যাক্তির রোজা কবুল হয় না
রমজান মাসে অন্য মাসের তুলনায় কম খাওয়া হয়, বার বার খাওয়া-পান করার ও কোন সুজোগ নেই। কেউ কেউ আবার বলেন, রমজান মাসে না কি বেশি খাওয়া হয়। যাই হোক প্রকৃতঅর্থে কম খাওয়া স্বাস্থ্যের অনুকূলে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, সুস্থ জীবন লাভের জন্য খাওয়ার প্রয়োজন বেশি নয়। বরং কম ও পরিমিত খাওয়াই সুস্থ জীবন লাভের চাবিকাঠি। বাংলা প্রচলন আছে-, বেশি বাঁচবি তো কম খাবি। এটা বৈজ্ঞানিক সত্যে উত্তীর্ণ। একাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসক ইবনেসিনা তার রোগীদের তিন সপ্তাহের জন্য উপবাস পালনের বিধান দিতেন। রোগ নিরাময়ের যতগুলো প্রতিকার এবং প্রতিষেধক আছে, তার মধ্যে সব চেয়ে শক্তিশালী ও ফলপ্রসূ প্রতিকার হলো প্রতি রমজান মাসের রোজা। সমস্থ শরীরে সারা বছর যে, জৈববিষ জমা হয়, একমাসের রোজার ফলে সেই জৈববিষ দূরীভূত হয়ে যায়। এই জৈববিষ দেহের স্নায়ূ অপরাপর কোষকে দূর্বল করে দেয়। শরীরের রক্ত প্রবাহকে রোজা পরিশোধন করে এবং সমগ্র প্রবাহ প্রনালীকে নবরুপে দান করে। রোজা উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপ্রেসারসহ অন্যান্য মারাত্মক ব্যাধি সমূহ কমাতে সাহায্য করে। রোজা দেহযন্ত্রের বিরতি কালে শরীরের অপ্রয়োজনীয় অংশ ধ্বংস করে দেয় এবং দেহের রোগ নিরাময় কাজে সংরক্ষিত প্রাণ শক্তির সদ্ধব্যবহার হয়। একমাস রোজার ফলে জিহবা ও লালা গ্রন্হি সমূহ বিশ্রাম পায় এবং এগুলো সতেজ হয়। যারা ধূমপান করেন তাদের জিহবায় ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগ হওয়ার আশংকা বেশি থাকে। কিন্তু একমাস রোজার কারনে ধূমপায়ীদের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। রোজা বহুমূত্র রোগ কমাতে সাহায্য করে ও শরীর অধিক মোটা হতে বাধা দেয়। রোজা রাখার ফলে শরীরের সবগুলো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিশ্রাম পায়। দৈনিক চৌদ্দ পনের ঘন্টা উপবাসের সময় লিভার কিডনী মূত্রথলি প্রভৃতি অঙ্গ সমূহ রোজায় বিশ্রাম পায় বলে নানা প্রকার উপসর্গ নিরাময়ের সম্ভাবনা থাকে।
রোজায় মেদ বা চর্বি কমায় এবং রক্তে কলোষ্টরল এর পরিমান স্বাভাবিক রাখে। বর্তমান রমজান মাসে মরণব্যাধি করোনা ভাইরাস বিশ্বের মতো বাংলাদেশে ও আক্রমণ করেছে। এ মহামারী থেকে নিজেকে নিজের পরিবারকে এবং দেশকে সুরক্ষায় সরকারের সকল নির্দেশনা মেনে চলুন। এ মহামারী থেকে রক্ষায় পবিত্র রমজানে যেন মহান আল্লাহতায়ালার নিকট প্রার্থনা করি। আমিন
এ এইচ এম ফিরোজ আলী
লেখক, কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক
তথ্য সুত্র :
দৈনিক বাংলা বাজার, ১৭ জানুয়ারি ১৯৯৭ইং, ৮ ডিসেম্বর ২০০০ইং।
দৈনিক প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর ২০০৫ইং।
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ মে ২০১৭ ইং।
নবম ও দশম শ্রেণীর নৈতিক ও ইসলাম শিক্ষা।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *