বাংলাদেশ সংক্রামক রোগ নির্মূলে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। কালাজ্বর, গুটিবসন্ত, ডায়রিয়া পোলিওসহ অনেক সংক্রামক রোগ এ দেশে কমছে। অনুরূপভাবে হাম-রুবেলা নির্মূলে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। হাম ও রুবেলা ভাইরাস জনিত মারাত্মক সংক্রামক রোগ। হাম রোগে আক্রান্ত, যে কোন একজন রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে অতিদ্রæত অন্যজনে ছড়াতে পারে। শিশুসহ যে কোন বয়সের লোক হামে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে শিশুর প্রকোপ, জটিলতা ও মৃত্যু বেশি দেখা যায়, বিধায় সরকার শিশুদের হাম-রুবেলা টিকা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। হামের জটিলার মধ্যে রয়েছে, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, অপুষ্টি, এনকেফালাইটিস, অন্ধত্ব বধিরতা ইত্যাদি অন্যতম। হামের জটিলতা থেকে বাঁচার সর্বোৎকৃষ্ট একমাত্র উপায় হচ্ছে, সঠিক সময়ে সঠিকভাবে শিশুকে হামের টিকার মাধ্যমে সুরক্ষিত করা। হাঁচি-কাশির মাধ্যমেও রুবেলা ভাইরাস ছড়ায়। কিন্তু রুবেলার জটিলতা হামের মতো নয়, অন্য রকম। গর্ভবতী মায়েরা গর্ভের প্রথম তিন মাস সময়ের মধ্যে রুবেলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শতকরা ৯০% শিশু মা-থেকে রুবেলা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। রুবেলা ভাইরাসে মায়ের গর্ভ নষ্ট হয়। বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে শিশু জন্মে, এমনকি শিশুর মৃত্যু হতে পারে। যা কনজেনিটাল রুবেলা সিনড্রোম (সিআরএস) নামে পরিচিত। এ রোগ থেকেও শিশুকে রক্ষা বা বাঁচানোর একমাত্র উপায় যথা সময়ে ও নিয়ম মেনে শিশুকে রুবেলা টিকা দেয়া। ১৯৭৯ সাল থেকে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসুচী (ইপিআই) কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে শিশুদের যক্ষা, পোলিও, ডিফতেরিয়া, হুপিংকাশি, ধনুষ্টংকা, হাম, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া প্রতিরোধে টিকা দেয়া হচ্ছে।
এক সময় মানুষের মনে টিকাদান কর্মসূচী নিয়ে নানা ধরনের সন্দেহ ভূলভ্রান্তি বিরাজ করছিল। তখন বাড়ির নিকটে টিকাদান কেন্দ্র থাকলেও অভিভাবকরা শিশুদের টিকা দিতেন না। মসজিদের মাইকে টিকাদানের কথা বলা ছিল নিষিদ্ধ। সময়ের ব্যবধানে মানুষ টিকাদনের উপকার বুঝতে পারায়, আমাদের সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, বিশেষ করে মসজিদের ইমামগণ, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক সমাজ, শিক্ষার্থীগণ টিকাদানের সহায়তা করায় অনেক সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। যে কারণে বিশ্বে বাংলাশের সুনাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সফলভাবে টিকাদান কর্মসূচী বাস্তবায়িত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভ্যাকসিন হিরো পুরস্কার লাভ করেছেন। হাম-রুবেলা রোগ থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচীর (ইপিআই) মাধ্যমে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচীতে ৯ মাস বয়সি সকল শিশুকে প্রথম ডোজ এমআর টিকা ও ১৫ মাস বয়সি সকল শিশুদের দ্বিতীয় ডোজ এমআর টিকা সংযুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে হামে আক্রান্ত শিশুর ঝুকি বেশি এবং এমআর প্রথম ডোজ টিকাদানের ক্ষেত্রে ৫% থেকে ১৫%, দ্বিতীয় ডোজ, ১৫% থেকে ২০% শিশু ড্রফ আউট বা টিকার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ কারনে ৪/৫ বছর সময়কালে মোট অরক্ষিত শিশুর সংখ্যা কমে, বার্ষিক জন্ম নেয়া শিশুর সংখ্যার সমান বা বেশি হয়ে যায়। ফলে হাম রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। অরক্ষিত এই শিশুর সংখ্যা কমানোর ৩/৪ বছর পর পর হাম-রুবেলা টিকাদান ক্যাম্পেইন বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। রোগ নিরিক্ষণ তথ্যমতে, হাম-রুবেলা রোগে আক্রান্ত শিশুর বয়স বিশ্লেষন করে দেখা যায় যে, ২০১৭ সালে ৭৬ ভাগ এবং ২০১৮ সালে ৭৯ ভাগ শিশুই ১০ বছরের কম বয়সি। ২০১৭ সাল থেকে দেশব্যাপী হামের রোগ বেড়ে যায়। ২০১৫ সালে হাম রোগে আক্রান্তের হার ছিল প্রতি ১০ লাখে ১.৬ জন, যা বেড়ে ২০১৭ সালে ২২ জন, ২০১৮ সালে ১২.৯ জন, ২০১৯ এর অক্টোবর পর্যন্ত ২৫ জন। ল্যাবরেটরি কনফার্মড হামের প্রকোপ (আউট ব্রেক) হিসাব মতে, ২০১৫ সালে ছিল ৪টি, ২০১৭ সালে ৭১টি, ২০১৮ সালে ৩৬টি, ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৬৩টি। ২০১০ সালে রুবেরায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৭২৭জন।
২০০৮ সাল থেকে হাম রোগ ভিত্তিক (কেস বেইসড) নিরিক্ষন এবং ২০১২ সাল থেকে রুবেলা সিনড্রোম (সিআরএস) সার্ভিল্যান্স কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। পোলিও নির্মূল সফল হওয়ায় বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ হাম-রুবেলা রোগ কমাতে উদ্যোগ গ্রহণ করলে বাংলাদেশও এই কার্যক্রমে একাত্বতা ঘোষনা করে। হাম রোগ নিয়ন্ত্রনে ২০০৬ সালে ক্যাচআপ এবং ২০১০ সালে ফলোআপ ক্যাম্পেইন করায় হামের প্রাদুর্ভাব বহুলাংশে কমে যায়। ২০১২ সালে রুবেলা নিয়ন্ত্রনে হামের টিকার সাথে রুবেলা টিকা এমআর দেয়া হচ্ছে। ২০১৪ সালে হাম-রুবেলা ক্যাম্পেইন শুরু করায় অনেক সফলতা লক্ষ্য করা যায়। এ অবস্থায় হাম-রুবেলা দূরীকরণে “হাম-রুবেলা ক্যাম্পেইন-২০২০” এর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই কর্মসূচীর প্রথমে ২৯ ফেব্রæয়ারী/২০২০ইং থেকে ২১ মার্চ ২০২০ইং পর্যন্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের তৃণমূলের মূলকর্মী স্বাস্থ্য সহকারীদের গ্রেড পরিবর্তনসহ বিভিন্ন দাবীতে হাম রুবেলা কর্মসূচী বয়কটের ঘোষনা দেয়ায় কর্মসূচী পালনে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে তাদের দাবী মেনে নেয়ায় নতুন তারিখ অনুযায়ী ১৮ মার্চ ২০২০ থেকে থেকে ১১ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত তারিখ নির্ধারণ করা হয়। সারাদেশে ৯ মাস থেকে ১০ বছরের কম বয়সি শিশুদের টিকা দেয়া হবে। ২ বছর বয়সের নিচের সকল ড্রপ আউট ও লেফ আউট শিশুদের খুজে বের করে টিকা দিতে হবে। সরকার সিলেট ও নওগাঁ জেলার জন্য সিলেক্টিভ ভ্যাকসিননেশনের পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করে একই সাথে ৯মাস থেকে ৫ বছরে নিচের শিশুদের তালিকা করে এ দুই জেলায় শিশুদের টিকাদানের নির্দেশনা দিয়েছেন।
শুক্রবার ও সরকারি ছূটি ব্যতীত প্রথম সপ্তাহে প্রতি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কিন্টার গার্ডেন, মাদরাসা, মক্তব, শিশু আশ্রমসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। প্রত্যেক কেন্দ্রে ২ জন দক্ষ টিকাদান কর্মী ও ৩ জন সেচ্ছাসেবিসহ ৫ জন থাকতে হবে।
মূলত স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারীগণ টিকাদান কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তবে শূন্য ইউনিটে এনজিও কর্মী বা সিএসসিপিরাও কাজ করবেন। ২য় সপ্তাহে দুই দিন রুটিন টিকাদানের দিন ব্যতীত বাকী ৪ কর্ম দিবসে সাব বøকে এবং ৩য় সপ্তাহে ৪কর্ম দিবসে সাব বøকে ক্যাম্পেইন চালানো হবে। শহর এলাকার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সহকারীর সংখ্যা কম থাকলে হাসপাতালের নার্স, প্যারামেডিক্স, ৩য় ও ৪র্থ বর্ষের নাসিং কোর্সের শিক্ষার্থী, মেডিকেল কলেজের ইন্টারনি ডাক্তার ও ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশিক্ষন দিয়ে টিকাদান টিমে অন্তর্ভূক্ত করার কথা রয়েছে। প্রতিটি সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলায় ১টি করে স্থায়ী টিাকাদান কেন্দ্র থাকবে। অতিরিক্ত দূর্গম ঝুকিপুর্ন এলাকার প্রতিটি ইউনিয়নে একটি, উপজেলায় ৩টি, পৌরসভায় ২টি, এবং সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে ১টি করে কেন্দ্র থাকবে। যেসব শিশু মায়ের সাথে দোকান-বাজার, কলকারখানা, রাইছ মিল, বেদে শিশু, পথ শিশু এবং যারা রেল, বাস, লঞ্চ, পতিতালয়, বস্তি, জেলখানায় মায়ের সাথে থাকবে সেইসব শিশুদেরও টিকার আওতায় আনতে হবে। কোন শিশুর সাথে টিকার কার্ড না থাকলে একটি কার্ড পূরন করে টিকা দিতে হবে এবং তার কনিষ্ট আঙ্গুলে কালির দাগ দেয়া হবে। মাঠকর্মচারীগণ ক্যাম্পেইন এর দুই মাস পূর্বে স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে বাড়ী-বাড়ী গিয়ে ৯মাস থেকে ১০ বছরের কম বয়সী সকল শিশুকে রেজিষ্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক। টিকা শুরুর তারিখে যাদের বয়স ৯ মাস হবে তাদেরকে রেজিষ্ট্রেশন ও টিকা দিতে হবে। সীমান্তবর্তী এলাকার মাইগ্রেন্ট, নৃগোষ্টি, প্রান্তিক জনগোষ্টি টিকা গ্রহণে অনাগ্রহি জনগোষ্টি এবং অভিজাত এলাকার শিশুরাও টিকা পারে।
হাম-রুবেলা কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে সর্বপ্রথম সকল শ্রেণীর পেশার মানুষকে এ কর্মসূচীতে অর্ন্তভূক্ত করে টিকাদানে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিটি এলাকার মসজিদের মাইকে টিকার আগের দিন, টিকার প্রচার করতে হবে। অভিভাবকগণ শুধু নিজের শিশু নিয়ে কেন্দ্রে যাবেন না। নিজ বাড়ি, পাড়া ও গ্রামের সকল শিশুকে নিয়ে টিকা কেন্দ্রে যাওয়া উচিৎ। কারন হামের টিকার বাইরে থাকা একটি শিশু আক্রান্ত হলে এলাকার সকল শিশুই আক্রান্ত হতে পারে। সুতরাং নিজের বা দেশের স্বার্থে মানবতার কল্যাণে সকল শিশুকে টিকা দেয়া সচেতন মহলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এজন্য সকল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ইমাম, পুরোহিত, ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক, গ্রাম পুলিশ আনছার ভিডিটি, স্কাউট দল, বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, সমবায় সমিতি, হাট-বাজার কমিটি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কমিটিসহ সকলে মিলে নিজ নিজ এলাকার শিশুদের টিকা প্রদানে আগ্রহী করা একান্ত প্রয়োজন। মসজিদের পাঁচ ওয়াকত নামাজ শেষে ইমামগণ মুসল্লিদের টিকাদানের কথা স্বরণ করিয়ে দিলে অনেক সফলতা আসবে। বাংলাদেশ পোলিও নির্মুলের মতো হাম রুবেলামুক্ত। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ফেইসবুকের মাধ্যমে ব্যাপক ভাবে প্রচার প্রচারণা চালালে কর্মসূচী সহজে বাস্তবায়িত হবে। বুঝতে হবে যে, আজকের শিশু আগামী দিনের দেশ ও জাতির কর্ণধার। হাম-রুবেলা যেন একটি উৎসবমূখর পরিবেশে পালন করা হয়।
………………………………….
এ এইচ এম ফিরোজ আলী
লেখক, কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক