ভয়াবহ ‘হাইব্রিড’ নামক ক্যান্সারে আক্রান্ত আ’লীগঃ দলীয় প্রধানের নিদের্শ উপেক্ষিত

Uncategorized
শেয়ার করুন

এএইচএম ফিরোজ আলী ঃ মানুষের মরণব্যধির মধ্যে একটি আতংকের নাম ক্যান্সার। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি যদি জানতে পারেন, তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন, তাহলে সেই ব্যক্তি, ভয়ে মরার আগে যেন মরে যান। অনুরূপভাবে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগে ভয়ংকর অত্যাধুনিক এক রোগের নাম ‘হাইব্রিড’। এ ‘হাইব্রিড’ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা দেশজুড়ে। বলা যায়, টক অব দ্যা কান্ট্রি। ‘হাইব্রিড’ রোগটি আওয়ামীলীগ নামীয় সংগঠনে অনুপ্রবেশ করে দলটির সাংগঠনিক কাঠামো ধ্বংস করে দিচ্ছে। আওয়ামীলীগ ও সহযোগি সংগঠনের সকল শাখা হাইব্রিডের দখলে। ফলে হাইব্রিডরা এখন দলের রাজা। হাইব্রিড রোগটি রেডিওথেরাপি দিয়ে দমন করা না হলে, আওয়ামীলীগের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে এবং হবে। হাইব্রিডকে সাধারনতঃ উচ্চ ফলনশীল বীজ বলা হয়। এ বীজে ফলন হয় বেশি বটে, কিন্তু স্বাদ নেই, গন্ধ নেই এবং অল্প সময়ে পঁেচ যায়। হাইব্রিডরাও নিজ স্বার্থে, সুবিধা আদায়ে দলে অনুপ্রবেশ করে মাকড়সার মতো দল খেয়ে কঙ্কাল রেখে চলে যাবে। ‘হাইব্রিড’ শব্দটি এখন গালিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এ শব্দের সর্মাথক কাউয়া-খাইখাই-অনুপ্রবেশকারী-বসন্তের কোকিল-তোষামোদকারী-চামচা-তেলবাজ-নীতিহীন এবং দালাল ইত্যাদি। সরকার প্রধান ও দলীয় সভানেত্রী ‘হাইব্রিড’ মুক্ত আওয়ামীলীগ করার ঘোষণা দেয়ার পরও তাঁরা দলে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। ‘হাইব্রিড’ আশ্রয়, প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নিদের্শ দিলেও এক যুগে কিছু হয়নি। দেশে এখন তৃণমুল সম্মেলনে পকেট কমিটির মাধ্যমে হাইব্রিডদের প্রমোশন দিয়ে পূণঃবাসিত করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দলের নীতি-আদর্শ-ত্যাগীরা, যাদের রক্তে-ঘামে দলটি ঠিকে আছে, সেই সব নেতাকর্মীরা দল থেকে অনেক দূরে। গরীবের দল নামে খ্যাত আওয়ামীলীগ এখন উচ্চবিলাসী হাইব্রিডদের হাতে।

উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহি সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ। দলটি এদেশের মাতৃ সংগঠন। দলে লাখ লাখ নেতাকর্মী ও সমর্থক রয়েছে। ১৯৪৯সালের ২৩ জুন ঢাকার এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালিন সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারন সম্পাদক ছিলেন টাঙ্গাইলের সামছুল হক। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দলের প্রধান যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। দলটি গঠনের পরদিন থেকে পাকিস্তান সামরিক জান্তা দলের নেতাকর্মীদের উপর অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত এবং তৎপরবর্তী সময়ে এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দলটির ভূমিকা ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী হয়েও দলকে সুসংগঠিত করতে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দলের হাল ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে সর্বোত্তম যে শ্রেষ্ঠ কাজটি করেছিলেন, দলের ভেতর ত্যাগী-নীতি-আদর্শের হাজার হাজার নেতাকর্মী সৃষ্টি করেন। ১৯৭০সালে পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি নৌকার প্রার্থী কলাগাছ দিলাম, আপনারা প্রার্থী নয়, নৌকায় ভোট দেবেন’। বঙ্গবন্ধুর এমন বক্তব্যে দলের নীতি-আদর্শের বিশ্বাসী কর্মীরা কাঁদাপানিতে পায়ে হেঠে মাইলের পর মাইল নির্বাচনী প্রচারনা করেছিলেন। কেউ কেউ স্ত্রীর গয়না, জমি, ধান, চাউল, হাঁস, মোরগ, গরু, মহিষ বিক্রি করে নির্বাচনে আওয়ামীলীগকে জয়ী করার প্রমাণ আছে ইতিহাসে। এ নির্বাচনের বিজয়ে পাকিস্তান শুধু বিস্মিত হয়নি, পুরো বিশ্ব অবাক হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ক্যরিশমা দেখে। এজন্য বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ-আওয়ামীলীগ-জনতা একই সুতোয় গাঁথা’।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীন বাংলাদেশেই গণহারে আওয়ামীলীগ নিধন শুরু হয়। ৭৫-৯৬সাল পর্যন্ত ২১ বছর অধিকাংশ ত্যাগী নেতাকর্মীরা সহায়-সম্বল হারা হয়েছিলেন। এসময় তাদের দেহ ছিল কঙ্ককালের মত। আওয়ামীলীগ করে অনেকেই পথের ফকির হয়েছেন। ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে আওয়ামীলীগের ২৬হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। আওয়ামীলীগের চরম দূর্দিনে পথ হারা হয়নি ত্যাগী নেতাকর্মীরা। এক সময় স্থানীয়-জাতীয় নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে এজেন্ট হওয়ার মতো লোকের অভাব ছিল। যারা পদ-পদবী ছাড়া দেশ তথা দলকে মনে প্রাণে ভালবাসতেন। এখন নব্য আওয়ামীলীগরা পদের জন্য মরিয়া। কিছু উপটোকন, বিলবোর্ড, খামে নগদ নারায়ন এবং ফেইসবুকে ‘লিডার এগিয়ে যান, শুভ কামনা রইল’ ইত্যাদি লিখলে হাইব্রিডরা পদ পেয়ে যায়। কেউ কেউ মন্ত্রী,এমপি এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে ছবি তুলে প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করে। টাকার কাছে দলের নীতি আদর্শ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীরা নির্বাচনে বুকে নৌকার ছবি লাগিয়ে ভোট দেয় অন্য প্রতীকে। এ অবস্থা ওপেন সেক্রেট। সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রয়াত মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের পরাজয় এর জলন্ত উদাহরণ। স্থানীয় ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে অর্থের মহোৎসবের কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
২০০৮সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পর শীতের অতিথি পাখির মতো মন্ত্রী, এমপির ছত্রছায়ায় দলে ঝাকে ঝাকে হাইব্রিডদের আগমন ঘটে। ২০১৪ সালের পর অনুপ্রবেশের মাত্রা দিগুণ বেড়ে যায়। অদ্যাবধি পর্যন্ত এক যুগ সময়ে দলের বিভিন্ন শাখায় পদ-পদবী দখলে তাঁরা। কোন্দল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, খুনোখুনি, দখলবাজি করে দেশ-বিদেশে দলের ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণ করছে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড তাদের কারনে ম্লান ও বির্তকিত হচ্ছে। এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা দল ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে হাইব্রিডদের তালিকা করে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের একাধিক বৈঠকে এদেরকে দল থেকে বের করে দেয়ার নিদের্শ দেন। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী এদেরকে ঘাড়ে ধরে বের করার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রীর নিদের্শ উপেক্ষিত। আওয়ামীলীগ বিরোধী দলে থাকাবস্থায় জামায়াত-শিবির, বিএনপি, জাতীয়পার্টি, ফিড্রমপাটি যারা দলীয় নেতাকর্মীদের হামলা-মামলা করে এবং পিঠিয়ে বাড়ী ঘর থেকে উচ্ছেদ করেছিল, তারা এখন দলের কর্ণধার।
২২/০৯/২০২০ইং দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘সব দলের তৃণমূলে অনুপ্রবেশকারী’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে রাজাকার পোষ্য, মাদক ব্যবসায়ী, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজসহ বির্তকিতরা অর্থ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে, বির্তকিতদের বাদ দেয়ার নিদের্শ প্রধানমন্ত্রীর’। কোনভাবেই যেন বির্তকিতরা কমিটিতে স্থান না পায় এবং ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়। এতে আরও বলা হয়, গত সাড়ে ১১ বছরে কমপক্ষে অর্ধলক্ষাধিক অনুপ্রবেশ ঘটেছে। জামায়াত-শিবির, বিএনপি, ফিড্রমপার্টি থেকে যোগ দিয়ে ৫শত জনের মত দলের সভাপতি, সাধারন সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিও নির্বাচিত হয়েছেন। এতে সত্যিকারের ত্যাগী নেতাকর্মীরা মার খাচ্ছেন, অপমান-অপদস্ত হচ্ছেন। একই পত্রিকায় গত ৩০/০৬/২০১৮ইং তারিখে ‘কোন্দল, অনুপ্রবেশে চিন্তিত আওয়ামীলীগ ! গত নয় বছরে শান্তি কমিটির কর্মকর্তা ও তাদের সন্তান-স্বজনসহ জামায়াত-শিবির, বিএনপি নেতাকর্মী, সমর্থক যোগদান করে সারাদেশে দলে ভয়াবহ কোন্দল সৃষ্টি করেছে । ১১/০৮/২০১৫ইং তারিখে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ‘তৃণমূল আওয়ামীলীগে খুনোখুনি’ আতংকে মাঠের নেতাকর্মীরা, বিব্রত হাইকমান্ড, জুলাইয়ে ১৭জন খুন, আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে ৫জন খুন, একই পত্রিকায় ০১/১১/২০১৯ইং তারিখে ৫হাজার অনুপ্রবেশকারী আওয়ামীলীগে তোলপাড়, সংগঠনে না রাখতে নিদের্শ শেখ হাসিনার, বির্তকিতদের স্থান হবে না- কাদের। এতে বলা হয় ০৮/১১/২০১৫ইং এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি জামাত থেকে কাউকে দলে নিতে নিষেধ করেন এবং দল ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে ৫ হাজার অনুপ্রবেশকারীর তালিকা দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের হাতে তুলে দিয়ে তাদের ও আশ্রয় প্রশয় দাতাদেরও ব্যবস্থা গ্রহণের নিদের্শ দেন।
প্রয়াত আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর এক লেখায় আওয়ামীলীগে হাইব্রিড সংখ্যাধিক্য হওয়ায় দলে সর্বত্র কলহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, উল্লেখ করে হাইব্রিডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলে ভারতের কংগ্রেসের পরিণতি থেকে শিক্ষা নিতে আওয়ামীলীগকে পরামর্শ দিয়েছেন। ৩০/১০/২০১৯ ইং তারিখে আওয়ামীলীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সভায় জেলায় জেলায় হাইব্রিডের তালিকা করে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ০২/১১/২০১৯ইং তারিখে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ‘ওরা সবাই এখন আওয়ামীলীগ’ শিরোনামে আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ১৯/০৫/২০২২ইং তারিখে আমাদের সময় পত্রিকায় তৃণমূল আওয়ামীলীগে ঠাই পাচ্ছে বির্তকিতরা, শিরোনামে গাইবান্ধার পলাশ বাড়ী উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ দেয়া হয় জামায়াত পরিবারের সন্তানকে। এনিয়ে স্থানীয় আওয়ামীলীগে অসন্তোষ বিরাজ করছে। নেত্রকোনা, জামালপুর, নোয়াখালী, ফেনীসহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পদে হাইব্রিড ঢুকানো হচ্ছে। এমন অভিযোগ কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের ১১৭টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলবিহীন কমিটি গঠন নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে, বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় সাধারন সম্পাদককে পদত্যাগ করতে হয়েছে (মানবজমিন, ২৪/০৫/২০২২)। হাইব্রিড নিয়ে দলের অভ্যন্তরে কিছু কিছু নেতা দ্বৈত্যনীতি অনুসরণ করছেন। স্থানীয় পর্যায়ে তারা বলে থাকেন, দলে যারা নতুন এসেছেন, তাদেরকে প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন। আবার কেন্দ্রীয়ভাবে বলা হয়, কোন হাইব্রিডদের কমিটিতে স্থান দেয়া হবে না। এদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে। এমন আস্কারা পেয়ে দলটি গিলে খাচেছ খাই খাইরা।
আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আঞ্চলিক নেতা থেকে জাতির পিতা ও বিশ্ববন্ধুতে পরিণত হয়েছেন। আওয়ামীলীগের তৃণমূলের ত্যাগী লাখ লাখ নেতাকর্মীর সমর্থনে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে চারবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রতিরোধে রাজপথে নেমেছিলেন এবং বিরোধীদলে থাকাবস্থায় প্রাণ দিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এদের তালিকা তৈরী করে মূল্যায়ন করা এখন সময়ের দাবী। আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে হাইব্রিডদের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জোর দাবি জানিয়েছে।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *