স্টাফ রিপোর্টার : বিশ্বনাথে একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ৩জন ঋন গ্রহীতার মধ্যে ২জনের মৃত্যু ও একজন হার্ট অ্যাটাক করেছেন। ঋণ গ্রহীতার এই তিন পরিবার ও জামিনদাররা মানবেতর ও আতংকে জীবন যাপন করছেন। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋন পরিশোধে মামলা করেও টাকা উদ্ধার করতে পারছেন না। মামলা দায়েরের পর কয়েকজন জামিনদারের পরিবারেও আতংকের সৃষ্টি হয়েছে। একজন অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তার প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে কয়েকটি পরিবার এখন মহাবিপদে। এই ব্যাংক কর্মকর্তা ঋণ দিয়ে কয়েক লক্ষাধিক টাকা ঘুষ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছে। এই পরিবারগুলো অসহায়ত্বের খবর পৌছে বিশ^নাথের ডাক ২৪ডটকম কর্তৃপক্ষের নজরে। সরেজমিনে গিয়ে পরিবার গুলোর বক্তব্য ঋণ গ্রহনের কাগজপত্র ও মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে তৈরী করা হয়েছে এ প্রতিবেদনটি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের গোহায়রী গ্রামের আব্দুস সোবহান ২০১১ সালের ২১ ডিসেম্বর ইস্টার্ন ব্যাংক লি: চৌহাট্টা শাখা থেকে ১৮% সুদে ৪লাখ ৯০হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন । ব্যাংকের শর্তানুযায়ী তিনি কিছু কিস্তির টাকাও পরিশোধ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋন পরিশোধে বার বার চাপ সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে তিনি মানষিক ভারসাম্য হারিয়ে ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। আব্দুস সোবহানের মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই আব্দুল কাইয়ুম, ভাইয়ের পরিবারের ছেলে সন্তানের বরণ পোষন নিয়ে বিপাকে পড়ে যান। সহজ সরল প্রকৃতির কাইয়ুম ব্যাংক ঋণের সংবাদে ভয়ে আতংকিত হয়ে ২০১৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর হাওরে স্টোক করে মৃত্যুবরণ করেন। আব্দুস সোবহানের মৃত্যুর পর ইস্টার্ন ব্যাংক চোহাট্টা শাখার এ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার মিজানুর রহমান বাদী হয়ে আব্দুস সোবহানের স্ত্রী ফাতিমা বেগম এবং ঋনের জামিনদার জমশেরপুর গ্রামের আব্দুল হকের পুত্র হতদরিদ্র দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে অর্থ ঋন আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন, (মামলা নং-৭৬/২০১৬ইং)।
মামলায় বাদী ২০১৬ সালের ৩১ শে মে পর্যন্ত ৪,৪৭,২৬৮/টাকার দাবি করেন। মামলার ১০নং দফায় বলা হয়, ১নং আসামি বাদীর ব্যাংক হইতে ঋন গ্রহণকালে কোন স্থাবর সম্পত্তি ব্যাংক বরাবরে বন্ধক প্রদান করেননি। মামলায় আব্দুস সোবহানের স্ত্রীকে ১নং আসামি করা হয়। কিন্তু আব্দুস সোবহানের স্ত্রী কোন ঋণ গ্রহণ করেননি। তিনি কোন কাগজে স্বাক্ষর করেননি এবং ব্যাংকেও যাননি।অথচ তিনি জামিনদার।এ ব্যাপারে জানতে সরজমিনে গোহায়রী গ্রামের মৃত আব্দুস সোবহানের বাড়ীতে গেলে স্ত্রী জানান, ব্যাংক ঋণের কথা আমি কখনও জানিনা। মৃত্যুর আগে কয়েকবার আমার স্বামী বলেছেন, ঋনের কারনে আমি মারা যেতে পারি এবং তিনি এই কারনেই মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে স্ত্রী ফাতেমা বেগম ছেলে সন্তান নিয়ে বড় অসহায়। আব্দুল কাইয়ুমের স্ত্রী রোকেয়া বেগম বলেন, আমার স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেছেন ঋণের টেনশনের কারনে। আব্দুস সোবহানের চাচাতো ভাই ইকবাল মোবাইল ফোনে বলেন, ব্যাংকের ঋনের কারনে দুই ভাইকে হারিয়েছি। এ ঋণের চাপে তাদের মাও মারা গেছেন।
আব্দুস সোবহানের ঋণের দায়েরি মামলার ২নং আসামী জামিনদার দুদু মিয়ার অবস্থা আরো করুণ। তিনি জানান, বৈরাগী বাজারে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা এসে তাদের সাথে কথাবার্তা বলেছেন। আমি লেখাপড়া জানিনা। একাউন্ট খোলার কথা বলে আমার স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। এখন শুনেছি আমি নাকি ব্যাংক ঋনের মামলার আসামী। আমার কোন সম্পত্তি নেই। ঋণের চাপ দিলে ছেলে সন্তান নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে গলায় দড়ি দেব।
ব্যাংকের একই শাখা থেকে রামপাশা গ্রামের সুখচান আলীর পুত্র মামুন, একই ব্যাংক থেকে ১৮.৫০% সুদে ১০লক্ষ টাকা ঋন গ্রহণ করেন। ঋন গ্রহণের পর খরচা বাবদ ১০লক্ষ টাকার মধ্যে ৩লক্ষ টাকা ঘোষ দেয়া হয় এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে। মামুনের নিকট থেকে ৩১টি ব্লাংক চেকেরও স্বাক্ষর নেয়া হয়। তিনি ঋণের কিস্তি পরিশোধে থাকাবস্থায় ২০১৫সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ১৩ লাখ ৩৩হাজার ২৫২টাকার দাবি করে ব্যাংক একটি চেক ডিজনার মামলা (কোতোয়ালী সিআর/৫৩৩/১২/২০১৩ইং)দায়ের করেন। মামলার বাদি ইস্টার্ন ব্যাংক চোহাট্টা শাখার লিগ্যাল অফিসার নাজমুল আহাদ। এ মামলায় মামুনের ১বছর কারাদন্ড এবং ২৬লাখ ৩২হাজার ৩২০ টাকার অর্থদন্ড প্রদান করেন। তারপর মামুন ৬ মাস ১৮দিন জেল খেটে মহামান্য হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন লাভ করেন। এমন পরিস্থিতিতে তিনি হার্ট এ্যাটাক হলে তার বাইপাস অপারেশন করা হয়। বর্তমানে তিনি জীবন মৃত্যু অবস্থায় আছেন। তার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আরেকটি জারী মামলা দায়ের করেন, (মামলা নং-৯৩/২০১৬ইং)। মামলায় আসামী হচ্ছেন ঋণের জামিনদার বৈরাগীবাজারের সালেহা নামক এক মহিলা ও অপরজন হচ্ছেন নওধার গ্রামের রইছ আলীর পুত্র রিয়াজ উদ্দিন।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, অনিক নামের ইর্স্টান ব্যাংক চৌহাট্টা শাখা একজন কর্মকর্তা বৈরাগী বাজার এসে মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে উচ্চহারে ঋণ দিয়ে অনেক জনকে বিপদগামি করেছেন। তিনি প্রতিটি ব্যাংক ঋণ থেকে ঘুষও গ্রহণ করেছেন। এখন নাকি তিনি মালেশিয়ায় অবস্থান করছেন।
ইর্স্টান ব্যাংক চৌহাট্টা শাখা থেকে রামপাশা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার মনিরুল ইসলাম ১৮.৫০% সুদে ২০১২ সালের ৩০ জুলাই ৯লক্ষ টাকা ঋন গ্রহণ করেন। তিনি ঋনের কিছু কিস্তিও পরিশোধ করেছিলেন। তিনিও ঋণের চাপে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে তার স্ত্রী অভিযোগ করেছেন। ২০১৪ সালের ২৮মে ইর্ষ্টান ব্যাংক চোহাট্টা শাখার পক্ষে এসোসিয়েট ম্যানেজার মো: জসিম উদ্দিন অর্থঋন ৩৬/২০১৪ইং আদালতে মনিরুল ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা বেগম এবং কাটলি পাড়া গ্রামের মনসুর আলীর পুত্র ফারুক আলীকে আসামী করা হয়। তারপর ২০১৪ সালের ২৮ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ৮লক্ষ ১৪হাজার ১১৬টাকার পাওনা দাবি করে একটি জারি মামলা দায়ের করা হয়, ( মামলা নং-৭৩/২০১৫ইং)।
মনিরুল ইসলামের স্ত্রীর ফাতেমা বেগম হাউমাউ করে কেদে বলেন, আমার স্বামী সারাজীবন আওয়ামীলীগ করেছেন। তার তেমন কোন লোভ ছিল না। ব্যাংক কর্মকর্তার প্রলোভনে উচ্চহারে ঋণ নিয়ে আমার ছেলে সন্তানকে এতিম করা হয়েছে। আমি এখন ছেলে সন্তান নিয়ে বাচাঁর কোন উপায় নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেট শাখার নির্বাহী পরিচালক খুরর্শিদ আলম জানান, ঋণ মওকুপের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের দায় দায়িত্ব। মানবিক বিষয়টি যে কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে, ঋণ প্রদানে কোন অনিয়ম দূর্নীতি থাকলে ক্ষতিগ্রস্থপক্ষ অভিযোগ দায়ের করলে তদন্ত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ইর্ষ্টান ব্যাংক চোহাট্টা শাখার ম্যানেজার চৌধুরী তামিন হাফিজ বলেন, এই ঋণের বিষয়টি আমার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বের ঘটনা। তবে, বিভিন্নভাবে খোঁজ নিয়ে বৈরাগী বাজার এলাকার ঋণের এই পরিবার গুলোর করুণ কাহিনী আমি জানতে পেরেছি। উর্ধতন কতৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে মানবিক কারনে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করব। যদি উর্ধতন কর্তৃপক্ষ তা বিবেচনা করেন। অনিক নামের কেউ ইষ্টার্ণ ব্যাংকে ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাকে ধরার এখন কোন সুযোগ নেই। শুনেছি সে বিদেশ চলে গেছে।
সিলেটের সিনিয়র আইনজীবি এএসএম গফুর বলেন, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্টান কারো নিকঠ থেকে ব্লাংক চেক আদান প্রদান করা বেআইনি। তিনি বলেন, মানবিক কারনে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অসহায় পরিবার গুলোকে ইচ্ছা করলে সহায়তা করতে পারে।
বিজ্ঞজনের মতে ঋণ গ্রহণকালে বুঝে শোনে ঋণের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করা উচিৎ এবং ঋণের সুধের হার কত এই বিষয়টি বুঝা অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সহজ সরল মানুষ না বুঝে ঋণ নিয়ে এমন পরিস্থিতির শিকার হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২জন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেছেন, ঋণ প্রদানকালে ব্যাংক কর্মকর্তাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। কাউকে ভুল তথ্য দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ করলে ব্যাংকের বদনাম হয় এবং সাধারণ মানুষও ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারায়। তারা এই ব্যাংক ঋনের ঘটনা শুনে দুঃখ প্রকাশ করেন।