স্টাফ রিপোর্টার : কৃষি প্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড হচ্ছে, কৃষক ও কৃষি। কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হলেই খাদ্য সংকট দেখা দেয়। চলতি বছর অতি বৃষ্টি ও কয়েক দফা বন্যায় সারাদেশের মতো সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে কৃষকরা ইরি বোরো ফসল উৎপাদনে মনযোগী হন। কিন্তু এই অঞ্চলের বিশাল হাওর চাউলধনীর জলাশয়ের ইজারাদারের কারণে শত কোটি টাকার ইরি বোরো ফসলের ক্ষতির আশংকা দেখা দিয়েছে। যে কারণে এলাকায় খাদ্যাভাব দেখা দিবে তেমনি কয়েক হাজার কৃষকের মেরুদন্ড ভেঙে গেছে।
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নে দেশের প্রসিদ্ধ চাউলধনী হাওরটি কিছু জলাশয় মাছ ধরার জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। দশঘর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির নামে এ লিজ দেওয়া হয়। সমিতি সরকারের লিজের শর্তভঙ্গ করে একজন প্রবাসীসহ কয়েকজনকে সাবলিজ দেয়। ফলে একটি চক্র সরকারের লিজের সকল শর্ত ভঙ্গ করে বাঁধ কেটে ও মেশিনে পানি সেচ দিয়ে কয়েক হাজার একর জমি ফসল উৎপাদনে বাঁধার সৃষ্টি করেছে। পানির অভাবে হাওরে এখন বীজতলার চারা মরে গেছে এবং চারা বপনের জমি ফেটে চৌচির। মাছ ধরার নামে হাওরের পানি প্রত্যাহার করায় ক্ষুদ্ধ কৃষকরা সমবেত হয়ে হাওরে গিয়ে প্রতিবাদ, মিছিল, মিটিং করছেন। কিন্তু কৃষকের কান্না কারও কানে যাচ্ছে না।
চাউলধনী হাওরের আওতায় ছোট বড় ১৬টি বিল ৩০টি খাল নালাসহ ৫শতাধিক পুকুর রয়েছে। এখানে সরকারী ১নং খতিয়ানে ১৭৮ একর জলমহাল রয়েছে। বাকি সব পুকুর খাল জলাশয় ব্যক্তি মালিকানাধীন। কৃষকরা নিজেই শীত মৌসুমে পানি সেচ দিয়ে ফসল উৎপাদনে এসব পুকুর জলাশয় খনন করে রেখেছেন। কিন্তু ইজারাদার এসব জলাশয় পুকুর জোরপূর্বক মাছ ধরার জন্য শুকিয়ে দিয়েছে। ফলে হাওরে পানির জন্য এখনই হাহাকার চলছে। ইজারাদারের পক্ষে কেউ কেউ বলছেন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানি হাওরে নেই। অথচ এ বছর বন্যা ও বৃষ্টি হাওরে প্রচুর পানি ছিল।
২০১৭ সালে কতিপয় অমৎস্যজীবিদের গঠিত একটি মৎস্যজীবি সমিতির নামে ১০লাখ ১৫হাজার টাকায় মাছ আহরণে ৫বছরের জন্য সরকারী অংশ লিজ দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারী জলাশয়ে সীমানা নির্ধারণ না থাকায় পুরো হাওরটি গ্রাস করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন ইজারাদার। ইতি পূর্বেও এই সমিতিকে জলাশয় লিজ দেওয়া হয়েছিল। মাছ ধরতে গিয়ে এমনভাবে পানি প্রত্যাহার করা হয়েছে নিঞ্চলের জমিতেও বীজ বপন করা হচ্ছে না। এমতাবস্থায় চাউলধনী হাওরের চর্তুরদিকে ২৫টি গ্রামের প্রায় ২৫ হাজার কৃষক লিজ বাতিল করে কৃষক বাঁচানোর দাবী জানিয়ে আসছেন। কথিত আছে যে, চাউলধনী পুরো হাওরে ধান উৎপাদন হলে পুরো বাংলাদেশের আড়াইদিনের খাদ্য উৎপাদন হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। তাছাড়া চাউলধনী হাওরের মিটা পানির মাছ ইউরোপ ও মধ্যেপাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে বেশ বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করা সম্ভব হতো। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে এই হাওরের মাছ ও সুটকি বিশ্বনাথী প্রতিটি প্রবাসীদের ঘরে ঘরে পাঠানো হতো। অনেক পরিবার শীতকালে লন্ডন থেকে চাউলধনীর মাছ কিনে শুটকি দেওয়ার জন্য টাকাও পাঠাতেন। এই হাওরে শীতকালে শত প্রজাতির পাখি, হাঁস এসে কোলাহল করতো। আবার হাওর পাশের বিভিন্ন গ্রামের বাড়িতেও পাখিগুলো থেকে যেতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে শীত মৌসুমে পানি না থাকায় জীববৈচিত্র ও হুমকির সম্মুখিন। বিশাল এই হাওরটি রক্ষায় সরকারীভাবে কোন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
১৯৭৭ সালে জাতীয় একটি দৈনিক সম্পাদকীয়তে চাউলধনী হাওরে স্লুইস গেইট নির্মাণের জন্য এডিপি একটি প্রতিনিধি দলও সরেজমিনে হাওর পরিদর্শন করেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত গেইট নির্মাণ করা হয়নি। হাওরে প্রচার ঘর-বাড়ি হলেও প্রায় ৬হাজার একরের মতো জমি রয়েছে বলে স্থানীরা জানান। এখানে একটি স্লুইস গেইট নির্মাণ করে সরকারীভাবে হাওর সংরক্ষণের উদ্যোগ ও সীমানা নির্ধারণ করলে প্রচুর বোরো ফসল উৎপাদন এবং জীববৈচিত্র ও দেশীও প্রজাতির মাছ রক্ষ করা সম্ভব।
বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মুহিবুর রহমান চাউলধনী হাওরের পানি প্রত্যাহার করে বোরো ফসল উৎপাদন ব্যাহত করার ঘটনায় বিষ্ময় প্রকাশ করেন। এক প্রতিবাদ সমাবেশে ইজারাদারদের বে-আইনী ও কৃষক বিরোধী কর্মকান্ডের কারণে লিজ বাতিল এবং সরকারী হাওরের জলাশয় অংশ চিহ্নিত করে কৃষকদের জমি, পুকুর, খাল-নালা উদ্ধারের দাবী জানিয়েছেন। অন্যথায় এলাকার কৃষক সমাজকে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন করবেন। তিনি বলেন, যারা সামান্য লোভের কারণে শত কোটি টাকার ধান উৎপাদন ব্যাহত করেছেন তারা দেশের এবং কৃষকের শত্রু। এদেরকে প্রতিহত করতে হবে।
দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমির আলী বলেছেন, চাউলধনী হাওরের পানি প্রত্যাহারের কারণে বোরো ফসলের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করা সম্ভব নয়। তিনি কৃষকদের দাবীর প্রতি একমত পোষণ করেন।