এএইচএম ফিরোজ আলী
আজ ৯ডিসেম্বর মুসলিম বিশ্বের নারী জাগরণের অগ্রদূত, জীবন্ত কিংবদন্তি মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া দিবস। ১৯৯১ সাল থেকে নারী কল্যাণ সংস্থা ও ১৯৯৬সাল থেকে প্রতিবছর রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দিবসটি পালন করা হয়। বেগম রোকেয়া ছিলেন, অজ্ঞতার অন্ধাকারে নিমজ্জিত (ডুবন্ত) নারী সমাজের এক উজ্জল নক্ষত্র-পথ প্রদর্শক। কুসংস্কারাছন্ন নারীর অন্ধকারের দেয়াল ভেঙ্গে শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে নারীর গতিশিলতা, স্বতন্ত্র জীবন, নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরিকরণে তাঁর ভুমিকা অনস্বীকার্য। বেগম রোকেয়া মুসলিম বিশ্বের নারীবাদি বাঙালি, বিশ্বে নারী জাগরণের এক আদর্শ জননী। বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট্র বাঙালির বাছাই জরিপে, তিনি ৬ষ্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক বেগম রোকেয়া ছিলেন, অসাধারণ প্রতিভার অধিকারি। বেগম রোকেয়া সমাজের একজন সংস্কারক ছিলেন। গুগল এর হুম পেইজে বেগম রোকেয়াকে নিয়ে গুগল ডুডল প্রদর্শন করে তাঁর ১৩৭তম জন্মদিন (৯ডিসেম্বর) পালন করে। তাতে দেখা যায়, সাদা পোষাকে চশমা পরা বেগম রোকেয়া বই হাতে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। বিশ্বনন্দিত অক্সফোড ডিকসোনারী অব ন্যাশনাল বায়োগ্রাফিজের সর্বশেষ সংরক্ষনে বেগম রোকেয়ার নাম সংযোজিত হয়েছে। নারী-পুরুষ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্ছার প্রতিবাদি কন্ঠ বেগম রোকেয়া এখন বিশ্বের রোল মডেল।
বেগম রোকেয়ার জন্মের সময় (১৮৮০সালে) নারীর জীবন ছিল, ভয়াবহ অন্ধকারে। নারী ছিল, শুধুমাত্র ঘরের শোভা, শৃঙ্খলাবদ্ধ, রান্নার শ্রমিক এবং ঘর থেকে বের হওয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করা ছিল নিষিদ্ধ। বেগম রোকেয়ার ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবন ট্রাজেডিতে ভরা ছিল। মা, স্বামী ও অকালে নিজের দুই কন্যা শিশুকে হারিয়ে বেদনাহত ও শোকে ভারাক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি বিচলিন হননি, পথ হারাননি। সকল ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর পিতা জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ আলী হায়দার উর্দূ, আরবি, ফার্সি ভাষার পন্ডিত ও একজন প্রভাবশালি জমিদার হলেও তিনি মেয়ে শিক্ষার ব্যাপারে খুবই রক্ষণশিল এবং পর্দাশিলতায় কঠোর ছিলেন। মা রাহাতুনন্নেছা ছাবেরা চৌধুরানীর গর্ভে ২বোন ও ৩ভাই জন্ম গ্রহন করেছিলেন। শৈশবে ১ভাই মারা যান। বড় ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহিম আব্দুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবুসায়েগাম সাবের কলকাতা সেন্ট জের্ভিয়াস কলেজে লেখাপড়া করে আধূনিক মনস্ক হয়ে ওঠেন এবং বড়বোন করিমুনন্নেছা ছিলেন, সাহিত্যনুরাগী ও বিদে্যুাৎসাহী। এ কারনে শিক্ষা লাভে সাহিত্যচর্চা ও সামগ্রীক মূল্যবোধ গঠনে ভাই-বোনের অবদান ছিল অতুলনীয়। তৎকালিন মুসলিম সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের শিক্ষালাভের সুযোগ দূরে থাক, কল্পনাও করেননি কেউ। কিন্তু ৫বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাসকালীন সময়ে বেগম রোকেয়া একজন শিক্ষিকা নিকট লেখাপড়ার সুযোগ পেলেও সমাজ ও আত্নীয়স্বজনের চাপে বন্ধ করতে হয়েছিল। তারপর ভাই বোনের সমর্থন নিয়ে সকল বাঁধা আপত্তি কৌশলে অতিক্রম করে বাংলা, ইংরেজি, উর্দূ, ফার্সি ও আরবিতে শিক্ষা লাভ করেন।
বেগম রোকেয়া মেয়েদের, স্বামীর দেয়া অলংকারকে, ‘দাসত্বের প্রতীক মনে কতেন, এবং নারী নিজের আত্নসম্মান বোধে উজ্জিবিত হয়ে নিজের স্বাধীনতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে লেডি কেরানি থেকে জর্জ ম্যাজিস্ট্রেট, ব্যরিস্টার হওয়ার যুক্তি তুলে ধরে ছিলেন। সমাজের কুসংস্কার ও জড়তা দূর করার জন্য অসাধারণ পন্ডিত্যাপূর্ণ হৃদয়গ্রাহী গদ্য রচনা করেছেন। বেগম রোকেয়া নারী হয়েও ‘যার দু:খ’ প্রবন্ধে ভারতবর্ষে সভ্যতা, অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে এ অঞ্চলের কৃষকদের সূচনীয় অবস্থা তুলে ধরে, কৃষক সমাজে প্রশংসিত হয়েছিলেন। হাস্যরস, ব্যঙ্গ, বিদ্রোহের সহায়তায় পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান তুলে ধরেছেন। ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ, শিক্ষা ও পছন্দনুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া নারীর মুক্তি আসবে না বলে প্রবল যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। ‘মতিউর প্রবন্ধ গ্রন্থে’ নারী-পুরুষের সক্ষমতার যুক্তি দিয়ে নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সামাজিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করে সমধিকার প্রতিষ্ঠার জোরালো বক্তব্য প্রদান করেন। শিক্ষার অভাবে নারীর পশ্চাৎপদতার কারন উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘‘পুরুষেরা ভূস্বামী, গৃহস্বামী হয়েও মেয়েদের স্বামী হইয়া অলংকার গুলি দাসত্বের নিদর্শন.. কারাগারের বন্দিগণ লৌহ নির্মিত বেড়ী পরে আমরা (নারী) রৌপ্যের বেড়ী পরিয়াও বলি মন পাইয়াছি’ এমন মল গ্রহণ করি।
যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ‘বঙ্গেল মহিলা কবি গ্রন্থে, বেগম রোকেয়ার প্রসংঙ্গে বলেছেন ‘বেগম রোকেয়ার জ্ঞানপিপাসা ছিল অসীম। গভীর রাত্রিতে সকলে ঘুমাইলে চুপি চুপি বিছানা ছাড়িয়া বালিকা মোমবাতির আলোকে জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতার কাছে ইংরেজি ও বাংলা পাঠ গ্রহণ করিতেন। পদে পদে গুঞ্জনা সহিয়াও এভাবে দিনের পর দিন তাঁহার শিক্ষার উন্নতি হইতে লাগিল। কতখানি আগ্রহ ও একাগ্রতা থাকিলে মানুষ শিক্ষার জন্য এরূপ সাধনা করিতে পারে তাহা ভাবিবার বিষয়,।
রংপুর মিটাপুকুরের পায়রাবন গ্রামে ১৮৮০সালের ৯ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া জন্ম গ্রহনের পর ১৮৯৮সালে ১৮বছর বয়সে বিহারের ভাগলপুর গ্রামের উর্দুভাষী ডেপুটি ম্যাজিসেন্ট্রট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বিবাহ হলে নামের, ‘সাথে, সাখাওয়াত, হোসেন যুক্ত করেন। স্বামী ছিলেন, একজন সমাজ সচেতন নীতি-নৈতিকতার অধিকারি। কুসংস্কারমুক্ত উদার ও মুক্ত মনের মানুষ, স্বামীর উৎসাহ উদ্দিপনা, অনুপ্রেরনা ও পরামর্শ্যে বেগম রোকেয়ার জ্ঞানার্জনের পথ অধিকতর সুগম ও প্রসার ঘটে। দেশি-বিদেশি লেখক ও তাঁদের পত্রিকায় লিখিত রচনার সাথে নিভিড়ভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগে ইংরেজি শিক্ষায় দারুণ দক্ষতা লাভ করেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে স্বামীর দুটি চোখ নষ্ট হলে ১৯০৯সালের ৯মে স্বামীর মৃত্যুর পর জীবনে অন্ধাকার নেমে আসে। স্বামীর স্মৃতি রক্ষার্থে ও নারী শিক্ষার উন্নয়নে স্বামীর জমানো টাকায় ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্স হাইস্কুল, ৫জন ছাত্রী নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা যাওয়ার কারনে ১৯১১সালের ১৬মার্চ কলকাতার ১৩নং ওয়ালিউল্লা লেনের বাড়িতে পূণরায় ৮জন ছাত্রী নিয়ে পূর্বনামে স্কুলের কার্যক্রম শুরু করেন এবং ৫বছর পর ছাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০জন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে ছাত্রীদের স্কুলে নিয়ে আসতেন এবং প্রতিষ্টানটি টিকিয়ে রাখতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। এ প্রতিষ্ঠানটি ছিল তাঁর জীবনের চেয়ে মূল্যবান সম্পদ ও নারী জাগরনের ঐতিহাসিক কারখানা। তখন তিনি নারীদের সংগঠন আনজুমানে খাওয়াতিল প্রতিষ্টা করেন। ১৯২৬সালে কলকাতায় নারী বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এবং ১৯৩০সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে বাংলা ভাষার পক্ষে এক দু:সাহসিক ঐতিহাসিক ভাষন দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ১৯০২সালে ‘পিপাসা’ নামক একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্য জগতে যাত্রা শুরু করেন। ১৯৩২সালে ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন এবং জয়দেবপুরে তার কবর রয়েছে।
বেগম রোকেয়া এখন বিশ্বে নারী জাগরনে এবং নারীবাদি মহিলাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর জীবনকর্ম আদর্শ নারী-পুরুষের বৈষম্য সর্ম্পকে নতুন প্রজন্মকে অবহিত এবং তাঁর আদর্শ লালন-পালন এবং তাঁর অবদানকে অবিস্মরণীয় করে রাখার জন্য ২০০৮সালে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০০৯সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামে নামকরণ এবং পায়রাবন গ্রামে বেগম রোকেয়ার পৈতৃক ভিটায় ৩.১৫একর জমির উপর সরকারিভাবে বেগম রোকেয়া স্মৃতি গবেষনাকেন্দ্র উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেন্দ্রটিতে ২৬০আসন বিশিষ্ট অত্যাধুনিক মিলনায়তন, ১০০আসন বিশিষ্ট সেমিনার কক্ষ, ১০হাজার পুস্তক রাখার ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন লাইব্রেরী, গবেষনাকেন্দ্র সুবিধা নিয়ে প্রতিষ্টানটি তৈরী করা হয়। ২২টি বিভাগে ৭হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন। এ দুটি প্রতিষ্ঠান এখন উত্তরাঞ্চলের শিক্ষা জগতে এক নতুন দ্বার উম্মোচন করে দেশের বড় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ষাট দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে বেগম রোকেয়ার নামে হলের নাম করণ করা হয়েছে।
২০১৫সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমি ফোরামের, দ্যা গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নারী অবস্থান বিবেচনায় বিশ্বের এক নম্বরে ওঠে আসে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের আরেক পুরোধা ব্যক্তিত্ব কবি সুফিয়া কামাল ও তাঁর মেয়ে সুলতানা কামাল। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ৭১সালের পরাজিত শত্রæদের বিচারের দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃত্ব দিয়ে মানবতাবিরোধী বিচারের পথ সুগম করেছিলেন। বাংলাদেশে ৫০হাজারেরও বেশি নারী, পোষাক শিল্পের কাজ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকাকে সচল করছেন। বর্তমানে দেশে মেয়ে শিক্ষার হার বেশি এবং ফলাফলেও ছেলেদের চেয়েও বেশি। অনেক মেয়ে বিদেশে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করছেন।
নারী জাগরণের সাহসী যোদ্ধা বেগম রোকেয়া প্রায় ৯২বছর পুর্বে ইহলোক ত্যাগ করলেও তাঁর অবদান এখন বিশ্বজুড়ে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোতে ব্যবসা বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে মহিলাদের সরব উপস্থিতি বিদ্যমান। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে নারীর উপস্থিতি বাংলাদেশের মান-মর্যাদাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী, মন্ত্রী, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, ইউএনও, এসিল্যান্ড, চিকিৎসক, শিক্ষক, সেনা, নৌ, বিমান এই তিন বাহিনী, ডিসি, এসপি, ট্রেন চালকসহ সরকারি সকল দফতরে নারীর জয় জয়কার। বেগম রোকেয়ার অবদান বাংলাদেশসহ বিশ্ব পরিমন্ডলে এখন অবিস্মরণীয়।
লেখক কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক
মোবাইল-০১৭১১ ৪৭৩১৫৫