এএইচএম ফিরোজ আলী
পৃথিবীতে মানুষের নিকট মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম Snake বা সাপ। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানে সাপ মহামূল্যমান এক সম্পদ। সোনা-রুপা, হীরা, তরল ডায়মন্ড, চেয়ের দামী সাপের বিষ, চামড়া ও মাংস। সাপের বিষ দিয়ে অনেক রাষ্ট্র মরণব্যাধী রোগের ঔষধ তৈরী করে কোটি কোটি ডলার আয় করছে। বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখবে, সম্ভাবনাময় সাপ শিল্প। আদিকাল থেকে সাপের সাথে মানুষের শত্রু থাকায় দেখামাত্রই সাপ মেরে ফেলা হয়। হাত-পা বিহীন লম্বা প্রকৃতির উভয়চর প্রাণী সাপ। জলে-স্থলে, পাহাড়-পর্বতে সমুদ্রে, গাছের গুহায়, মাটির গর্তে বাস করলেও সরীসৃপ জাতীয় এ প্রানী নিয়ে সময়ের প্রয়োজনে ফার্ম গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশে।
পৃথিবীতে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি প্রজাতির সাপের মধ্যে, প্রায় ৫০০ প্রজাতির বিষধর, বাকী সব নির্বিষ। বাংলাদেশে ৯৪প্রজাতির সাপের মধ্যে ৫৪প্রজাতি বিষধর। এর মধ্যে গোখরা, কোবরা, মায়া, কাউচিয়া, রাজগোখরা, পদ্মগোখরা, কালোনাইজার, রাসেলভাইপার, গ্রীনভাইপার, ঘরগিন্নি,কুকবি ক্রেইট বা শঙ্খিনীসহ অনেক প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, সাপের বিষ দিয়ে ৪২ধরনের ঔষধ তৈরী করা হয়। সাপের বিষ দিয়ে সাপে কাটার রোগীর ইনজেকশন ‘এন্টিভেনম Antivenom তৈরী করা হয়। Rattle sanke এর বিষ দিয়ে CB24 নামক ক্যানসারের ঔষধ, Brazilian pitviper বিষধর সাপের বিষ দিয়ে Ace blockers নামক ঔষধ তৈরী করা হয়, যা রক্তচাপ কমানো, কিডনি, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিসসহ অনেক মরণব্যাধী রোগের চিকিৎসা করা হয়। শুধু তাই নয়, সাপের বিষ দিয়ে হেরোইন, মারিজুয়ানা, কোকেনসহ অনেক মাদক তৈরী করা হয়। যে কারণে সাপের বিষের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক বেশি। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, ভারতে এক গ্রাম বিষের মুল্য ৭ লাখ রুপি, ১লিটার বিষাক্ত সাপের বিষের মূল্য ভারতীয় মূদ্রায় ৮০ কোটি রুপি । রেড স্যান্ড বোয়া নামক এক শ্রেণীর দ্বিমুখী একটি সাপের দাম ১কোটি। বাংলাদেশে এক লিটার বিষাক্ত সাপের বিষের মূল্য ৬ থেকে ৭কোটি টাকা। উচ্চ মূল্যের সুবিধায় আন্তর্জাতিক চোরাচালানী চক্র এদেশে সক্রিয়। কিছু রাঘব বোয়ালও সাপের চোরাচালানি ব্যবসায় জড়িত।
আমাদের দেশে বিষধর সাপ, কোন লোককে কামড় দিলে বিষের তীব্রতায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর অবশ, শরীরে পচন এবং হৃদপিন্ড বিকল হয়ে নিশ্চিত মৃত্যু হয়। বিষধর সাপের শরীরে বিষ উৎপাদনকারি গ্রন্থি এবং বিষদাঁত থাকে। কিংকোবরা, গোখরা পাইথনসহ বিষধর সাপে রাসায়নিক উপাদান পটাশিয়াম চায়ানাইডের পরিমান বেশি থাকে। সাপে কামড়ের প্রতিষেধকের নাম ‘এন্টিভেনম’। এ ইনজেকশন তৈরী করা হয় সাপের বিষ দিয়ে। যাকে বলা হয়, ‘কাটা দিয়ে কাটা তোলা’, বিষে বিষ খায়, সাপের কামড়ে রোগী আক্রান্ত, বিষের তৈরী ইনজেকশন দিয়ে রোগী সুস্থ। এসব কথা প্রবাদ প্রবচন হলে, বিজ্ঞানে প্রমাণিত সত্য। সাপ ছাড়াও বিছা, মাকড়সা, কাকড়াবিছার মত বিষধর প্রাণীর বিষ দিয়ে ঔষধ তৈরী করা হচ্ছে। হার্ট ও স্ট্রোকের প্রধান অনুষঙ্গ হল, থেম্বরোসিস বা রক্তের জমাট বাধা, সাপের বিষের তৈরী ঔষধ, রক্তের জমাটবাঁধা দুর করে এবং পাশ^প্রতিক্রিয়া কম থাকে। ১৮৯৪ সালে ফ্রান্সের ব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞানী আলবার্ট ক্যালমেট ‘এন্টিভেনম’ ইনজেকশন আবিস্কার করেন। পরবর্তীতে সেটির মান উন্নয়নে লুইপাস্তর ভ‚মিকা রাখেন।
বাণিজ্যিকভাবে এল্টিভেনম তৈরীর জন্য ঘোড়ার ব্যবহার সর্বাধিক। এন্টিভেনম তৈরীর জন্য প্রথমে সাপের বিষ, সুস্থ সবল তাজা ঘোড়ার শরীরের সিরিঞ্জের মাধ্যমে নির্দিষ্ট মাত্রায় ধমনীতে বিষ প্রবেশ করিয়ে কয়েক মাস পর ঘোড়ার রক্তে শক্তিশালী এন্টিবডি তৈরী করে ঘোড়ার রক্ত সংগ্রহ করা হয় এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রক্তকনিকাগুলো আলাদা করে রক্তের এন্টিবডি আলাদা করা হয়। আলাদাকৃত এন্টিবডিই এন্টিভেনম প্রতিষেধক।
বিশ্বে প্রতি ৫মিনিটে সাপের কামড়ে মারা যায় একজন, পঙ্গু হয় ৪জন। প্রতি বছর ৫৪লাখ সাপের দংশনে শিকার হয়ে ১লাখ ৩৮ হাজার মারা যান। বিবিসি বাংলা বলেছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে বর্ষাকালে ৫লাখ ৮০হাজার লোককে সাপে দংশন করে এবং মারা যান ৬হাজার। ২০১৯সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা একই তথ্য প্রকাশ করে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাজবাড়ি, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনায় বেশি লোক সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়। মজার বিষয় হল যে, ‘এন্টিভেনম’ বাংলাদেশে তৈরীর সূবর্ণ সুযোগ থাকা সত্তে¡ও এ প্রতিষেধক তৈরী করা হয়না। ভারতের তামিলনাড়– থেকে এ ইনজেকশন কিনে আনা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধী বিভাগের হাবিবুর রহমান বলেছেন, প্রতিবছর সরকারীভাবে ৫কোটি টাকার অধিক এন্টিভেনাম কিনে আনতে হয়। ভ্রান্ত ধারনার কারনে, অনেক রোগী হাসাপাতালে যান না, গেলেও ঔষধের সংকট, অনেক চিকিৎসক প্রশিক্ষণ না থাকায় এন্টিভেনম রোগীর শরীরে পুশ করতে পারেন না। ফলে অনেক রোগী হাসপাতালে মারা যায়।
বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পের সুনাম বিশ্বজুড়ে। ২০১৭সালে সাপের কামড়ের প্রতিষেধক এন্টিভেনম তৈরীর জন্য ৫বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প গ্রহণ করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, ট্যাক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং জার্মানির স্যাটে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা। ১৯৮৫ সালেও এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। বিষের বাণিজ্যিক করণ, প্রতিষেধক ওষধ তৈরীতে কাঁচামাল হিসেবে উৎপাদনের জন্য দেশে অনেক সাপের ফার্ম গড়ে তোলা হয়েছে। ২০১০সালে জাতীয় সংসদে সাপ বিষ বাণিজ্যের অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক মনোভাব থাকায় ২০১৪সালে বিধিমালা করে তৈরী লাইসেন্স প্রদান এবং সাপের বিষ বাণিজ্যিক ছাড়পত্রের জন্য প্রাণী সম্পদ, বন ও পরিবেশমন্ত্রনালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করা হলে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ‘লাল ফিতায়, বন্দি আছে ফাইল। ফলে বাংলাদেশে সাপের বিষের অবৈধ ব্যবসা আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেটের হাতে থাকায় কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
দেশের রাজবাড়ী, নাটোর, বরিশাল, পটুয়াখালীসহ অনেক অঞ্চলে সাপ ফার্ম গড়ে উঠেছে। পটুয়াখালীর নন্দিপাড়া গ্রামের সৌদি প্রবাসী আব্দুর রাজজাক ‘বাংলাদেশ ¯েœকভেনম’ নামে একটি সাপের ফার্ম গড়ে তুলে দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। সৌদিআরব থেকে ফিরে এসে বিরল সম্ভাবনাময় এ সাপের ব্যবসা শুরু করেন। ২০০০সালে নিজের হাতে ধরা গোখরা সাপের ২০টি ডিম নিয়ে খামারের যাত্রা শুরু করলে এখন তার খামারে বিষধর সাপ কোবরা, নাজানাজা, কমনক্রেইট, কিংকোবরা, রাসেলসভাইমার, পাইথনসহ অনেক মূল্যবান বিষধর সাপ রয়েছে। বিটিভির ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানের জনপ্রিয় উপস্থাপক হানিফ সংকেত রাজ্জাকের বাড়ীতে গিয়ে ফার্মের একটি প্রতিবেদন প্রচার করেন।রাজ্জাক এখন প্রতি মাসে ১কোটি টাকার সাপের বিষ বিক্রি করার মত সাপ উৎপাদন করছেন।
রাজবাড়ী জেলার মৃগী ইউনিয়নের কামাদহ গ্রামে একদল তরুন সাপের বিষ উচ্চ মূল্যে বিক্রির আশায় ফার্ম গড়েছেন। রংপুরের রামনাথপুর ইউনিয়নের খোর্দ বাগবাড়ী গ্রামে ৪৮টি পরিবারে প্রায় ৪০০ আদিবাসী স¤প্রদায়ের লোক বংশানুক্রমিকভাবে আড়াইশ বছর ধরে সাপ লালন-পালন করছেন। তারা সাপের বিষের উচ্চমূল্যের কথা জানেন না, জানলেও তারা সাপের বিষ বের করতে পারেন না। ফলে আন্তর্জাতিক চোরাই চক্র ঢাকা থকে সেখানে গিয়ে প্রতিটি বিষধর সাপ দুই, তিনশ টাকা দামে কিনে নিয়ে আসে। এতে তাঁরা সাপের উচিৎ মূল্য পায় না। নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার খামার মালিক সাহাদাত হোসেন ছাড়পত্র না থাকায় প্রশাসন তাকে একাধিকবার অর্থদন্ড করায় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
২০২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকার দক্ষিন এলাকা থেকে ৯কেজি ওজনের ৭৫কোটি টাকার সাপের বিষ উদ্ধার করেছিল র্যাব ৯। ২০১৬ সালের ২আগস্ট চুয়াডাঙ্গার পিটিআই মোড়ে ১২কোটি টাকার মুল্যের বিষসহ সোহেল নামের একজনকে গ্রেফতার করেছিল বিজিপি। এবছর ৭মার্চ রাজধানীর লালবাগের ইরাকি কবরস্থানের মাঠের পশ্চিম পাশের ভবন থেকে ৪৫কোটি টাকার বিষ উদ্ধার করে র্যাব। ২০১৪ সালের ২৭সেপ্টেম্বর জয়পুর হাটের হোটেল থেকে র্যাব ৫৬৮কোটি টাকার বিষ উদ্ধার করে। ২০১৩ সালের ১৭ফ্রেব্রæয়ারি রাজাধানীর উত্তরা থানা এলাকা থেকে ১২কোটি টাকা ৬বোতল বিষ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০১০সালে ঢাকার মাতঝিল এলাকা থেকে ২আউন্স ২০০৯সালে কাওরান বাজারে ১২আউন্স, ২০০৮সালে ১৪ফেব্রæয়ারি ফরিদপুর উপজেলা থেকে ১২পাউন্ট সাপের বিষ উদ্ধার করে র্যাব-১২।
আমাদের দেশে সাপ নিয়ে যত ভ্রান্ত ধারণা, অন্য প্রানী নিয়ে তা শূন্যভাগও নেই। বলা হয়, সাপ দুধ-কলা খায়, দিনে সাপকে আঘাত করলে রাতে চিনে বাড়ি গিয়ে কামড় দেয়, চাপ গরুর বাঁট ধরে দুধ চুষে খায়, সাপ সাপুড়ের বীন বাজানোর শব্দ শুনে নাচে, সাপের পা দেখলে রাজা হওয়া যায়। সাপের কামড়ের রোগী ওঝা, ঝাড়ফোঁক ছাড়া ভাল হয়না। কলার ভেলায় সাপে কামড়ের রোগী পানিতে ভাসিয়ে দিলে যে সাপ কামড় মেরেছে, সেই সাপ বিষ চুষে নেয় ইত্যাদি। কালনাগিনী সাপের নাম শুনলে অনেকের শরীরে কম্পন শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এ সাপ জেদি বা ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হলেও তার বিষ নেই। সাপ বধির প্রাণী, কানে শোনে না, জি¦ব দিয়ে ঘ্রান নেয়, মানুষের ঘ্রান পেলে এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে পালানার চেষ্টা করে। সাপে দংশনের সাথে সাথে হাসপাতালে যেতেই হবে। ঝাড় ফোঁক, তাবিজ-কবজ মুখ দিয়ে বিষ টানা, দঁড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা সবই ভ্রান্ত ধারনা।
সৃষ্টি জগতের সকল প্রাণীই মানুষের উপকারে আসে। তাই সাপসহ কোন প্রাণী মারা উচিত নয়। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক ধরণের সম্ভাবনার দিগন্ত উম্মোচিত হচ্ছে। ঔষধ শিল্পের বিকাশ, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাপ লালন-পালন বিষ বাণিজ্যের আইনত অনুমোদন দেয়া হলে দেশের উন্নয়নে বড় ভুমিকা পালন করবে সম্ভাবনাময় এ সাপ শিল্প।
এএইচএম ফিরোজ আলী
কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক