এ এইচ এম ফিরোজ আলী
আজ ১১ জুলাই শনিবার বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এবারের দিবসটির প্রতিবাদ্য বিষয় হচ্ছে, “মহামারী কোভিড-১৯কে প্রতিরোধ করি, নারী ও কিশোরীর সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করি”। ১৯৯০ সাল থেকে পৃথিবীর ৯০টি দেশ সর্বপ্রথম এ দিবসটি পালন করে। বাংলাদেশও প্রতিবছর অতিগুরুত্ব সহকারে দিবসটি পালন করা হয়। কারণ অতিরিক্ত জনসংখ্যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে একটি বড় বাধা। দেশে শুধু লোকসংখ্যা বাড়ছে, আয়তন বাড়ছে না। বরং নদী ভাঙ্গনে হাজার হাজার মানুষ বসত বাড়ি হারাচ্ছে। জনাধিখ্যের কারণে বাংলাদেশ এখন বহুমুখি সমস্যায় জর্জরিত। ফসলি, পতিত জমি, খাল, বিল, হাওর, নদী ভরাট করে বাসা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। প্রতি ১১ জন শিশুর জন্মের বিপরীতে মৃত্যু হচ্ছে, ১টি শিশু। এক সময় অনেক পরিবার মা ও শিশুর প্রতি চরম অবহেলার কারণে বছরে প্রতি হাজারে ১০৫ থেকে ১২৫ জন শিশু এবং সন্তান জন্মকালে বছরে প্রায় ৩০ হাজার গর্ভবতী মা গর্ভজঠিলতায় মারা যেতেন। গ্রামের মানুষের সে সময়ে চরম স্বাস্থ্যহীন ছিল। মা ও শিশু, পরিবারের পুরুষরা খাওয়ার পর অল্প খাবার পেলে খেতেন না হয় উপোষ থাকতেন। গর্ভবতী মহিলাদের দিনে ১বার খাবার দেয়া হতো। বেশি খেলে শিশুরা বড় হয়ে যায় এবং ডেলিভারীতে বাঁধার সৃষ্টি হয়। এমন ভ্রান্ত ধারনা ছিল মানুষের মনে। এতে অধিকাংশ মা ও শিশুর শরীর কঙ্কালের মত দেখা যেত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো গত (৩০জুন ২০২০ইং) প্রকাশিত তথ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৭৪ লাখ। ২০৩০ সালে দেশের আয়তন ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার হলে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বর্তমানে বসবাস করছেন ১ হাজার ৪৩ জন। ২০৩০ সালে বিশ্বে যখন জনসংখ্যা বাঁড়াবে ৮৬০ কোটি, তখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ২০ লাখ। সে সময় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে লোকসংখ্যা দাঁড়াবে ১হাজার ৩৭৯জন। ২০১৭ সালে জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৫০ লাখ,২০১৮ সালে ছিল ১৬ কোটি ৬৩ লাখ ৭০ হাজার। ২০১৭ সালে বিবিএস বলেছিল, প্রতি বছর দেশে ৩৪ লাখ লোক বাড়ছে, জাতিসংঘ বলেছিল, ১৮ লাখ মানুষ যুক্ত হবে মোট জনসংখ্যার সাথে। । জনসংখ্যার কারণে বনাঞ্চল ধ্বংস, পানি সম্পদ নষ্ট, সর্বোপরী পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সংক্রামক, অসংক্রামক রোগ ব্যাপক হারে বাড়ছে। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে। মানুষের প্রতি মানুষ দয়া-মায়াহীন, অমানবিক হয়ে পড়ছেন। করোনা কিংবা সাধারণ রোগে মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার চিত্র দেখা যাচ্ছে। সন্ত্রাস, খুন খারাবি, নারী ও শিশু নির্যাতন, বেহায়াপনা চরম বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিজি) হিসেবে তালিকা ভুক্ত করে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নি¤œমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয় এবং ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার কথা। বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। জনসংখ্যা এমনই এক অর্থনৈতিক উপকরণ যা এক সংগে “সম্পদ”, বা ‘দায়’ হিসেবে বিবেচিত হয়। জনসংখ্যা কাজে লাগলে সম্পদ, না হয় আপদ। অর্থনীতিবিদদের মতে, মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি কর্মক্ষম লোক হলে সেটা ডেমোগ্রাফিক বোনাস কাল ধরা হয়। গত বছর দেশে ৬ কোটি ১৬ লাখ লোক কর্মক্ষম ছিলেন। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের কারণে প্রায় দেড় কোটি মানুষ বেকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পোষাক খাতে ধস নেমেছে। ৪৭% শিক্ষিত স্নাতক ডিগ্রিধারি বেকার। ঢাকা সহ বড় বড় শহরের মানুষ কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। অর্থনীতির চাকা পেছন দিকে ঘোরতে শুরু করেছে। দেশের সকল মানুষ কর্মক্ষম হলেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন না হলে কৃষি জমি যেমন রক্ষা করা যাবে না, তেমনি মানুষের থাকার স্থান সাংকুলান হবে না।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপে প্রথমে জন্ম নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের সূচনা হয়। ধারণা করা হয়, ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট পন্ডিত ও অর্থনীতিবিদ ম্যালথাস, এর ভিত্তি রচনা করেন। তিনি চিন্তা করেন, পৃথিবীর আবাদযোগ্য জমি ও অর্থনৈতিক উপায় উপকরণ সীমিত। কিন্তু বংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা সীমাহীন। সুতরাং মানব জাতির স্বাচ্ছন্দ, আরাম-আয়েশ, কল্যাণ ও শান্তির জন্য মানুষ বংশ বৃদ্ধির সাথে আয়কে সংগতি রক্ষা করে চলতে হবে। জনসংখ্যা যেন কখনও অর্থনৈতিক উপাদানের উর্ধে যেতে না পারে। সে কারণে তিনি অধীক বয়সে বিয়ে করা এবং স্বামী-স্ত্রীর সংযমের প্রতি অধীক গুরুত্ব প্রদান করেন। ১৮৩৩ সালে আমেরিকার বিখ্যাত চিকিৎসক চার্লস জেনটন ম্যালথাসের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন সূচক ইঙ্গিত করে, সর্বপ্রথম গর্ভনিরোধের চিকিৎসা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা এবং উপকারীতার প্রতি গুরুত্ব দেন।
বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে জন সম্পদে পরিনত করতে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের ভূমিকা অপরিসীম। এর বিভাগ এখন বিশ্বে নন্দীত ও প্রশংসিত। অধিদপ্তরসহ এ বিভাগের বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৫০হাজার। এর মধ্যে এফপিআই ও এফডাব্লিউএ এর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২৯হাজার। ১৯৫২ সালে মার্কিন একটি বেসরকারী সংস্থার মাধ্যমে ‘পরিবার পরিকল্পনা নামে’ পাকিস্তানে কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৯৫৪ সালে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আমেরিকা একটি আর্ন্তজাতিক সম্মেলন আহবান করে। ১৯৫৮সালে আইয়ুব খান ‘ভিলেজ এইড’ নামে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালাতে থাকেন। ষাটের দশকে কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (াধৎফ) জন্মনিয়ন্ত্রন উপকরণ সহজে বিতরণের জন্য একটি মডেল তৈরী করে। ১৯৭০ সালে আই ইউ ডি, কনডম, স্থায়ী পদ্ধতি বন্ধ্যাকরণ শুরু হলে ইউ এস এইড বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য দেয়। সত্তর দশকের শেষ দিকে আমেরিকার একটি কোম্পানী জন্মনিয়ন্ত্রন পিল উৎপাদন করে বাংলাদেশে বাজারজাত করে। স্বাধীনতার পর আমেরিকা জন্ম নিয়ন্ত্রনে সহায়তা বাতিল করে পুনরায় ৭৫সালে বহাল করা হয়।
১৯৭৬সাল থেকে মাঠ কমচারী নিয়োগ করে সরকারীভাবে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম শুরু হয়। ৯০দশকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য সহায়ক সৃষ্টির লক্ষ্যে মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশু স্বাস্থ্য নীতি শুরু করলে এই সুযোগে মাঠ কর্মীরা মা ও শিশু স্বাস্থ্যের কথা বলে, সরাসরি বাড়ী পরিদর্শনের যেতেন। স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগের আগ পর্যন্ত পরিবার কল্যাণ সহকারী ও পরিবার পরিকল্পনা সহকারীরা ছিলেন, গ্রামের মানুষের নিকট স্বাস্থ্য কর্মী বা ডাক্তার। তারা তাবিজ কবজ, ঝাড়,ফুক, জ্বীন, ভুতের ভ্রান্ত ধারনা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে পরিশ্রম করতেন। সে সময় চাকুরী দেয়া হতো স্থানীয় কর্মকর্তা কর্মচারীদের। যারা কাঁদা পানি ভেঙ্গে মানুষকে বুঝানোর মত সুন্দর কথা-বার্তা বলতে পারতেন এবং ধৈয্যশীল ছিলেন। তখনকার সময়ে জেলা, উপজেলা এমনকি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গাড়ীনয় পায়ে হেটে লুঙ্গি পড়ে সেন্ডেল হাতে নিয়ে কর্মীদের বাড়ীতে গিয়ে তাদের নিয়ে গ্রামের শিক্ষক, মুরব্বী, মাতব্বরদের নিয়ে ছোট পরিবার গঠনে বৈঠক করতেন। মানুষদের বুঝাতেন ‘দেশে মানুষ বাড়ছে, আয়তন বাড়ছেনা, আয় থেকে ব্যয় বেশি হলে পরিবারের অভাব দেখা দেয়, মেয়েরা শিক্ষিত না হলে পরিবারের সন্তানরা শিক্ষিত হয় না এবং জাতি শিক্ষিত না হলে দেশের উন্নতি হয় না’। বাড়ী আঙিনা, আশ-পাশের খালি জায়গাতে শাক, সবজি, ফলমুল ফলানো, পুকুরের পানি পান না করে নলকুপের পানি পান করা। বাড়ীঘর রাস্তাঘাট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, সেনেটারী ল্যাটিন ব্যবহারের পরার্মশ দিতেন। কর্মীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে খাবার স্যালাইন নিজ হাতে তৈরি করে মহিলাদের দেখাতেন। প্রায় ৪ যুগ এমন পরিশ্রমের ফসল হচ্ছে, আজকের বাংলাদেশ। জাতিসংঘ সহ বিশ্বের অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের এসব সাফল্যজনক কাজের প্রশংসা করছেন। কিন্তু এ বিভাগের কর্মীদের এখনও মূল্যায়ন করা হয়নি।
এ বিভাগের মূল ফাউন্ডেশন হচ্ছেন, পরিবার কল্যাণ সহকারী (এফডাব্লিউ-এ) এবং তাদের ফাস্ট লাইন সুপারভাইজার বা তদারককারী পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক (এফপিআই)। দেশের অনেক মন্ত্রী, এমপি, বড় বড় অফিসার পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের এসব কর্মীদের স্বাস্থ্য কর্মী বলে থাকেন। যে কারণে এফপিআই ও এফডাব্লিউ-এ গণের কাজ নিয়ে কিছু আলোকপাত করা আবশ্যক। বর্তমানে তাদের কাজের পরিধি অনেক বেড়েছে। একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী প্রথমে, তার ইউনিটের দম্পতি, নবজাতক, ৫ বছর বয়সী শিশু, কিশোর, কিশোরী, গর্ভবতী, জন্ম-মৃত্যু, পদ্ধতিভিত্তিক দম্পতির তালিকা তৈরি, খানার জনসংখ্যা সহ প্রতিটি পরিবারের যাবতীয় তথ্যাদি অধিদপ্তরের প্রদত্ত রেজিস্টারে রেজিস্টেশন করতে হয়। এ রেজিষ্টার ২০২০ সাল পর্যন্ত নবম সংস্করণ করা হয়েছে। বর্তমানে ডিজিটাল পদ্ধতিতে (ট্যাবের মাধ্যমে) ই-রেজিস্টেশন করা হচ্ছে। শনিবার সরকারি বন্ধ থাকলেও স্বাস্থ্য বিভাগের কমিউনিটি ক্লিনিক খোলা থাকায় এফপিআই ও এফডাব্লিউ-এ এদিন ছুটি ভোগ করতে পারেন না। এফডাব্লিউ-এ গণ সপ্তাহে তিন দিন কমিউনিটি ক্লিনিক, স্যাটেলাইট, ইপিআই উপজেলায় মিটিং ঔষধ গ্রহণ, স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী ক্যাম্পে রোগী নিয়ে যোগদান সহ অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। গর্ভবতী ও কিশোরীদের টি.টি টিকা, গর্ভবতীদের ৪ বার চেকআপ, প্রতিষ্ঠানিক ডেলিভারির জন্য দম্পতিদের পরামর্শ, কেন্দ্রে আনা এবং ডেলিভারীর পরও বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়। যেসব এফডাব্লিউ-এ গণ ইতিপূর্বে ৬ মাসের সিএসবিএ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত তারা নরমাল ডেলিভারি করে যাচ্ছেন। গত মার্চ মাস থেকে করোনা ভাইরাস কালীন সময়ে এসব কর্মীরা শত শত নরমাল ডেলিভারী করে দেশে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সুনাম বৃদ্ধি করে সাফল্যের নজির স্থাপন করেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, এফডাব্লিউ-এ দের সরকারীভাবে একটি রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, আয়রন বা ভিটামিন সহ মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার কোন ঔষধ দেওয়া হয় না। সামান্য রক্ত চাপ মাপতে হলে একজন কর্মী তার দম্পতিকে নিয়ে কাঁদা পানি ভেঙ্গে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে ভিজিটার, ফার্মেসী কিংবা ডাক্তারের নিকট নিয়ে যেতে হয়। বয়সন্ধিকালীন সময়ে কিশোরীদের আয়রন ট্যাবলেটের খুবি প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ ট্যাবলেটটিও তাদের হাতে দেওয়া হয় না। ২৪/৭ নামে একটি ডেলিভারী প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। এতে এফডাব্লিউএ ও এফপিআইদের ঐক্যের কোন বিকল্প নেই।
লেখক, কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক