বজ্রপাতে সিলেট ও সুনামগঞ্জে কঠোর আঘাতের কারন

জাতীয় সারাদেশ সিলেট সুনামগঞ্জ
শেয়ার করুন

এএইচএম ফিরোজ আলী

বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ অন্যতম বৃহৎ একটি ব-দ্বীপ-অঞ্চল। ভৌগলিক কারনে প্রাকৃতিক দূর্যোগ বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জ¦লোচ্ছাস, ভূমিকম্প, শিলাবৃষ্টি ও এসিডবৃষ্টি, জোয়ারভাট আসের্নিক, লবনাক্ততা এদেশের মানুষের নিত্য সঙ্গী। এসব দুর্যোগে লাখ লাখ মানুষের জীবন, সম্পদ ও সভ্যতা ধ্বংস করেছে। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, ১৫৮৪সালে বাকেরগঞ্জে ঘূণিঝড়ে ২লাখ মানুষ, ১৮২২সালের ৬জুন ও ১৮৭৫সালে ভোলায় ২০হাজার মানুষের মৃত্যু ও সম্পদের ক্ষতি হয়েছিল। ১৯১৯সালে বরিশালে ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে ৪০হাজার, ১৯২৫সালে বরিশাল ও নোয়াখালিতে ৭হাজার, ১৯৫০সালে সুন্দরবনে ৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়ে ছিলেন। ১৯৭০সালের ১০নভেম্বর রাতে বরিশাল, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, বরগুনাসহ উপকূল অঞ্চলে দেড়শ মাইল বেগে ২০-৩০ফুট উচ্চ পানির জ¦লোচ্ছাসে লাশের অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তান সরকারের কেউ দেখতে আসেনি এবং এক ছটাক ত্রাণ সামগ্রীও পাঠায়নি। ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু নির্বাচন ফেলে তোফায়েল আহমদসহ দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গিয়ে ত্রাণ তৎপরতা ও লাশ দাফন শুরু করেন। ১৯৯১সালের ২৯এপ্রিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় ২৫০কিলোমিটার বেগে আসা ঘূর্ণিঝড় ও ২০ফুট উচ্চতা জলোচ্ছাসে ১লাখ ৩৮হাজার মানুষের প্রাণহানি ও  ১কোটি লোক সর্বস্ব হারিয়ে ছিলেন।

সাম্প্রতিকালে বিশ্ব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাসে বজ্রপাত একটি ভয়াবহ ও ভয়ংকর দূর্যোগ। বজ্রপাতের মুল কারন হচ্ছে, বায়ু দূষণ।  পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ৮০লাখেরও বেশি বজ্রপাত সৃষ্টি হয়। জলবায়ূ পরিবর্তন জনিত কারণে বিশে^র বজ্রপাত এখন ভয়ংকর। বিশে^র সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়, ভেনিজুয়েলার মারাকাকাইবো হৃদে ও আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকায়। বাংলাদেশে বিনামেঘে বজ্রপাতও হয়। ভুটানে প্রতিবছর ৩শ দিন বজ্রপাত হয়। ভারতে ২০২১সালে ৭৮৭ ও ২০২২সালে ৯০৭জন বজ্রপাতে মারা যান। ভারতের আবহাওয়া দপ্তর ‘দামিনী’ নামে একটি অ্যাপ চালু করে বজ্রপাতের ৪০মিনিট আগে কোন এলাকায় বজ্রপাত হবে, তা জানিয়ে দেয়, এতে মানুষ সতর্ক হন।

বাংলাদেশে সাধারণত: এপ্রিল-মে-জুন মাসে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু চলতি বছর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এক দেড় কেজি ওজনের শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাতের ঘটনায় দেশে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। ২৩এপ্রিল সুনামগঞ্জের ৬টি উপজেলায় ৯জন, ২৭এপ্রিল ৮জন, বিশ্বনাথে ২জন এবং কানাইঘাটের ১জন মসজিদের ইমাম বজ্রপাতে মারা যান। ২০২০-২০২৩ সাল সময়ে সুনামগঞ্জে ৬৪জন বজ্রপাতে মারা যান। ২০১৪-২০২০ ৭বছরে বাংলাদেশে বজ্রপাত হয়েছে ৩১লাখ ৩৬হাজার ৬৩৬টি। ২০১৫-২০২১ সাত বছরে বজ্রপাতে মৃত্যু হয় ১হাজার ৭৯২জনের। বিবিসিবাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের ৪আগষ্ট চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ইউনিয়নের মামুন নামের এক ছেলের বিয়েতে যাওয়ার পথে বরযাত্রীরা পদ্মা নদীর খেয়া ঘাটে যাওয়ার পর বজ্রপাত শুরু হলে নদীর ঘাটের দু’চালা টিনের ঘরে আশ্রয় নিলে বজ্রপাতের প্রচন্ড আঘাতে ১৭জন বরযাত্রী প্রাণ হারান। এ ঘটনা বিশ^ মিডিয়া ও নেট দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করে।

২০১১সালের পর থেকে বজ্রপাতের তীব্রতা চরম বেড়ে যায়। ১৯৮১সালে বজ্রপাত ছিল মাত্র ৯দিন, ২০১৫সালে ১৫দিন, ২০১০-২০১৫ সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। ২০১৬সালের মে পর্যন্ত ২৬টি জেলায় ৮১জন নারী-পুরুষ বজ্রপাতে মৃত্যু হওয়ায় বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দূর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা  হয়। চলতি বছর ২৩দিনের তাপমাত্র ২০১৯সালের পুরো বছরের সমান। গত ৩০বছরে ৪-৫ডিগ্রি তাপমাত্রা দেশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, বুয়েট, আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বাতাসে সীসার পরিমাণ বেশি, জন-জীবনে ধাতব পদার্থের ব্যাপক ব্যবহার, মোবাইল ফোনের টাওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি, বন ভূমি উজাড়, উঁচু তাল, নারিকেল, সুপারি ও বট গাছ কমে যাওয়া, পানির উৎস জলাভূমি ভরাট, কলকারখানার ধোয়া, পলিথিন জনিত ব্যাগে নদী নালায় বিষাক্ত ও ময়লা পানি মিশে বাতাসে কালো মেঘ তৈরীতে বজ্রপাতের তীব্রতার অন্যতম কারণ। বুয়েটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বিশ্ব বিখ্যাত সায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধের বরাত দিয়ে বলেছেন, তাপমাত্রা ১ডিগ্রি বাড়লে, বজ্রপাত বাড়ে ১২শতাংশ। তাঁর মতে, বজ্রপাত প্রচন্ড শব্দে নিচ দিকে নেমে আসে এবং মাটিতে পড়ার আগে উঁচু গাছ গুলোতে পড়ে যেত। এখন দেশের কোথায় এধরনের বজ্রপাত প্রতিরোধের বৃক্ষ নেই। আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪০টির মতো বজ্রপাত আঘাত করে। কালো মেঘ সৃষ্টির পেছনে বাতাসে নাইট্টোজেন ও সালফারের পরিমাণ বেশিকে দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা। আমাদের দেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও উত্তরে হিমালয় পর্বত দন্ডায়মান। সুর্যের তাপে সাগরের পানি উষ্ণ ও আদ্র হয়ে উত্তর দিকে এবং হিমালয়ের শীতল বাতাস দক্ষিণ দিকে এসে বিষাক্ত কালো মেঘের সাথে ঘর্ষনের ফলে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। সিলেট, সুনামগঞ্জ হিমালয়ের সন্নিকটে হওয়ার কারণে এখানে বজ্রপাতের আক্রমণ বেশি।

অষ্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসর ও জলবায়ু বিজ্ঞানী আশরাফ দেওয়ান, নাসার ১৭বছরের (১৯৯৮-২০১৪) এবং ফিনিস কোম্পানির ভাইসালার (২০১৫-২০২০) তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশের বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলেছেন, মার্চ-এপ্রিল-মে হাওর অঞ্চল সুনামগঞ্জ-সিলেট-মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ এবং নেত্রকোনায় বজ্রপাত হয় বেশি। মৌসুমি সময়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জ-ফরিদপুর-মাদারিপুর-মানিকগঞ্জ-টাঙ্গাইল- গোপালগঞ্জ-বরিশাল-রংপুর-পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামে। অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে বজ্রপাত হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম-নোয়াখালি ও কক্সবাজারে। শীতকালে বজ্রপাত হয় খুলনা-পটোয়াখালি ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে। তাঁর মতে ২০১০-২০২০ সময়ে বজ্রপাতে মারা গেছেন ১হাজার ৮৭৮জন এবং এরমধ্যে ৭২শতাংশ কৃষক। এ বিজ্ঞানির মতে, বজ্রপাত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ এ দুই ধরণের আঘাত করে থাকে। বেশি মানুষ মারা যান পরোক্ষ আঘাতের কারণে। তিনি বলেছেন, বজ্রপাত যখন নিচের দিকে পড়ে, তখন প্রায় ৩কিলোমিটার এরিয়ায় আঘাত করলে পুরো এলাকা বিদ্যুতায়িত হয়ে যায় এবং এ এলাকায় মানুষ বা কোন প্রাণী থাকলে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। একে তিনি বলেছেন, ভূমি বিদ্যুতায়ন। তাঁর মতে এ বজ্রপাত পরোক্ষ বজ্রপাত। এ বিজ্ঞানীর গবেষণা বলছে, বজ্রপাতের সময় কেউ গাছের নিচে আশ্রয় নিলে এবং বজ্রপাত গাছের উপরে পড়লে বিদ্যুতের কিছু অংশ ঐ ব্যক্তির শরীরে পরিবাহিত হয়ে মুত্যু হয়। বজ্রপাতের সময় মানুষ পানিতে থাকলে বাঁচার সম্ভাবনা একেবারে কম। তাঁর পরামর্শ বজ্রপাতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাথে সাথে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে।

নাসার বিজ্ঞানী ও মেরিল্যান্ড বিশ্ব বিদ্যালয়ে গবেষণা টিমের প্রধান স্টিভ গডম্যান্ড বলেছেন, সুনামগঞ্জে প্রতি তিন মাসে প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ২৫টির বেশি বজ্রপাত হয়। হিমালয়ের পাদদেশে থাকায় মেঘে মেঘে ঘর্ষনের ফলে সুনামগঞ্জে বজ্রপাত হয় সবচেয়ে বেশি। ২০২০-২৩ সময়ে সুনামগঞ্জে ৬১জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। এ জেলার ৬টি উপজেলায় ১কোটি ৪৪লাখ টাকা ব্যয়ে ২৪টি বজ্র নিরোধ যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। ভারতের আবহাওয়া অফিসের রাডার থেকে প্রাপ্ত ও জাপানের মহাকাশ সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বছর আড়াই হাজার বজ্রপাত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শতগুণ বেশি বজ্রপাত হলে সেখানে মৃত্যু হয় মাত্র ৪০-৫০জন। যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েথনামসহ অনেক দেশে কার্যকর পদক্ষেপের কারণে ৯০শতাংশ কমে যায় বজ্রপাত। সরকার বজ্রপাত প্রতিরোধে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ১ কোটি তাল গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নিয়ে ৩৮ লাখ লাগানোর পর দেখা যায়, পরিচর্চার অভাবে এসব গাছ নষ্ট হয়ে গেছে এবং ৪০-৫০ বছরেও তাল গাছ বৃদ্ধি পায় না। পরে নাইটিংডিটেকশন সেন্টার বসানো ও বজ্রনিরোধ দন্ড বসানোর নামে আমলাতন্ত্রের উচ্চবিলাসী প্রকল্প নিয়ে শত শত কোটি টাকার লুটপাটের কাহিনী এখন গণমাধ্যমে। এসব অর্থ অপচয় না করে পুরো দেশে গণসচেতনার জোয়ার সৃষ্টি করা হলে, বজ্রপাত প্রতিরোধ না করতে পারলেও সচেতনতাই মানুষকে বজ্রপাত থেকে অনেকাংশ রক্ষাথে ভূমিকা রাখবে।

বজ্রপাত থেকে বাঁচতে হলে একমাত্র গণসচেনতাই সৃষ্টি করতে হবে। বজ্রপাতের সময় পাকা ভবনের নিচে আশ্রয় নিতে হবে, উঁচু গাছ বা বিদ্যুতের খুটির নিচে থাকা যাবেনা। বাসা-বাড়ির জানালা বন্ধ রেখে দূরে থাকতে হবে। বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্র মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, টিভি, ফ্রিজ, ল্যান্ডফোনসহ ধাতব বস্তু স্পশ করা যাবেনা। বাসা-বাড়ীর সকল বৈদেতিক প্লাগ খুলে রাখতে হবে। গাড়ির ভেতরে থাকা যাবে না, কোন কারণে থাকলে দরজা জানালা বন্ধ করতে হবে। পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। আকাশে কালো মেঘ বা প্রচন্ড গুড় গুড় শব্দ শুনলে ঘর থেকে বের না হওয়া বা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়া আবশ্যক। বজ্রপাতের সময় শিশুরা মাঠে খেলাধুলা করতে পারবে না। হাওরে মাছ ধরা, হালচাষ করা বা ধান কাটার সময় বজ্রপাতের কবলে পড়লে শুকনো জায়গায় নিঁচু হয়ে, পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর করে দুই কান চেপে ধরে বসে থাকতে হবে। বজ্রপাতের বিষয়গুলো গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা, মোবাইলের মাধ্যমে বজ্রপাতের বার্তা প্রেরণ, স্থানীয় প্রশাসন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভাপৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি মসজিদের ইমাম শিক্ষা প্রতিষ্টানের প্রধান ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি লক্ষে সভা সমাবেশ, সেমিনারের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

লেখক,

কলামিষ্ট ও সমাজবিশ্লেষক


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *