চাউলধনী হাওরের সমস্যা, সম্ভাবনা ও সমাধানের উপায়

Uncategorized
শেয়ার করুন

এএইচএম ফিরোজ আলী:: খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুরের দেশ, বাংলাদেশ। এ দেশে এক সময় ছিল, গোয়াল ভরা গরু, গোয়ালা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ। আমরা ছিলাম মাছে ভাতে, দুধে ভাতে বাঙালি। সেই চিত্র এখন যাদুঘরেও নেই। খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর ভরাট হচ্ছে। সরকারি জলাশয় ভূমিদস্যুদের দখলে। দেশে সরকারিভাবে কিছু কিছু খাল, বিল, নদী, নালা খনন হচ্ছে। গরিব, অসহায় মৎস্যজীবীদের জীবনমান উন্নয়নে ‘জাল যার, জলা তার, নীতিতে সরকার মৎস্যজীবীদের ভূমি বন্দোবস্ত দিচ্ছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশে ব্যাপক হারে মৎস্য উৎপাদন হচ্ছে।

সিলেটের যে বড় বড় কয়েকটি হাওর রয়েছে, তার মধ্যে বিশ্বনাথ উপজেলার চাউলধনী হাওরটি অন্যতম। ‘চাউলধনী হাওরের’ নামেই হাওরটির গুরুত্ব বুঝা যায়। চাউলধনী হাওরে প্রচুর ধান উৎপন্ন হয়, বিধায়, তার নামকরণ হয়েছে চাউলধনী হাওর। কথিত আছে, সমগ্র বাংলাদেশের তিনদিনের খাদ্য উৎপন্ন হয় এ হাওরে। এই হাওরে পরিস্কার ও স্বচ্ছ পানি থাকায় কয়েক ফুট গভীর পর্যন্ত মাছ, কচ্ছপসহ জলজ প্রাণীর বিচরণ দেখতে পাওয়া যায়। কচুরিপনা ও হরেক রকম শাপলা গাছের পাতা ও ফুলের উপর পানকুড়ি, ডাউক, কোড়া, সাদাবক, লালবক, কানাবক ও ঝাকে ঝাকে শীতকালীন হাসসহ অতিথি পাখিদের আগমন ছিল লক্ষ্যনীয়। এই হাওরে যেন মনোমুগ্ধকর অন্য রকম পরিবেশ। হাওরটির মিটাপানির মাছ, জীববৈচিত্র, নানা রঙের শত প্রজাতির পাখির জন্য বিখ্যাত। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এ হাওরের মাছের সুনাম ও খ্যাতি রয়েছে। বিদেশের মাঠিতে এই হাওরের মাছ ও শুটকির কদর বেশি। শীতকালে হাজার হাজার অতিথি পাখির আগমণে এই অঞ্চল মুখরিত হয়ে উঠে। এ সময় অনেক সৌখিন প্রবাসী মাছ শিকারের জন্য দেশে চলে আসেন। হাজার হাজার ডলার, পাউন্ড আয় হতো এ হাওরের মাছ ও শুটকি রপ্তানী করে। গ্রামের ও প্রবাসীদের ছেলে সন্তানরা সখ করে সাতাঁর কাটতেন এবং নৌকা নিয়ে হাওরে ঘুরতেন। সর্বাবস্থায় হাওরে ভাসমান মাছ ধরে হাজার হাজার মৎস্যজীবি ও কৃষকরা ফসল উৎপাদন করে সুখী জীবন যাপন করতেন।
১৯৭৭ সালে জাতীয় একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয় কলামে চাউলধনী হাওরের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে এডিবির প্রকল্পে আওতাভুক্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ২৩ এপ্রিল ‘দৈনিক সিলেটের ডাক’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, ‘চাউলধনী হাওরের ৩০ হাজার একর জমির ইরি-বোরো ফসল রক্ষায় স্থায়ী ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ফসলহানী ঘটে এবং এলাকার ৪০টি গ্রামের কৃষি ও মৎস্যজীবী মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাপন করছেন। এতে বলা হয়, পানি উন্নয়ন বোড একটি প্রকল্প তৈরী করে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করলে অনুমোদন হয়নি। বিদেশী একটি দাতা সংস্থা অর্থায়ন না করায় প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। সম্পাদকীয়তে ৩০ হাজার একর জমির ফসল, জীব বৈচিত্র রক্ষার দাবী জানানো হয়েছিল।’ একজন কলম সৈনিক হিসেবে যতটুকু স্মরণ হচ্ছে, চাউলধনী হাওরের জীববৈচিত্র, মিটা পানির মাছ ও ফসল রক্ষায় এডিবির কর্মকর্তারা ও পানি উন্নয়ন বোডের কর্মকর্তারা কয়েকদফা হাওর পরিদর্শন করে ছিলেন। কিন্তু পরে প্রকল্পটির আর কোন অগ্রগতি হয়নি।
গত তিন যুগ ধরে জলদস্যুদের হাতে হাওরটি জিম্মি রয়েছে। অর্ধশত বছর ধরে হাওরের খাল-বিল, নালা, পুকুর, ছোট নদী খনন না করায় শীতকালে এ হাওরে একেবারে পানি কমে যায় এবং ভূমি ফেটে চৌচির হয়। ফলে ইরি-বোরো ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। যতটুকু পানি বাধ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়, সেই পানি হাওরের ইজারাদার সেচ দিয়ে শুকিয়ে ফসলের ক্ষতি ও মাছের বংশ ধ্বংস করে থাকে। হাওরে বর্তমানে অনুমান ১০ হাজার একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ১৭৮.৯৮ একর সরকারি খাস জলাশয়। প্রায় দশ বছর ধরে ‘দশঘর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ’ একজন প্রবাসীকে সাবলীজ দিয়ে প্রায় ত্রিশ-পয়ত্রিশটি গ্রামের কৃষক ও মৎস্যজীবীদের হয়রানী করছে। ০৪/০২/২০১৬ইং তারিখে মৎস্যজীবী সমিতি প্রবাসী সাইফুল আলম, আব্দুল কাদির, শাহিন উদ্দিনের নামে সাবলীজ দেয়। এই সমিতির সভ্য এলাকা শুধু দশঘর ইউনিয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও দৌলতপুর ইউনিয়নের ৫জন মহিলাকে বেআইনিভাবে সদস্য করা হয়। স্থানীয় চেয়ারম্যানের প্রত্যয়ন অনুযায়ী এরা কিন্তু পেশায় মৎস্যজীবী নয়।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০০৯ সালের ২৫ জুন প্রকাশিত গেজেটের ৪এর (ঢ) তে বলা হয়েছে ‘লীজকৃত জলমহাল কোন অবস্থাতেই সাবলীজ অথবা অন্য কোন ব্যক্তি/গোষ্ঠিকে হস্তান্তর করতে পারবে না এবং অন্যকোন উপায়ে তা ব্যবহার করতে পারবে না, যদি করে থাকে, জেলা প্রশাসক উক্ত লীজ বাতিল করে দিবেন এবং জমাকৃত লীজ মানি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করবেন’। (ঞ) তে বলা হয়েছে, তথ্য গোপন করা কিংবা অন্য কোন অনিয়মের কারণে জলমহালের লীজ বাতিল করা হলে পূণরায় যথানিয়মে লীজ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কিন্তু বাস্তবে সাবলীজ গ্রহিতা যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাইফুল কৃষকদের পুকুর খাল জলাশয় দখল করে জোরপূর্বক মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মাছ উৎপাদনের বছর পানি সেচ না দেয়ার বিধিনিষেধ থাকলেও সেচ দিয়ে মাছ ধরে মাছের বংশ বিনষ্ট করছে। চলতি বছর পানি সেচ দিয়ে হাওর শুকিয়ে দেয়ায় ইরি-বোরো ফসল উৎপাদন না হওয়ায় শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পানি সেচে বাধা দেয়ায় গত ২৮ জানুয়ারি কৃষক ছরকুম আলী দয়ালকে তার জমিতে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দয়ালের ভাতিজা আহমদ আলী বাদী হয়ে বিশ্বনাথ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। (মামলা নং-৩, তারিখ-০২-০২-২০২১ইং)। এ ঘটনার তিনমাস পর গত ১ মে স্কুলছাত্র সুমেলকে সাইফুল ও তার বাহিনী বন্ধুক দিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় সুমেলের চাচা ইব্রাহিম আলী সিজিল বাদী হয়ে সাইফুলকে প্রধান আসামী করে বিশ্বনাথ থানায় আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। (মামলা নং-৪, তারিখ- ০৩/০৫/২০২১ইং)। এ হত্যাকান্ডের কারণে গত ৯মাস ধরে এলাকায় এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এখনও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত বৈধ, অবৈধ কোন অস্ত্র উদ্ধার করা হয়নি বা লীজও বাতিল করা হয়নি।
ুজানা গেছে, গত ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর সুমেল হত্যাকান্ডের আসামী মধ্যে ২০ জন উচ্চ আদালতে আত্মসমর্পন করে। এর মধ্যে ১৫ জন ৬ সপ্তাহের জামিন এবং ৫ জন ৪ সপ্তাহের মধ্যে নিম্ন আদালতে সারেন্ডারের আদেশ দিয়েছেন আদালত। আসামীরা এলাকায় এসে বাদী, স্বাক্ষীদের প্রাণে হত্যার হুমকি ও গুলযোগ সৃষ্টি করার পায়তারা করছে। সুমেল হত্যা মামলার বাদী ইব্রাহিম আলী সিজিল ও স্বাক্ষী নজির উদ্দিন জানমালের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় পৃথক পৃথক সাধারণ ডায়েরী করেছন। সাধারণ মানুষজন এখন আতংকিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় কঠোর নজরদারী রাখছে বলে বিশ্বনাথ থানার ওসি গাজী আতাউর রহমান জানিয়েছেন। হাওর পারের মানুষের অভিযোগ বিশ্বনাথ উপজেলা মৎস্য ও সমবায় কর্মকর্তা হাওরটি ধ্বংসের জন্য দায়ী। তাদের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে অভিযোগও দায়ের করেছেন।
চাউলধনী হাওরের মুল সমস্যা হচ্ছে, কৃষকদের জমির সাথে সরকারি জমির সীমানা নির্ধারণ না করা। অবশ্য কৃষকদের পক্ষে চাউলধনী হাওর রক্ষা ও কৃষক বাঁচাও আন্দোলন কমিটির আহবায়ক, বিশ্বনাথ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবুল কালাম মহামান্য হাইকোর্টে ৫৩৩১/২০২১ রীট পিটিশনটি দায়ের করলে মহামান্য হাইকোট সীমানা নির্ধারনের আদেশ দিয়েছেন। দশঘর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ এর রেজিষ্ট্রেশন বাতিল করে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের দিয়ে সমিতি করে হাওরটি লীজ দেয়া হলে সরকার যেমন রাজস্ব পাবে, তেমনি মৎস্যজীবীদের জীবন মানের অনেক উন্নতি হবে। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের মত সরকারিভাবে চাউলধনী হাওর থেকে দেশীয় মাছ উৎপাদন, জীববৈচিত্র রক্ষায় অভেয়ারণ্য ঘোষণা করলে হাওরটি একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের স্পট হিসেবে দেশে বিদেশে পরিচিতি লাভ করবে। হাওরের চতুরপারে প্রায় ৩০/৩৫টি গ্রামে বন-জঙ্গল, বাশঁ, বেত, ঝুপসহ বড় বড় লম্বা গাছগাছালি রয়েছে। এতে পাখিদের বংশ বৃদ্ধিতে অনেক সহায়ক হবে। এ অঞ্চলের কৃষক ও মৎস্যজীবীদের আয় বৃদ্ধি পাবে। জলদস্যুদের হাত থেকে হাওরটি রক্ষা করলে পরিবেশ রক্ষায় হাওরটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রতি বছর শীতকালে শতাধিক প্রজাতির পাখির আগমন ঘটবে এবং হাওরটি তার হারিয়ে যাওয়া রূপ ফিরে পাবে।
লেখক : কলামিস্ট।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *