স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের অর্জনে উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার তিন সূচকেই বেঁধে দেওয়া সময়ের আগেই লক্ষ্য অর্জন করে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ।প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্পের উৎপাদন সচল থাকা, কর্মসংস্থান এবং বড় বড় প্রকল্পের অবকাঠামো উন্নয়ন অব্যাহত থাকায় অর্থনীতির স্পর্শকাতর সূচকগুলো শক্ত অবস্থানে রয়েছে। আর এ কারণেই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ পেয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে জাতিসংঘের নীতিমালা অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। নিয়ম অনুযায়ী পরপর দুইবার ত্রি-বার্ষিক পর্যালোচনায় অবস্থান ধরে রাখতে হয়। সে অনুযায়ী দ্বিতীয় দফার ত্রি-বার্ষিক পর্যালোচনায় আগের অবস্থার ধরে রাখাই নয় বরং আরো উন্নতি করেছে। শুক্রবার রাতে দ্বিতীয় দফায় পর্যালোচনার পর চূড়ান্ত সুপারিশ করে জাতিসংঘ। রেয়াতি সময় পাঁচ বছর ধরে আগামী ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। এই পাঁচ বছর উন্নয়নশীল দেশ হলেও স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধাভোগ করবে। এই অবস্থায় অর্থনীতি আরো গতিশীল করার প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পিটিএ এবং এফটিএ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, বাণিজ্য ও রাজনীতিতে আসবে পরিবর্তন, বাড়বে প্রতিযোগিতার সক্ষমতাও। আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন জোর দিতে হবে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে।
ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর সুফল অনেক। বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন মেরুকরণ ঘটবে। এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে এসব বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নিয়মিত হারে শুল্ক বসবে। তবে এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হবে রপ্তানি খাতে। পাশাপাশি বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে বাংলাদেশের। এজন্য এই বিষয়কেন্দ্রিক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, এ অর্জন সরকারের পরিকল্পিত উন্নয়নের ফসল। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২১ সাল অর্থাৎ স্বাধীনতার ৫০ বছরকে সামনে রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজানো হয় এবং সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সে অনুযায়ী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কঠিন হবে না। তবে পরিকল্পনাগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন দরকার।
অর্থনীতিবিদ ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, আমরা দুবছর সময় পেয়েছি, পারতো পক্ষে তিন বছরের মধ্যে হয়ে যেত। এখন আমাদের যেটা করতে হবে, উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো, শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো, টেকনোলজি বাড়ানো। তিনি বলেন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যে ধারাবাহিকতা সেটার একটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটা স্বীকৃতি হলো।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন ও বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এলডিসি উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরব ও সম্মানের। করোনা পরিস্থিতির কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নানামুখী চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছে। এরপরও বাংলাদেশ যথাসময়ে এলডিসি গ্রাজুয়েশন করবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই সোনার বাংলা গড়ার কাজ করছেন তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ এখন আর স্বল্পোন্নত দেশ নয়। উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা নিয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
বর্তমানে এলডিসিভুক্ত হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাজ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের মোট রপ্তানির ৬০ থেকে ৬৪ শতাংশ ইউরোপের বাজারে। কিন্তু এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটার পর এসব দেশ ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের বিদ্যমান সুবিধা তুলে নেবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উত্তরণ-পরবর্তী সর্বোচ্চ তিন বছর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য ও ইইউ ২০২৯ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এরপরই বাংলাদেশের এসব দেশে পণ্য পাঠাতে হলে হয় বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে, অন্যথায় অতিরিক্ত শুল্ক দিয়ে পণ্য প্রবেশ করাতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এনজিও থেকে অনুদান আসার পরিমাণ কমে যাবে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। এই স্বীকৃতির ফলে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশকিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। আবার কিছু চ্যালেঞ্জও আসবে। চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের প্রতিষ্ঠা পেতে বাংলাদেশের সামনে যে সময় রয়েছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়টিকে প্রস্তুতিকাল হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এই সময়ের পর বৈদেশিক ঋণ, সাহায্য এবং শুল্ক রেয়াতের মতো অনেক সুবিধা থাকবে না। এ কারণে বাণিজ্য প্রতিযোগিতার সক্ষমতা থাকতে হবে। তিনি বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে পোশাকশিল্প আজ এই সুদৃঢ় অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। যদিও আগামী পাঁচ বছর প্রস্তুতকালীন হিসেবে এই সুবিধা পাওয়া যাবে, তবে এরপর যখন আর এই সুবিধা থাকবে না তখন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে রপ্তানি শিল্পগুলোকে।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের মাধ্যমে বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। এর মাধ্যমে মানব উন্নয়নের অগ্রগতির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলো বাংলাদেশ। ফলে পুঁজিবাজারসহ দেশের অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা আছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে বিদেশিরা স্বস্তিবোধ করবে। বিপরীত দিকে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আমরা যে বৈদেশিক সহায়তা পাই তার সুদ হার বাড়বে। শুল্ক মুক্ত রপ্তানি সুবিধা থাকবে না। ফলে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্য করতে হবে। তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য কাজ করতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) প্রফেসর শামসুল আলম বলেন, বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সিদ্ধান্ত দিয়েছে সিডিপি। তবে প্রস্তুতিপর্বের সময় দুই বছর বাড়ানো হয় কিনা, সে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি। এটি হলে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পরও ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাণিজ্য সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এমন একটি সময়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ পেতে চলেছে, যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করছে জাতি।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘ ১৯৭১ সালে কিছু নির্ণায়কের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের সবচেয়ে কম উন্নত দেশগুলোকে স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি হিসেবে পৃথকভাবে শ্রেণিবদ্ধ করে। ১৯৭১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের সংখ্যা ছিল ২৫, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৪৬-এ। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে এ পর্যন্ত বতসোয়ানা, কেপভার্দে, মালদ্বীপ, সামোয়া, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ও ভানুয়াতু উত্তরণ ঘটাতে পেরেছে।