ইউনূস-বাইডেন বৈঠক নিয়ে ‘আশাবাদের সুর’

আন্তর্জাতিক জাতীয় সারাদেশ
শেয়ার করুন

অনলাইন ডেস্ক :: ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেড় মাস পার করেছে। এই সময়ে দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্ট নানা জটিলতায় কিছুটা বেকায়দায় আছে সরকার। পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আঞ্চলিকভাবে কিছুটা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে ইউনূসের সরকারকে। 

এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে সোমবার যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন তিনি। নিউইয়র্কে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ পাওয়া কিছুটা বিরল ঘটনা। ড. ইউনূস নোবেল লরেট হওয়ায় এবং বৈশ্বিকভাবে পরিচিত মুখ হওয়ায় এ সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সব ঠিক থাকলে নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ইউনূস-বাইডেন বৈঠকে বসবেন। স্বাভাবিকভাবে বৈঠকে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হবে। পাশাপাশি আঞ্চলিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকার যে প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছে, সেটি নিয়ে বাইডেনের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন ড. ইউনূস।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার এক কূটনীতিক বলেন, নিউইয়র্কে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ পাওয়া বিরল ঘটনা। যদি পাওয়া যায় সেটি হবে এক্সক্লুসিভ। সব ঠিক থাকলে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির গণমাধ্যমকে বলেন, সাধারণত দ্বিপাক্ষিক বা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকগুলো ওয়াশিংটনে হওয়ার কথা। নিউইয়র্ক-তো মাল্টিলেটারাল (বহুপাক্ষিক), কাজেই এখানে সচরাচর এ ধরনের বৈঠক হয় না। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক নিউইয়র্কে হলে এটা আমাদের জন্য ‘উল্লেখযোগ্য’ একটা ঘটনা হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন টানা চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার পতনের পর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সরকার গঠনের পর প্রথম বিদেশ সফরে সোমবার রাতে নিউইয়র্কের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে ড. ইউনূসের।

দায়িত্ব নেওয়ার পর গত দেড় মাসে কমবেশি প্রতিদিন কোনো না কোনো ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে ড. ইউনূসকে। বিশেষ করে, আইনশৃঙ্খলা ইস্যুতে বেশ বেকায়দায় রয়েছে সরকার। নতুন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিরতা বেশ বেকায়দায় ফেলেছে সরকারকে।

অভ্যন্তরীণ ইস্যু ছাড়াও অন্তর্বর্তী সরকার আঞ্চলিক কিছু ইস্যুতেও চাপের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে সরকারকে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে রয়েছেন। শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ইস্যু, সীমান্ত হত্যা, পানি ব্যবস্থাপনা, ইলিশ রপ্তানি, বাংলাদেশি নাগরিকদের ভারতীয় ভিসা না দেওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে নানা তর্ক-বিতর্ক চলছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় ভারতীয় গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন কিংবা রং লাগানো সংবাদও ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

শুধু তাই নয়, দুই দেশের দায়িত্বশীলদের বক্তব্যও সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার দুদিন আগে ভারতীয় চ্যানেল এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেছিলেন, আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলেন, তাহলে সেই অস্থিরতার আঁচ কিন্তু বাংলাদেশের বাইরে মিয়ানমার, সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গ– সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়বে।

এছাড়া দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির জন্য ভারতকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা।

অন্যদিকে, চলতি মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্য করেছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। রাজনাথ রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরায়েল-হামাস সংঘাত এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে ভারতের সামরিক বাহিনীকে ‘অপ্রত্যাশিত’ ঘটনা মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। রাজনাথের রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরায়েল-হামাসের সঙ্গে বাংলাদেশ মেলানো নিয়ে অবাক হয়েছেন ঢাকার কূটনীতিকরা।

রাজনাথের বক্তব্য ছাপিয়ে এখন আলোচনায় ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বক্তব্য। গত শুক্রবার ঝাড়খণ্ডে এক অনুষ্ঠানে অমিত শাহ বলেছেন, ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে বিজেপি সরকার গড়তে পারলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে সোজা করা হবে।

আঞ্চলিক ইস্যুতে ঢাকার আরেক মাথা ব্যথার কারণ রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার পরিস্থিতি। দিন দিন দাতাগোষ্ঠীর তহবিল কমে আসা এবং ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়তে থাকায় আশ্রিত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে চিন্তা বাড়ছে বাংলাদেশের।

ইউনূস-বাইডেন বৈঠকে এসব আঞ্চলিক সমস্যা, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে আলাপের ভালো সুযোগ দেখছেন বর্তমানে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতির দায়িত্বে থাকা সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।

তিনি বলেন, বৈঠকে যদি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান সংক্ষেপে তুলে ধরা যায় তাহলে শুধু যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজে লাগবে তা নয়। এ অঞ্চলে আমরা এখন যে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছি এটাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার জন্য এ বৈঠক কাজে আসতে পারে।

হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা এখন আঞ্চলিকভাবে প্রতিকূলতার মধ্যে আছি। আমরা অভ্যন্তরীণভাবেও বেশ জটিল অবস্থার মধ্যে আছি। সেদিক থেকে এই বৈঠক খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ থাকলে যেটা হয়, মার্কিন শীর্ষ পর্যায়কে বাংলাদেশের এখনকার প্রেক্ষাপট তুলে ধরা যায় এবং এখনকার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় যেটুকু সমর্থন দরকার সে কথাটা তুলে আনা যায়। এটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মার্কিনিদের একটা ইতিবাচক ভূমিকা আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান বলে আমি মনে করি।

বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি নিউইয়র্কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি, বাহরাইনের ক্রাউন প্রিন্স হামাদ বিন ঈসা আল খালিফা, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক শফ, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েনের সঙ্গে বৈঠক করবেন ড. ইউনূস।

এছাড়া জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক, বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম খান, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক সামান্থা পাওয়ার, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।

আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে ভাষণ দেবেন ড. ইউনূস। ওই দিন রাতে নিউইয়র্ক থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিতে পারেন তিনি।  সুত্র-ইত্তেফাক


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *