ই-কমার্সে প্রতারণা রোধে পেমেন্ট গেটওয়ে সেবার দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই এবার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। দেশের কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের পর গত জুলাই মাসে পেমেন্ট গেটওয়ে (এসক্রো) সিস্টেম চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সিস্টেমের আওতায় তৃৃতীয় পক্ষ হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তৃতীয় পক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া সেই প্রতিষ্ঠানটি ‘চতুর্থ পক্ষ’ করে ফস্টার পেমেন্টস নামে অনুমোদনহীন আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ফস্টার প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে অভিযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এমন অভিযোগের পর প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)কে চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ। এদিকে ফস্টার বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয় বলেও জানা গেছে। অথচ পেমেন্ট গেটওয়ে চালুর আগে থেকেই কোম্পানিটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
অনুমোদনহীন একটি প্রতিষ্ঠান কী করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট গেটওয়ে সেবা কার্যক্রমের দায়িত্ব পেলো তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আছে বলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
এসক্রো সিস্টেম হলো- তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পেমেন্ট গেটওয়ে পদ্ধতি। অর্থাৎ, ক্রেতারা কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে পণ্য অর্ডার করলে তার টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে এসক্রো-তে জমা থাকবে। গ্রাহক পণ্য পেলে এসক্রো থেকে সেই প্রতিষ্ঠানকে টাকা বুঝিয়ে দেবে তৃতীয় পক্ষ। এই সিস্টেমের আওতায় তৃৃতীয় পক্ষ হিসেবে ফস্টারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এখন গ্রাহকের অর্ডার পেমেন্ট ফস্টারের কাছে থাকছে। পণ্য ডেলিভারির পর পেমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাঠানোর কথা ফস্টারের। কিন্তু সম্প্রতি পণ্য ডেলিভারি না দিয়ে গ্রাহককে চেক প্রদানের অভিযোগ উঠে কিউকম সহ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় কিউকম সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সব পেমেন্ট ফস্টারের কাছে আটকে আছে। ফস্টার এখন পর্যন্ত কিউকমের ৩৯৭ কোটি টাকার মোটরসাইকেলের পেমেন্ট আটকে রেখেছে বলে ডিবি সূত্রে জানা গেছে। একইসঙ্গে এসক্রো- তে জমা হওয়া অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে বলে বিএফআইইউ সূত্রে জানা গেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি ঠিক কি পরিমাণ টাকা পাচার করেছে, তা জানতে তদন্ত চলছে সিআইডিতে। এরইমধ্যে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তারা দেশে নেই, তারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে বলেও ধারণা করছে সিআইডি।
ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম মূল্য নেয়ার পরও পণ্য ডেলিভারি না দেয়ার অভিযোগের পর, গত ৪ঠা জুলাই এসক্রো সার্ভিস চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসক্রো সার্ভিস চালু হওয়ার পর থেকেই ফস্টারের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হতে থাকে। গেটওয়ে থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে সময়মতো অর্থ না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
ওদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফস্টার নামে কোনো প্রতিষ্ঠানকে পেমেন্ট গেটওয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়নি বলে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি মানবজমিনকে বলেন, অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংক দায়িত্ব দিয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট হয়ে ফস্টার কাজ করছে। তবে সেই প্রতিষ্ঠানের নাম এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।
এ বিষয়ে কনসাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি (সিসিএস)-এর নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ মানবজমিনকে বলেন, ফস্টারের বিষয়টি একেবারেই বিস্ময়কর ঘটনা। কোনো বিশেষ সিন্ডিকেট ছাড়া এধরনের প্রতারণা করা সম্ভব না। দেশে কোথায়, কী পরিমাণ ট্রানজেকশন হচ্ছে তা প্রতিদিন মনিটরিং হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বড় বড় সব ট্রানজেকশন মনিটরিং করে। এর পরে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স আছে। ফস্টারের মতো একটা প্রতিষ্ঠান কোনো অনুমতি ছাড়াই দেশে একটা পেমেন্ট গেটওয়ে চালাচ্ছে আর সেটা কেউ টের পেলো না- এটা অবিশ্বাস্য। এটা হতেই পারে না। প্রশ্ন হলো, ফস্টারকে কেন এই গেটওয়ে চালাতে দেয়া হলো। কাদের দায়িত্ব ছিল এটা বন্ধ করা। তারা কেন করেনি। এগুলো খুঁজে বের করা দরকার। এখন এই টাকার দায় কে নেবে?
তিনি বলেন, এসক্রো সিস্টেম ভালো কিন্তু আমাদের দেশে যে এসক্রো সিস্টেম করা হয়েছে সেখানে গ্রাহককে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এখানে গ্রাহকের টাকা গেটওয়েতে আটকে থাকবে। মার্চেন্ট পণ্য ডেলিভারির পর গেটওয়ে সেই টাকা দেবে। কিন্তু গ্রাহক যদি পণ্য না পান তাহলে গ্রাহকের টাকা তাকে ফেরত দেয়া উচিত। অথচ আমাদের এসক্রো সিস্টেমে সেটা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অনুমতির শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান না বললে গেটওয়ে টাকা ফেরত দিতে পারবে না।
সূত্র: মানবজমিন