অনলাইন ডেস্ক :: কুরবানির দিন দুপুরের পর থেকে একটা সাধারণ দৃশ্য সকলেরই চোখে পড়ে। কুরবানিদাতার বাড়ির দরজায় একদল মানুষের ভিড়। তাদের কেউ একা এবং কেউ পরিবারসহ। কেউ পেশাদার ভিক্ষুক এবং কেউ গরিব কর্মজীবী, যার নিজের কুরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আজ তারা সবাই এক কাতারে। কুরবানির গোশত সংগ্রহের জন্য তারা দলে দলে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কুরবানিদাতা নিজে বা তার পক্ষ থেকে কোনো লোক তাদের হাতে হাতে এক-দুই টুকরা করে গোশত বিতরণ করছে। হাতে গোশত বিতরণ করছে আর মুখে কাউকে ধমকাচ্ছে, কাউকে বকছে, কাউকে তাড়া করছে এবং কারো উদ্দেশে বিশেষ কোনো মন্তব্য করছে।
এ দৃশ্য কতটা সুখকর? কুরবানি একটি মহান ইবাদত। তার সাথে এ দৃশ্য খাপ খায় কি? কুরবানি করা ওয়াজিব, এর গোশত বিতরণ সুন্নত এবং এর গোশত খাওয়াও সুন্নত। ঈদুল আজহার নামকরণই করা হয়েছে এ মহান ইবাদতটির নামে। আল্লাহ তা‘আলা এ দিন নামায আদায়ের পাশাপাশি কুরবানি করারও হুকুম দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে : সুতরাং তুমি নিজ প্রতিপালকের (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য নামায পড় ও কুরবানি দাও। (সূরা কাউসার : ২)।
প্রথমে নামাযের হুকুম, তারপর কুরবানির। যেন বলা হচ্ছেÑ নামাযের মাধ্যমে প্রথমে আল্লাহর সামনে আত্মনিবেদিত হও, তারপর সে আত্মনিবেদনের নিদর্শনস্বরূপ কুরবানি করো। এজন্যই কুরবানি করতে হয় ঈদের নামায আদায়ের পর, তার আগে নয়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে : কেউ নামায আদায়ের আগে জবেহ করলে সে যেন (নামাযের পর) পুনরায় জবেহ করে। (সহীহ বুখারী : ৫৫৪৯)।
যেহেতু এ জবেহ কেবলই আল্লাহর উদ্দেশে, সে হিসেবে এর গোশত কারও জন্যই খাওয়া জায়েজ হওয়ার কথা ছিল না, কিংবা আর সকলের জন্য খাওয়া জায়েজ হলেও কুরবানিদাতার জন্য খাওয়ার অনুমতি থাকার কথা নয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা বড়ই মেহেরবান। তিনি এটা সকলের জন্যই খাওয়া বৈধ করে দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন : তখন তার গোশত থেকে নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও এবং তাকেও, যে নিজ অভাব প্রকাশ করে। এভাবেই আমি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (সূরা হজ : ১৩৬)।
নবী কারীম (সা.) এক হাদিসে ইরশাদ করেছেন : তোমরা খাও, জমা করে রাখ এবং দান-খয়রাত করো। (সহীহ বুখারী : ৫৫৬৯)। এভাবে কুরবানির গোশত নিজে খাওয়ার এবং অন্যকে খাওয়ানোর জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এ যেন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আতিথেয়তা। সমস্ত মুসলিম এ দিনগুলোতে আল্লাহর মেহমান। তাঁর জন্য নিবেদিত পশুর গোশত তিনি মুসলিমদের জন্য অবারিত করে দিয়েছেন, যাতে তারা তা খেয়ে খেয়ে তাঁর অনুগ্রহের শুকর আদায় করে। আল্লাহ তাআলার জিয়াফত ও আতিথেয়তা গ্রহণ করার মধ্যেই বন্দেগীর মাহাত্ম্য।
কাজেই কুরবানির গোশত খাওয়া উদরপূর্তিমাত্র নয়; বরং এর মধ্যে রয়েছে ইবাদতের মহিমা। আর এর গোশত বিতরণও নয় গরিবের প্রতি করুণা; বরং এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে জিয়াফতের প্রতিনিধিত্ব। কুরবানিদাতা যেন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের মেহমানদারি করছে। তো এটা ইবাদত ছাড়া আর কী? ইবাদত বলেই গোশত বিতরণে এ নিয়মকে মুস্তাহাব করে দেওয়া হয়েছে যে, সবটা গোশত তিন ভাগ করা হবে। তার এক ভাগ নিজেরা খাওয়া হবে, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের দেওয়া হবে আর এক ভাগ দেওয়া হবে গরিব-মিসকীনদের।
সুতরাং স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কুরবানির পশু জবাই, তার গোশত বিতরণ ও গোশত খাওয়া সবটাই ইবাদত। ইবাদত করার দ্বারা আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভ হয় ও বিপুল ছাওয়াব পাওয়া যায়। কুরবানির আদ্যোপান্ত যখন ইবাদত, তখন এর দ্বারাও আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি ও ছাওয়াব অর্জিত হবে বৈ কি। তা হবে কুরবানির পশু জবেহ করার দ্বারা, তার গোশত খাওয়ার দ্বারা এবং গোশত বিতরণ করার দ্বারা। তা কত এর ছাওয়াব?
শুরুতে যে দৃশ্যের কথা বলা হলো, কুরবানির মহান ইবাদতের সঙ্গে তা আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেননা গোশত বিতরণের প্রচলিত পদ্ধতি বিনয়নিষ্ঠ নয়। এর মধ্যে আছে অহমিকার আভাস। লোকজন আমার বাড়ির দুয়ারে ছুটে এসেছে। আমার হাত থেকে গোশত নেওয়ার জন্য হাত পেতে রেখেছে। আমি বিরক্তির সাথে দুই-এক টুকরা গোশত সেসব হাতে বিলিয়ে যাচ্ছি কিংবা সাগ্রহে বিতরণ করে দুর্বলের প্রতি করুণা করার অহমবোধে আপ্লুত হচ্ছি। এ ভাবধারা আর যাই হোক, মহান ইবাদতের সাথে খাপ খায় না।
ইবাদতকালে মনের ভাব কেমন হবে সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : আর যারা যা দেওয়ার তা দেয় ভীত-কম্পিত হৃদয়ে এজন্য যে, তাদের নিজ প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে (সূরা মু’মিনূন : ৬০)। আল্লাহর উদ্দেশে যেকোনো ইবাদত ও যেকোনো দান-বিতরণ এরকম ভীত-কম্পিত মনেই হওয়া উচিত। এটাই ইবাদতের প্রাণশক্তি।
ইসলাম মানুষকে আনুষ্ঠানিক বানাতে আসেনি। তার উদ্দেশ্য আপন শিক্ষায় মানুষের দেহমন বিকশিত করে তোলা। অহমিকা বিলোপ ছাড়া সে বিকাশ কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। বস্তুত কুরবানির গোশত বিতরণের বর্তমান রেওয়াজ অহমিকার বিলোপ নয়; বরং তার বাড়-বাড়ন্তেই ভূমিকা রাখে। সে কারণে এ রেওয়াজ বিলুপ্ত হওয়া উচিত। তা হবে তখনই, যখন কুরবানিদাতা তার কুরবানির গোশত মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেবে।