১৮ বছরেও বিশ্ব বরেণ্য অর্থনীতিবীদ-কুটনীতিক শাহ এসএম কিবরিয়ার বিচার হয়নি

জাতীয় রাজনীতি সারাদেশ
শেয়ার করুন

এএইচএম ফিরোজ আলী : বিশ্ববরেণ্য কুটনীতিবীদ ও রানীতিবীদ শাহ এসএম কিবরিয়ার ২৪তম মৃত্যু বার্ষির্কী আজ। ২০০৫সালের ২৭জানুয়ারী গ্রেনেড হামলায় হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর এ হত্যাকান্ডের পর পুরো বিশ্ব চমকে উঠেছিল। কিবরিয়া একজন অসাধারণ প্রতিবার অধিকারি ছিলেন। তার সুনাম ছিল বিশ্বজুড়ে। তিনি বাংলাদেশের সেরাদের সেরা একজন অর্থমন্ত্রীর খ্যাতিও অর্জন করেছিলেন। তিনি ১৯৯৬সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। গুনি এ অর্থনীতিবীদ দেশের সেরাদের সেরা একজন অর্থনীতিবীদ। তিনি তাঁর সততা মেধা ও দক্ষতা ও বিচক্ষনতার কারনে দেশের দ্রব্যমুল্য অনেক কম ছিল। বাজারে হাহাকার ছিলনা। কৃষরাও পণ্যের নায্যমূল্য পেয়েছিলেন। তিনি খন্ডকালের অর্থমন্ত্রী হলেও দেশ সেরা অর্থমন্ত্রী খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি প্রকৃত অর্থে ছিলেন বাংলাদেশের এক অমূল্য সম্পদ ছিলেন। তাঁকে হত্যা করায় দেশের অপুরণীয় ক্ষতি হয়েছে। গরিবের অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া ছিলেন জাতীয় আশা আকাংখা ও ভরসার প্রর্তীক ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনিকে মাটির মানুষ বলে ডাকতেন। কিবরিয়া একজন আপাদ মস্তক সৎ মানুষ ও মনুষত্বের সাধক ছিলেন। কিন্তু দুঃখজনত হলে সত্য যে, দীর্ঘ ১৯বছর পেরিয়ে গেলেও একজন সেরা কুটনীতিবীদ হত্যার বিচার শেষ হয়নি।

২০০৫সালের ২৭জানুয়ারি ৪দলীয় জোট সরকারের আমলে হবিগঞ্জর বৈদ্যের বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙ্গনে এক জনসভায় বক্তিতা শেষ করে স্কুলের গেইট দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় ২টি আর্জেস গ্রেনেড তাঁর উপর নিক্ষেপ করা হয়। জঙ্গিরা এ গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। গ্রেনেডের আঘাতে তাঁর ভাতিজা শাহ মঞ্জুরুর হুদা আওয়ামীলীগ নেত আব্দুর রহীম, আবুল হোসেন ও সিদ্দেক আলী ঘটনাস্থলে নিহত এবং ৭০জন আহত হন। গুরুত্বর জখমি এসএস কিবরিয়াকে প্রথমে মাধবপুর হাসপাতালে নেয়া হলে ঔষধ যন্ত্রপাতি অবাভ ও চিকিৎসকদের অমনোযোগীতায় নিরুপায় হয়ে তাঁকে ঢাকার বার্ডেম হাসপাতালে নেয়ার পর অতিরিক্ত রক্ত করণে জননন্দিত অর্থনীতিবদি মুত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এমন একজন মানুষের মৃত্যুতে সমগ্র দুনিয়া অবাক বিস্ময়ে কেঁদে ছিল।

ঘটনার পর হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাভোকেট আব্দুল মজিদ খান বাদি হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইনে পৃথক দুটি মামলা করেন। ২০০৫সালের ২১মার্চ পুলিশ ১০ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করে। জোট সরকারের প্রভাবশালি ব্যক্তিরা জঙ্গিবাদ আড়াল করতে মামলাটি নিয়ে অনেক নাটকীয় ঘটনা ঘটিয়েছেন। পরবর্তিতে সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জঙ্গি মুফতি হান্নানসহ ১৪জনকে অভিযুক্ত করে সম্পুরক চার্জশীট দাখিল করা হয়। মামলাটি এখন সিলেটের দ্রæত বিচার ট্রাইব্যুনাল আদালতে বিচারাধিন আছে। আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর …আবদাল জানিয়েছেন মামলার অভিকাংশ স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্বাক্ষী বাকি থাকায় বিলম্ব ঘটছে।

কিবরিয়ার পুরো নাম শাহ আবু মোহাম্মদ সামসুল কিবরিয়া। কিন্তু কিবরিয়া সাব নামে তিনি দেশ বিদেশে বহুল পরিচিত ছিলেন ১৯৩৫সালের পহেলা মে হবিগঞ্জে জন্ম গ্রহণ করেন। অত্যন্ত পরিশ্রমি ও মেধাবি কিবরিয়া শিক্ষা জীবনে কোন দিন প্রথম ছাড়া পরিক্ষায় দ্বিতীয় হননি। তিনি অর্থনীতি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। বিস্ময়কর বিষয় যে, চাকুরীর পরিক্ষায়ও সমগ্র পাকিস্তানে প্রথম হয়েছিলেন। ১৯৫৪সালে তৎকালীন পাকিস্তানের বৈদেশিক বিভাগে যোগদান করে পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রনালয়ের রাজনৈতিক বিভাগের মহা পরিচালক ছিলেন। ১৯৮১-১৯৯২সময়ে তিনি জাতীসংঘের এশিয়া প্রশান্তি মহা সাগরীয় অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কমিশন (এসকাপ) এর নির্বাহী প্রধান ছিলেন। আওয়ামীলীগ দীর্ঘ ২১বছর পর (১৯৭৫-৯৬) সরকার গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হানিসা এমপি না হলেও কিবরিয়াকে টেনোকেট অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেন। এসময় সরকার মারাত্বক খাদ্য ঘাটতি নিয়ে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অমন অবস্থায় সর্বক্ষেত্রে প্রথম হওয়া অর্থমন্ত্রী যে কাজটা করেছিলেন তা ইতিহাসে বিরল। তিনি জিনসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্ষয় ক্ষমতার ভিতরে পুরো ৫বছর স্থিতিশিল রেখেছিলেন। দিন মজুর খেটে খাওয়া মানুষ ছিলেন আনন্দে আতœহারা। তবে, কিছু ধনী লোকও ছিলেন নাখুশ। তারা বলতেন ৫মন ধান বিক্রি করে একটি ইলিশ কেনা যায়না। বড় পরিবারের বড় শিক্ষিত অর্থমন্ত্রী বিদেশে লেখাপড়া করেনও এদেশের গরিবের বন্দু খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এখনও লোকজন বলাবলি করে থাকেন, কিবরিয়া সাব বেঁেছ থাকলে এভাবে জিসিনপত্রের দাম বাঁড়তনা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন, তাঁর আদর্শ পুরুষ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃতিম ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল তাঁর। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি চরম দুর্বল থাকায় আনুগত্য ম্বীকার করে আওয়ামীলীগের মত সর্ববৃহৎ প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দলের উপদেষ্টামন্ডলির সদস্য, দলীয়সভানেত্রী, রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং ১৯৯৬সালে নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান ছিলেন বিকরিয়া। ২১বছর বিরুধি দলে থাকা আওয়ামীলীগকে বিজয়ী করতে সুষ্টু সুচারুভাবে নির্বাচন পরিচালনায় তাঁর ভ‚মিকা ছিল ঐতিহাসিকভাবে অবিস্মরনীয়। এমন সাফল্যের কারনে মুগ্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ বিচক্ষণ কিবরিয়াকে অর্থমন্ত্রীর মত পদ উপহান দেন।

বাংলাভাষার প্রতি এসএম কিবরিয়ার গভীর মমত্ববোধ ও ভালবাসা ছিল অপরিসিম। বাংলা ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিনি জেলও কেটেছেন। বাংলা ভাষা ছিল তাঁর মনের মনিকোঠায়। বই পড়া জ্ঞান অর্জন চর্চা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম শখ। নিয়মিত বই পড়তেন এবং লেখালেখি করতেন। অর্থনীতি নিয়ে তাঁর লেখায় হৈছৈ পড়ে যেত। সহজ সরল ভাষায় লেখা থাকলেও তথ্য উপথ্য যুক্তি উপমা লেখা ছিল ভরপুর। বাংলা ইংরেজি লেখার ৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে। রাজনীতিবিদ না হয়েও রাজনীতি নিয়ে গবেষনা, চিন্তা ভাবনা এবং রাজনীতিতে সচ্চতা সুস্থ্যতা ফিরিয়ে আনার মনভাব ছিল বড়। দলের নীতি আদর্শে র পক্ষে অবস্থান থাকতে তার কোন আপোষ বা শৈতিলতা ছিলনা। আবার দলবাজিও পছন্দ করতেন না। ছবি তোলা নিয়ে সিনিয়র জুনিয়রদের সাথে প্রতিযোগিতা করা ছিল চরম অপছন্দ। এমন ঘটনার ধারে কাছেও যেতেন না। হবিগঞ্জ বা ঢাকার আওয়ামীলীগের দলীয় রাজনীতিতে তাঁর কোন হস্থক্ষেপের কথা শুনা যায়নি। বিএনপির নেতারা যখন মুক্তিযোদ্ধ আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিষুধাগার করে বক্তব্য দিতেন তাতে তিনি দুঃখ ও কষ্ট পেতেন। এই কথা অনেককেই চুপি চুপি বলে দিতেন। মিথ্যা চারের বিরুদ্ধে ছোট বেলা থেকেই লড়াই করেছেন। ২১বছর আওংামীলীগের বিরুদ্ধে মনগড়া অপপ্রচার ইতিহাস বিকৃতিতে খুবই বেদনাহত হতেন। সঠিক ইতিহাস রক্ষায় তিনি ছিলেন সোচ্ছার। বেরিষ্টার মওদুদ আহমদ ও বেরষ্টার নাজমুল হুদাসহ কয়েবজন জাতীয় নেতাকে দেশের রাজনীতির বিভ্রন্তিকর ব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন। মানুষের কোন ক্ষতি হয় এমন কোন চিন্তা কোনদিন তার শরিরে ছোয়া লাগেনি। ২০০১সালন নির্বাচনে হবিগঞ্জ সদর আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হলেও আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করতে পারেনি। ফলে দেশ প্রেমিক এসএম কিবরিয়া এদেশের ভবিষ্যাৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন। এদশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরিতে পাকিস্তানি ধারায় দেশ পরিচালনার ঘটনা তাঁর দেশি বিদেশি অনেক লেখায় প্রকাশিক হয়েছে।

শাহ এসএম কিবরিয়ার সাথে আমার সরাসরি দেখাস্বাক্ষাৎ না হলেও তাঁর জীবনি ও অনেক গুলো লেখা মনযোগ সহকারে পাঠ করেছি। তিনি ছিলেন এদেশের অর্থনীতিবীদদের এক আইকন। তাঁর হত্যাকান্ডের ঘটনার দিন সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইফতেখার হোসেন শামিম, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চি ইউনিয়নের আওয়ামীলীগের এক বর্ধিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখছিলেন। হঠাৎ তাঁর মোবাইলে একটি কল আসার পর তিনি কল রিসিভ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তখন তিনি সবাইকে বলেন শাহ এসএম কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়েছে তাড়াতাড়ি মিছিল বের কর। মুহুর্তেংর মধ্যেই আমরা সবাই মিছিল শুরু করি এবং তিনি দ্রুত সিলেট চলে যান। চর্তুদিকে মিছিল আর মিছিল শুরু হয়। দেশ জুড়ে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আওয়ামীলীগ বিস্ফোরণমুখর হয়ে পড়ে। একটি কথা স্মরণ করতে হয় যে, ১৯৭১ সালে পাক হানাদাররা এদেশের মাটি ও মানুষকে পুড়ে ছারখার করে যাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে এবং যুদ্ধের শেষ দিকে এদেশের শ্রেষ্ট সম্পদ দেশ প্রেমিক বুদ্ধিজীবিদের গণহারে হত্যা করা হয়। জোট সরকারের আমলেও শাহ এসএম কিবরিয়া আহসানুল্লাহ মাষ্টার মনজুরুল ইমামসহ অনেক দেশ প্রেমিক জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। আমরা শাহ এসএম কিবরিয়া হত্যা মালার রায় ঘোষনার মাধ্যমে অপরাধিদের কঠোর শাস্তির অপেক্ষায় দেশবাসি প্রহর গুনছেন। আমি এসএম কিবরিয়ার বিদেহি আত্নার শান্তি কামনা করছি।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *