এএইচএম ফিরোজ আলী:: ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ কালিমা, নামাজ, রোজার পর চতুর্থ স্তম্ভ হচ্ছে, হজ্ব। হজ্ব এমন একটি ইবাদত, যেখানে আর্থিক ও শারীরিক কর্মকান্ড উভয়ই জড়িত। হজ্ব মুসলিম বিশ্বের মহা-মিলনের এক সুবর্ণসুযোগ। মুমিনদের ঐক্য ও ইমান সুদৃঢ় হওয়ার শক্তিশালী এক মহাসম্মেলন। হজ্বের সময় মুসলমান একত্রি হয়ে সাদা দুই টুকরা সেলাই বিহীন কাপড় পরিধান করে মহান আল্লাহর নিকট আত্নসমর্পন করেন। সমবেত কন্ঠে বলেন, ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, হাজির হে প্রভু, ‘তোমার দরবারে হাজির,। এমনি ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পবিত্র নগরী মক্কা, মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতের ময়দান। হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা বিশ্বের গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে পুরো মুসলিম বিশ্ব আনন্দ-উল্লাসে মুখরিত হয়ে যায়। হজ¦ ইসলামের প্রতি মানুষের আনুগত্যের দুয়ার উন্মোচিত করে দেয়। মোমিন সকল হিংসা- বিদ্বেষ পরিত্যাগ করে ছোট-বড় পাপ থেকে মুক্তির আশায় জমায়েত হন, আরাফাতের ময়দানে।
হজ্ব পৃথিবীর মানুষকে বর্ণ-গোত্র, জাতীয়তার পার্থক্য ভূলে এক মুসলমান পরিচয়ে মানবতা ও ইসলামের নৈতিক শিক্ষার আদব শেখায়। হজ্ব পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষা-সাংস্কৃতি, ভাষা, আদব, আচার-আচরন ও পর্যটন শিল্পের বিনিময় ঘটায়। হজ্ব মানুষের প্রতি মানুষের মায়া-মমতা ও ভালবাসার শিক্ষা দেয়। হজ্বের মাধ্যমে মক্কা-মদিনার রাসুলে করিম (সঃ) এর স্মৃতি বিজড়িত ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখার সুযোগ করে দেয়। মদিনায় হিজরতের সময় মহানবী (সাঃ) যে গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং যে গুহায় কোরআন নাজিল হয়েছিল সে সব স্থান সরাসরি দেখে মুসলমানদের ইমানি শক্তির প্রসার ঘটে এবং হজ্ব পালনের প্রতি মানুষের আস্থা বিশ্বাস বেড়ে যায়।
আরবী শব্দ হজ্বের আভিধানিক অর্থ সংকল্প, ঘুরাফেরা, পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদি। মহান আল্লাহ’র সন্তুষ্টি লাভে, কোরান হাদিসের নিয়মানুযী নির্দিষ্ট সময়ে কাবা শরীফসহ নির্দেশিত স্থান সমূহ তাওয়াফ ও জিয়ারত করার নাম হজ্ব। আল্লাহ’র সাথে বান্দার সেতু বন্ধনের মাধ্যম হচ্ছে, হজ্ব। কোন মুসলমানের উপর হজ্ব ফরজ হওয়ার পর পালন না করলে, সেই ব্যক্তি বড় গুনাগার হবেন। হজ্বের ফরজ তিনটি (১) ইহরাম বাধা (সেলাই বিহীন দুই টুকরা সাদা কাপড় পরিধান) বা নিয়ত করা। (২) উ‘কুফে আ’রাফা (আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা ফরজ )। (৩) তাওয়াকুল জিয়ারত। হজ্বের ওয়াজিব ৬টি। (১) সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাতবার সায়ী করা। (২) ৯ই জিহজ্ব মুজাদালিফায় অবস্থান করা। (৩) মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা। (৪) কোরবানী করা। (৫) এহরাম খুলার আগে, চুল কাটা বা মাথা মুড়ানো। (৬) মক্কা থেকে বিদায়ের আগে কাবাঘর তাওয়াফ করা। তাছাড়াও মদিনায় মহানবী (সাঃ) রওজা জিয়ারত করা। সুযোগ থাকলে মসজিদে নববিতে ৮দিনে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা। হজে¦ও ফরজ ওয়াজিব ছাড়াও অশ্লিলতা, যৌনমিলন, পাপাচার সহ দুনিয়াবি কাজ থেকে বিরত থেকে শুধুমাত্র আল্লাহর ধ্যানেমগ্ন থাকতে হবে। হজ¦ পালনকারীরা পিপড়া সহ কোন পোকা-মাকড় হত্যা না করা উত্তম। মক্কা মদিনায় হজে¦র স্থান সমূহ দেখে শ্রদ্ধা করা হজে¦র অন্যতম উদ্দেশ্য।
ইসলাম ধর্মে, হজ্বের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। মাকবুল বা আল্লাহ’র নিকট গ্রহণীয় হজ্বের বিনিময় হচ্ছে, ‘জান্নাত’ এবং বিগত দিনের যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়া। হজ্ব সম্পর্কে পবিত্র কোরান শরীফে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ’র তরফ থেকে সেই সব মানুষের জন্য হজ্ব ফরজ করে দেয়া হয়েছে, যারা আদায়ে সামর্থ রাখে (সুরা ইমরান আয়াত ৯৭)। অর্থাৎ জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন সচ্ছল মুসলিম নর-নারীর উপর হজ¦ ফরজ। সামর্থবানরা কোন কারণে হজ্ব করতে না পারলে ওয়ারিশদের হজ্ব আদায়ে বলে যাওয়া এবং সম্পদ বন্টনের আগে ওয়ারিশগণ বদলী হজ্ব পালন করা ওয়াজিব। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ্ব পালন করে, সে যেন নবজাতক শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যায়। পৃথিবীর যত নেক আমল আছে, তার মধ্যে হজ্ব শ্রেষ্টতম। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, অন্য সকল আমলের উপর হজ্বের মর্যাদাকে পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্তের সাথে তুলনা করেছেন। জীবনে হজ্ব একবার করা ফরজ এবং বাকি সব হজ্ব নফল হবে।
মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ইবাদত গৃহটি (কাবাঘর) নির্মিত হয়, সেটি পবিত্র নগরী মক্কায় অবস্থিত। বায়তুল্লাহ বা আল্লাহ’র ঘর কাবাকে বাইতুল আতিক ও বলা হয়। অতিক শব্দের অর্থ প্রাচীন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, কাবাঘরটি পৃথিবীর মানচিত্রের কেন্দ্রে অবস্থিত। হযরত আদম (আ:) পৃথিবীতে এসে ইবাদতের যে স্থানটি নির্দিষ্ট করেন, ইহাই আদি কাবাঘর, পৃথিবীর প্রথম উপাসনালয়। পরবর্তীকালে এই স্থানে একটি গৃহ নির্মিত হলে হযরত নূহ (আ:) এর সময়ে প্লাবনে নষ্ট হলে, হযরত ঈসা (আ:) এর জন্মের ২০০০ হাজার বছর পূর্বে হযরত ইব্রাহিম (আ:) ও তাঁর জৈষ্ট্য পুত্র হযরত ইসমাইল (আ:) সহযোগে কাবাগৃহটি নির্মাণ করেন। ৬৫০খৃষ্টাব্দে মক্কার মুসলমানগণ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নেতৃত্বে কাবাগৃহের মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেন এবং কাবাকে পুনরায় আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেন। জান্নাত থেকে আসা হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) কে কাবা ঘরের এক কোনে সকলকে নিয়ে স্থাপন করেন। কাবা ঘর হচ্ছে, কিবলা। মুসলমানদের জন্য দিক নির্ণায়ক ও ঐক্যের প্রতীক কাবাঘর। হযরত ইব্রাহিম (আ.) সর্ব প্রথম কাবা ঘরকে কেন্দ্র করে আল্লাহ’র নির্দেশিত নিয়মে হজ্বের প্রবর্তন করেন। জাহিলিয়াতের যুগেও হযরত ইব্রাহিম (আ:) প্রবর্তিত হজ্ব ও ওমরাহ পালন করা হতো। আল্লাহ’র সন্তুষ্টি লাভে, হযরত ইব্রাহিম (আ:) প্রিয় পুত্র হযরত ঈসমাইলকে কোরবানী দিতে প্রস্তুতের সময় মহান আল্লাহ কুরবানি কবুল করলে, আল্লাহর হুকুমে জিব্রাইল (আঃ) ছুরির নিচে দুম্বা দিলে কুরবানি হয়ে যায়। সে সময় থেকেই ইসলামে পশু কুরবানির প্রচলন শুরু হয়। রাসুল (সাঃ) হযরত ইব্রাহিম (আ:) এর প্রবর্তিত হজ্বকে ইসলামের চিরন্তন একত্ববাদী আদর্শে পুন: প্রাতিষ্টিত করেন।
এক সময় আমাদের দেশের লোকজন ভারতের ভিসা নিয়ে জাহাজে ও বিমানে হজ্বে যেতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সৌদি বাদশাহর সাথে আলোচনা করে হজ্বে নিজ দেশের ভিসায় সরাসরি যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আগেরকার দিনে, যারা হজ্ব পালনের ইচ্ছা পোষন করতেন, তারাঁ হালাল রোজি বা হালাল আয়ের টাকা কাপড়ের থলিতে বা বাস্কে জমা করে রাখতেন, ঘরে বিবাহের উপযুক্ত মেয়ে-ছেলে বিবাহ দিয়ে, ঋন পরিশোধ করে, জাগা-জমি ধন সম্পদ ভাগ-বাটোয়ারা কওে দেওয়ার পর হজে¦ যেতেন। কারো নিকট কোন ভুল ত্রুটি করলে ক্ষমা চেয়ে নিতেন। হজ্বে যাওয়ার আগেই সকল হি:সা বিদ্বেষ ভুলে যেতেন। পাড়া-প্রতিবেশির নিকট ক্ষমা ও দোয়া চাইতেন। এ ধরনের মোমিন বান্দারা মরার আগে যেন মরে যেতেন। তাঁরা মিথ্যা কথা বলতে সাহস পেতেন না। মানুষ বা কোন প্রাণীর ক্ষতি করতে চাইতেন না। কিন্তু সেই দৃশ্যপট এমন পাল্টে গেছে। দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারী, ঘুষ-সুদখোর অহংকারী ব্যক্তিরা প্রতি বছর ওমরা ও হজ্ব পালন করতে যেতে দেখা যায়। দেশের টাকা বিদেশে পাচারকারিরা বিদেশে থেকেই ওমরাহ ও হজ্ব পালন করছেন। এসব বক ধার্মীকরা মক্কা-মদিনায় গিয়ে আল্লাহর নৈকট্ট লাভে মগ্ন থাকার চেয়ে ফটো তুলতে ব্যস্ত দেখা যায়। এ ধরনের লোক দেখানো হজ্ব মকবুল বা কবুল হজ্ব হতে পারে না।
সৌদিআরব প্রাকৃতিক তেল সমৃদ্ধ একটি উন্নত দেশ। দেশটি প্রতিবছর হজ্ব থেকে আয় করে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। এটা সে দেশের অর্থনীতির আয়ের বড় উৎস। ২০২২সালে অন্য দেশ থেকে আসা হজ্বযাত্রীরা খরচ করেছেন ২৩ বিলিয়ন ডলার। বিবিসির ফার্সি বিভাগের আলী কাদিমি তাঁর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, গত দশ বছরে ২৫লাখ মুসলমান হজ্ব এবং ৬০ লাখ ওমরাহ পালন করেছেন। গত বছর ৮৩ লাখ হজ্ব হজ্বে গমণকারি সাড়ে চার হাজার ডলার এবং সৌদি আরবে থাকা হাজীরা গড়ে দেড় হাজার ডলার করে খরচ করেছেন। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে প্রতি বছর ইন্দোনেশিয়া থেকে বেশি হজ্ব যাত্রী গমণ করেন। তাদের গড় সংখ্য ২লাখ ২০হাজার। মোট হজ¦ যাত্রীর মধ্যে ১৪% মিশর, ১১% পকিস্তান ও ভারত এবং ৮% বাংলাদেশিরা হজে¦ গমন করেন। আমাদের দেশে হজে¦র খরচ বৃদ্ধি নানা অনিয়ম, দূর্নীতি হয়রানি ও ঝামেলা-জটিলতার কারনে বাংলাদেশি হজ্ব যাত্রীর সংখ্যা প্রতিবছর কমছে। গত বছর একজন হজযাত্রীর কুরবানী সহ খরচ নির্ধারন করা হয়েছিল ৫লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। চরতি বছর একজনের খরচ ধরা হয়েছে ৬লাখ ৮৩ হাজার টাকা। মকবুল হজ¦ আদায়ে হজ¦ যাত্রিদের পূর্ব প্রস্তুতি ও হজে¦ও সকল নিয়মকানুন জানা একান্ত প্রয়োজন। হজে¦র প্রতিটি করণীয় সুষ্ট, সঠিক ও যথা নিয়মে পালনের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে গুনাহ মাফের প্রার্থনা করতে হবে। মহান আল্লাহ যেন তাঁর সকল মেহমানদের হজ¦ কবুল করেন-আমিন।
লেখক, কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক