এএইচএম ফিরোজ আলী:: ১৯৭১সালের ‘মার্চ’ মাস বাঙালির সুদীর্ঘ ইতিহাসের এক শ্রেষ্ট মাস। এ মাস ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের মাস। এ মাস স্বাধীনতার যৌবনের মাস, উত্তাল-অগ্নিঝরা মাস নামে ইতিহাসে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে। এ মাস বাঙালির আবেগ-চেতনা ও অনুপ্রেরণার সেরা মাস। মাসটি বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ মাসে জ্যোতিস্কময় দীপ্ত অনেক ঘটনা বিশে^র দৃষ্টি আকর্ষন করেছে। পাকিস্তানের পতাকা ছিড়ে উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা। জগৎ বিখ্যাত ভাষন দেন বঙ্গবন্ধু- এ মঞ্চেই গাওয়া হয়, রবি ঠাকুরের অমর গান ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। প্রতিদিন লাখো-কোটি মানুষের কন্ঠে উচ্চারিত হয় ‘জয় বাংল, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি। পরাধীন বাঙালি দেশকে শত্রু মুক্ত করতে সকল আবেগ-অনুভূতি একত্র করে বিজয়ের চেতনায় এ মাসেই বেশি জীবন উৎর্সগ করেন। সন ভিন্ন হলেও মার্চ মাসেই স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জন্ম এবং এ মাসেই তিনি গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তানের কারাগারে ফাঁসির আসামী হয়ে বন্দি ছিলেন। তাই মার্চ মাস মুক্তিযুদ্ধের অনন্য এক মাস।
ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসন, পাকিস্তানের শোষন মিলিয়ে প্রায় ২২৪ বছরের দৈন্যদশা ও ক্ষোভের শেষ পরিনতি ঘটে মার্চ মাসে। ১৯৭০সালের পাকিস্তানের সামরিক জান্তার অধীনে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে। তখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬২ এবং সংরক্ষিত ১৩টি আসনের মধ্যে ৭টি সহ ১৬৯টি আসন পেয়ে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে আওয়ামীলীগ। জাতীয় পরিষদে ৭৫.১০শতাংশ এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৭০.৪৮শতাংশ ভোট পায় নৌকা প্রতীক। নির্বাচনের ফলাফলে পাকিস্তানী লুটেরাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। এ নির্বাচনে নৌকায় যারা ভোট দেয়নি, তারাই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল, তা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। নিরষ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জনের পরও ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টাল-বাহানা শুরু করেন। এক পর্যায়ে ৩রা মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন।
কিন্তু পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর কুপরামর্শে ইয়াহিয়া খান ১মার্চ ১টা ৫মিনিটে এক বেতার ভাষনে ৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিত ঘোষনা করেন। ঘোষনা পর মুহুর্তেই পুর্ব বাংলার পরিস্থিতি পাল্টে যায়। বাঙালির কাঁটা গায়ে লবন ছিটালেন ইয়াহিয়া খান। পূর্ব বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ঢাকায় যেন অগ্নিস্ফোলিঙ্গের বিষ্ফোরন ঘটে। ভুট্টো সহ পাকিস্তানের কয়েকটি দল ৩মার্চের অধিবেশন বর্জন ঘোষণা করেন। এদিন ঢাকা স্টেডিয়ামের ক্রিকেট খেলা বন্ধ করে, দর্শকরা রাস্তায় নেমে পড়েন। হোটেল পুর্বানিতে আওয়ামীলীগের র্পালামেন্টারি বোর্ডের সভা চলছিল। হাজার হাজার ছাত্র জনতা মিছিল নিয়ে সেখানে জমায়েত হতে থাকে। অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২মার্চ ঢাকায় এবং ৩মার্চ সারাদেশে হরতাল আহবান করেন। সামরিক আইন পরিচালক শাহেবজাদা ইয়াকুব আলী খান গভীর রাতে সামরিক আইন জারি করেন। এ দিন ঢাকায় ২৩জন ও চট্রগ্রামে গুলি করে ৭৫জনকে হত্যা করা হয়। ১মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে পরদিন ২মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বট তলায় হাজার হাজার ছাত্রের সামনে নুরে আলম সিদ্দিকির সভাপতিত্বে ডাকসুর ভিপি আসম আব্দুর রব, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আনুষ্টানিক মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সামনে স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষনা করেন, শাহজাহান সিরাজ। ঐদিন ৬মার্চ পর্যন্ত হরতাল বর্ধিত করা হয়। ৪ মার্চ চট্রগ্রাম ও পার্বত্য চট্রগ্রামের জেলাগুলোতে জান্তা সরকার সামরিক আইন জারি করেন। শুরু হওয়া আন্দোলনে চট্রগ্রামে ১২১ জন এবং খুলনায় ৬জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঢাকায় কারফিউ প্রত্যাহার করা হয় এবং ছাত্রলীগ ও ডাকসু ৬ মার্চ ঢাকা শহরে এবং ৭ মার্চ সারাদেশে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেয়। ৬মার্চ রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ভবনে বৈঠক করেন ইয়াহিয়া ও ভুট্টো। ঐদিন টঙ্গিতে গুলিবর্ষনে ৪জন নিহত ২৫জন আহত এবং চট্রগ্রামে সব মিলিয়ে ১৩৮জনকে হত্যা করা হয়। রাজশাহী, রংপুরে কারফিউ জারি করা হয়। এদিন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেন এবং ইঞ্জিনিয়ার ইউনির্ভাসিটির শিক্ষকরা যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করে আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান। টিক্কাখানকে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর নিয়োগ দেওয়া হলে আওয়ামীলীগের জরুরী বৈঠকে বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক ও অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সেই মহেন্দ্রক্ষন। রেসকোর্স ময়দানে বিশে^র সেরা ভাষন দেন বঙ্গবন্ধু। কোন দ্বিরুক্তি ছাড়াই প্রায় ১৯-২০মিনিট স্মরণকালের ভাষন দিয়ে তিনি নিরস্ত্র বাঙালিকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানান। বিশে^র সেরা রাজনীতির কবি ও কৌশলী সবকিছু পরিষ্কার করে বলেন, “বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা সবকিছু বন্ধ করে দেবে। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব- এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ”। মুলত এটাই ছিল স্বাধীনতার ঘোষনা। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষনের পর সব শ্রেনী পেশার মানুষের যেন ভরা যৌবন ফিরে পায়। গবেষনায় বলা হয়েছে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবাগ ভাষন, লেলিন, মাওসেতুং, মাহাত্না গান্ধি, জওহরলাল নেহেরু, চার্চিলের ভাষনের সাথে এ ভাষনকে তুলনা করে হাজার বছরের শ্রেষ্ট ভাষন বলে আখ্যায়িত করা হয়। আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করলে, পূর্ব বাংলার সবকিছু অচল হয়ে বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৪মার্চ জুলফিকার আলী ভূট্টো দুই পাকিস্তানে ২জন প্রধানমন্ত্রী রাখার ফর্মুলা দেন। ২৩মার্চ দেশে ভয়াবহ এক বিষ্ফোরন ঘটে। এদিন পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে পুর্ব বাংলার মুক্তিকামী মানুষ পাকিস্তানের সকল পতাকা ছিড়ে পা দিয়ে মুছড়িয়ে, আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
২২ ফেব্রুয়ারী জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মেজন জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৬-২৫ মার্চ সময় পর্যন্ত ইয়াহিয়া, ভূট্টো ও তাদের উপদেষ্ট্রারা কয়েক দফা প্রতরনামূলক বৈঠক করে বঙ্গবন্ধুর সাথে এবং সবশেষে অপারেশন সার্চ লাইট চূড়ান্ত করে তারা পাকিস্তানে চলে যায়। হানাদারদের টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। বিশ^বিদ্যালয়ের ১০জন শিক্ষকসহ ৩শ জন কর্মচারীকে হত্যা করে। টিক্কাখানের ঘাতক সৈন্যরা রাজারবাগ পুলিশলাইন পিলখানা, ইপিআই হেড কোয়াটার, ট্যাংক মেশিনগান, মটারসেল নিয়ে আক্রমন করে। দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক বাংলা, ইংরেজি দৈনিক দি পিপলস পত্রিকা অফিসে আগুন লাগিয়ে বহু পত্রিকা অফিস ও কর্মীকে পুড়ে ছাই করা হয়। এ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। রাত ১.৩০ মিনিটের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পাক বাহিনী। এর আগে রাত ১১টায় বিগ্রেডিয়ার জহির সহ একদল সেনাবাহিনী তিনটি ট্রাক ও জীপ নিয়ে ধানমন্ডির ৩২নং বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর দিকে রওয়ানা দেয়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর বলা হয়েছিল বড় মাছটিকে ধরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা বার্তা সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা জহির চৌধুরীর হাতে পৌছলে তিনি জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুল হান্নানকে নিয়ে বাংলায় অনুবাদ করে সাইক্লোস্টাইল কপি জনতার হাতে বিলি করার পর ঐদিন ২.৩০মিনিটের সময় আগ্রাবাদ বেতারকেন্দ্র থেকে এমএন হান্নান ঘোষণা পত্রটি পাঠ করেন। ঐদিন চট্টগ্রাম, কুমিরার সৈন্যরা মেজর রফিকের নেতৃত্বে ২হাজার পাকসেনা এবং ঠাকুরগাঁওয়ে ১১৫ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। পরদিন ২৭মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ইংরেজীতে ঘোষণা পত্রটি পাঠ করেন। ২৯ মার্চ দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ ব্যাপক গণহত্যার কথা উল্লেখ করে এবং ৩০ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল হেরান্ড ট্রিবিউন জানায়, পুরো ঢাকায় একরাতেই ১৫ লাখ লোককে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ৯মাসে কোটি মানুষের কন্ঠে যতবার জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু উচ্চারিত হয়েছে এর মধ্যে বেশি উচ্চারিত হয় মার্চ মাসে। বঙ্গবন্ধু শুধু ভারতবর্ষের ইতিহাসে একমাত্র সফল আন্দোলনের নির্মাতা ছিলেন না, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে এ উপমহাদেশের সর্বকালের সকল শহীদদের ঋণ শোধ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম সফল করেছে, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, সূর্যসেন থেকে সালাম, বরকত, রফিক , জব্বার, কিংবা ৬৯এর শহীদ আছাদ ও ৩০লাখ শহীদের আত্নদানকে। তিনি সর্বকালের বাঙলা ও বাঙালীর আপন কন্ঠ। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বনকিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মত মহান ব্যক্তিদের কঠিন সন্ধিক্ষনে দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। এ কথা বাংলা ও বিশে^র ইতিহাসে স্বীকৃত যে বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলা ও স্বাধীনতার ইতিহাস হয়ত দীর্ঘকালের জন্য অশূভ অন্ধকারে থমকে থাকত।
লেখক, সদস্য সিলেট জেলা আওয়ামীলীগ