করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এবছরও পক্ষকাল দেরিতে একুশের বইমেলা শুরু হলেও তা বরাবরের মতো মাসব্যাপী চালানোর পক্ষেই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মঙ্গলবার দুপুরে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ‘অমর একুশে বইমেলা-২০২২’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যদিয়ে বাঙালির ‘প্রাণের মেলা’র ৩৮তম আসর শুরু হল।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন একুশে বইমেলা শুরু হলেও মহামারীর কারণে গত বছর দেড় মাস পিছিয়ে ১৮ মার্চ মেলা শুরু হয়েছিল, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের দুদিন আগে ১২ এপ্রিল তা শেষ হয়ে যায়।
করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের দাপটে এ বছরের শুরুতে দেশে রোগীর সংখ্যা আবার বাড়তে থাকায় বইমেলা শুরুও পিছিয়ে দেওয়া হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেলা চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তবে সংক্রমণের হার এখন কমে যাওয়ায় মেলা একমাস চালাতে চাইছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেছেন, “সংক্রমণ কমলে মেলার সময় কিছুটা বাড়াতে পারব। সেজন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর নিদর্শনার অপেক্ষায় আছি।”
মেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের প্রকাশকদের পক্ষ থেকেও একটা দাবি এসেছে যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন যে ১৭ই মার্চ, সে হিসেবে মার্চ মাস পর্যন্ত এটা চালাতে পারে।
“আমি মনে করি যে বই মেলাটা আমরা এক মাস চালাতে পারি। তবে সেটা আপনারা নিজেরাও দেখবেন ভেবে। কারণ আমি একা তো আর কিছু বলতে পারব না। এটা আপনাদেরই…..কতটুকু করতে পারবেন।”
একুশের বই মেলা যে শুধু বইয়ের মেলা নয়, সকলের মিলনমেলা, সে দিক বিবেচনায় মেলার সময়ের ব্যপ্তি বাড়ানোর কথা বলেন সরকার প্রধান।
বইমেলায় আসার ক্ষেত্রে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন তিনি।
সরকারের টিকা কার্যক্রম নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে টিকা দিচ্ছি। বুস্টার ডোজও দেওয়া হচ্ছে। যারা নেন নাই অবশ্যই তাদেরকে টিকা এবং বুস্টার ডোজটা নিয়ে নিতে হবে। যাদের দুটো নেওয়া হয়ে গিয়েছে তারা বুস্টার ডোজ নেবেন। যাদের এখনও টিকা নেওয়া হয়নি, তারা সকলেই কিন্তু টিকাটা নেবেন। টিকাটা নেওয়া থাকলে আপনি একটু সুরক্ষিত থাকেন।”
মহামারীর কারণে সশরীরে মেলায় উপস্থিত থাকতে না পারায় আক্ষেপ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার দুঃখ হলো যে করোনার কারণে আমি ঘরবন্দি। ভাগ্যিস ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছিলাম তাই অন্তত এই ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে।”
বইমেলা ঘিরে নিজের শৈশব স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, “সেই স্কুল জীবন থেকে আমরা তো সব সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আসতাম আন্দোলন সংগ্রাম করতে। তারপর বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বাংলা একাডেমিতে যখন বই মেলা শুরু হল, আমার তো মনে হয় যে কোনো বই মেলা বাদ দিইনি। সারাদিন এই বই মেলায় ঘুরে বেড়ানো এটা তো আমাদের একটা অভ্যাসই ছিল।
“কিন্তু যখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে গিয়েছি, তখনই পায়ে শেকল পড়ল। নিরাপত্তার অজুহাতে আর ওই বই মেলায় আগের মতো স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগটা থাকেনি। আবার যখন বিরোধী দলে ছিলাম, তখন আবার গিয়েছি, তখন আবার সুযোগ ছিল। এখন তো সেই ২০০৯ সাল থেকে এই বন্দিদশায় আছি। আর করোনাকালীন আরও বেশি বন্দি হয়ে গেছি।”
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব মো. আবুল মনসুর, বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন,বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি (বাপুস) সভাপতি মো. আরিফ হোসেন বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী খালিদ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২১ জয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
সাহিত্য সম্মেলন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মতো আয়োজন দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে বাংলা একাডেমিকে উদ্যোগী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আমাদের প্রত্যেক জেলায় বা মহকুমায় অতীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত, সাহিত্য চর্চা হত, সাহিত্য সম্মেলন হত, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হত। এই চর্চাটা অনেকটা কমে গেছে। এটাকে আবার একটু চালু করা দরকার।
“আমাদের শিল্পকলা একাডেমি প্রায় প্রত্যেকটা জেলায়, এখন উপজেলা পর্যন্ত করে যাচ্ছি। পাশাপাশি আমাদের এই বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকেও যদি আপনারা একটু উদ্যোগ নেন, তাহলে বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক মেধাবী কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী আমরা পাব।”
আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনায় দেশের উন্নয়নের গতি বাড়ার পর এখন মানুষের মনের খোরাক দেওয়ার উপর জোর দেন শেখ হাসিনা।
“মানুষের হৃদয়ের খোরাকটাও তো দরকার। খাদ্য নিরাপত্তা আমরা করে দিয়েছি, এখন হৃদয়ের খোরাকটা জোগাতে হবে। সেটা সংস্কৃতি চর্চার মধ্য থেকেই আসে।”
সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা থাকলে যুব সমাজের বিপথগামী হওয়ার শঙ্কাও কমবে বলে মনে করেন তিনি।
বিদেশি ভাষা শেখার ক্ষেত্রে আপত্তি না থাকলেও নিজেদের শেকড় মজবুত করতে বাংলা চর্চার উপর গুরুত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী।
“বিদেশি ভাষাও শেখা দরকার। সেখানকার সংস্কৃতি চর্চাও জানা দরকার। কিন্তু নিজের যে অস্তিত্ব, সেটাকে আরও বড় করে আমাদের দেখতে হবে। আরও উন্নত করতে হবে। সেইদিকে বিশেষভাবে নজর দিয়ে আমাদের সংস্কৃতি চর্চাটা আরও বাড়াতে হবে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের ভাষা সাহিত্যের আরও ব্যাপক পরিচর্যা যাতে হয়, তার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতি অর্থাৎ বাংলা অনলাইনে বাংলা ব্যবহারের জন্য আমরা নানা ধরনের বাংলা অ্যাপ চালু করেছি। অভিন্ন বাংলা ফন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এভাবে ..অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন ফন্ট আছে সেটা একটা অভিন্ন ফন্ট যাতে ব্যবহার হয়, একটা প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়ে গেছে। কাজেই ডিজিটাল প্রকাশনাও আমাদের সাথে সাথে করতে হবে।”