মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বনাথের অবদানঃ ১০ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত

Uncategorized
শেয়ার করুন

এ্এইচএম ফিরোজ আলী:: মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব ও অহংকার। বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন ছিল, স্বাধীনতা। এজন্য বলা হয়, স্বাধীনতা বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন।এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টর বিভক্ত করা হয়। সিলেটের বিশ্বনাথ থানা ছিল, ৪ ও ৫নং সেক্টরের অধীনে।
৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর আওয়ামীলীগ নেতা বজলুর রশীদ, আছলম খান, দৌলতপুর গ্রামের সিতাব আলী, বালাগত হোসেন, যুক্তরাজ্য প্রবাসী মনু মিয়া, টিমাইঘর প্রতাবপুর গ্রামের আব্দুর নুর কমান্ডার, আকমল আলী চেয়ারম্যান, রাজনগর গ্রামের আব্দুন নুর, কান্দিগাঁও গ্রামের সৈয়দ আব্দুল খালেক সোলেমান, পাহাড়পুর গ্রামের ডা. হারিছ আলীসহ আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে প্রতিরোধ ও যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তরুনদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজ শুরু করেন। এডভোকেট নুরুল ইসলাম খান, আব্দুস সাত্তার, আকমল আলী, কটাই মিয়া, রসময় দে ধৈয্য বাবু, আব্দুন নুর, মনু মিয়াসহ আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে থানা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। চরচন্ডি গ্রামের কুটি মিয়াকে কমান্ডার করে দৌলতপুর ইউনিয়নে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট ‘স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনী, হামিদুর রহমান, সিতাব আলী, বালাগত হোসেন, তেজন খান, ইদ্রিস খান, নুরুল হক, আজিজুর রহমান, আব্দুস শহীদ চৌধুরী, মনির উদ্দিন চৌধুরী, লাইলু মিয়া, মনির আহমদ, আফরোজ আলীসহ একদল তরুনকে নিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়েছিল।
এপ্রিল মাসে পাকহানাদার বাহিনী বিশ্বনাথে প্রবেশ করে। সে সময় রাস্তাঘাট কাঁচা থাকলেও রাজাকার বাহিনী পাকসেনাদের নিয়ে ক্যাম্প করে দিয়েছিল। বিশ্বনাথ থানা সদর, লামাকাজী, গোবিন্দগঞ্জ, কামালবাজার, নাজিরবাজার, খাজাঞ্চী রেলওয়ে ব্রিজ, পরগনা বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে মাটি খনন করে বাংঙ্কার করে হানাদাররা। যুদ্ধের প্রথম দিকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন চানভরাং গ্রামের মুজিবুর রহমান, কমান্ডার আব্দুর নুর, ক্যাপ্টেন আব্দুর রউফসহ স্থানীয় জনতা।
নরশিমপুর গ্রামের ইছহাক আহমদ ও গড়গাঁও গ্রামের আশরাফ আলী মাওলানার নেতৃত্বে শান্তি কমিটির নামে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজাকার আলবদর আসসামস বাহিনী গঠন করে। আওয়ামীলীগারদের নামের তালিকা তৈরি করে তাঁরা সিলেট ক্যাডেট কলেজে পাঠাতেন। এই বাহিনী পাকসেনাদের খাবারের জন্য গবাদিপশু ধরে নিয়ে ক্যাম্পে দিতেন। এসব স্বাধীনতা বিরোধীরা যুদ্ধকালিন সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে গন্ডগুল যুদ্ধ বলে গ্রামে গ্রামে ও মসজিদে গিয়ে প্রচার করতেন। বিশ্বনাথে য্দ্ধুকালিন সময়ে রাজাকারদের উপদ্রব ছিল খুবই বেশি। অদ্ভুদ বিষয় যে, সারা দেশ যখন বিজয়ের দ্বারপান্তে, তখন বিশ্বনাথে বিজয়ের পতাকা উত্তোলনে বাধার সৃষ্টি করে দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে ছিল।
মদন মোহন কলেজের অধ্যক্ষ শ্রী কৃষ্ণ কুমার পাল চৌধুরী হরিকলস গ্রামের ভোমকেশ চৌধুরীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ খবর চলে যায় পাক হানাদারদের নিকট। ক্যাপ্টেন করম খানের নেতৃত্বে রাজাকার ও পাকসেনারা ভোমকেশ চৌধুরীর বাড়িতে হানা দেয় এবং কৃষ্ণ কুমার পালকে না পেয়ে ভোমকেশ চৌধুরীকে তুলে নিয়ে হত্যা করে এবং বাড়ি-ঘর পুড়ে ছাই্ করে দেয়। ভাগ্যক্রমে কৃষ্ণ কুমার পাল চৌধুরী প্রাণে বেঁচে যান। বিশ্বনাথের মিষ্টি ব্যবসায়ী আওয়ামীলীগ নেতা কমলগঞ্জের বাসিন্দা ধীরেন্দ্র কুমার দাশকে গুলি করে হত্যা করে পাক বাহিনী। খাজাঞ্চীর কর্মকলাপতি গ্রামের ডাক বিভাগের চাকুরীজীবি বসন্ত কুমার দাশের বাড়ি-ঘর পুড়ে তাকে হত্যা করা হয়। দিঘলী গ্রামের যীতেন্দ্র সেন এবং ছাতক থানার কালিদাশ গ্রামের নারায়ন চন্দ্র সেন সহ তিনজনকে উলঙ্গ করে গুলি করে হত্যা করা হয়। পেশকারের গাঁও গ্রামের আইয়ুব আলী, সুরুজ আলী, নিপেন্দ্র কুমার দাশ সহ ১৫-১৬জন কে একত্র করে নির্মম ভাবে হত্যা করে। জানাইয়া গ্রামের আওয়ামীলীগের বর্ষীয়ান নেতা মনু মিয়াকে হত্যার চেষ্টা করে রাজাকার ও পাক বাহিনী। মনু মিয়া ঘর থেকে বের হয়ে দৌড়ে প্রাণে রক্ষা পান। এসময় একজন মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়। মনু মিয়ার চাচাতো ভাই, ময়না মিয়াকে নামের সাথে মিল থাকায় গ্রেফতার করে পাকসেনারা। পরিচয় পেয়ে ময়না মিয়াকে হত্যা না করে বন্দুকের বাট দিয়ে মারপিট করে চলে যায়। জানাইয়া গ্রামের একজন হিন্দু মহিলাকেও রাজাকারদের সহায়তায় পাক সেনারা ধর্ষন করেছিল। চন্দ্রগ্রাম গ্রামের সুরেষচন্দ্র দাশকে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করে।
দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরীর রামপাশা গ্রামের বাড়ি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং সোনা, গহনা, মূলবান জিনিসপত্র সব লুট করে নিয়ে যায়। সিলেট শহরের লামাবাজারের রনদাশ যুদ্ধের সময় পালিয়ে ফুলচন্ডি গ্রামের সত্যন্দ্র কুমার দাশের বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার কারনে তাকে ক্যাডেট কলেজে নিয়ে অত্যাচার নির্যাতন করা হয় এবং তার বাড়িটিও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। নুরপর গ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা ডা. আব্দুল করিম,পাহাড়পুর লিলু মিয়া, ঘাসিগাঁও গ্রামের ছমরু মিয়াকে ধরে নিয়ে সিলেট ক্যাডেট কলেজ এলাকায় পাকা সেনাদের ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। বরইকান্দির রইছ আলী চেয়ারম্যান কে যুদ্ধকালিন সময়ে হোসেনপুর গ্রামের চেয়ারম্যান পীর লিয়াকত হোসেনের বাড়িতে আশ্রয় দেয়ার কারনে পাকসেনারা তার বাড়িতে কর্মরত একজন কর্মচারীকে গুলি করে হত্যা করে। সরদার পাড়া গ্রামের আব্দুস সাত্তারকে পাকসেনারা ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পে ধরে নিয়ে তাঁর শরীর থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বের করে নির্যাতন করত। কুমারপাড়া গ্রামের সুনা উল্লাহকেও চরম অত্যাচার ও নির্যাতন করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের ৪নং সেক্টরের ১নং কোম্পনী কমান্ডার আব্দুন নূর ৯ ডিসেম্বর বিশ্বনাথ থানাকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করার কথা থাকলেও এক দল রাজাকার ও বিশ্বনাথ থানার ওসি আবুল হোসেন, দারোগা আলী হোসেন শত্রুমুক্ত ঘোষণা ও পতাকা উত্তোলনে বাধার সৃষ্টি করেন। এ খবর শুনে কমান্ডার আব্দুন নূর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিশ্বনাথ থানায় প্রবেশ করে পুলিশ ও রাজাকারদের আত্মসমর্পনে বাধ্য করেন। পরদিন ১০ ডিসেম্বর সকালে রাম সুন্দর অগ্রগ্রামী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে বিশ্বনাথকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করেন কমান্ডার আব্দুন নূর এবং তিনি আব্দুল মতলিব বিএসসিকে প্রশাসক ঘোষণা করেন। এ অনুষ্ঠানে শত শত জনতা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান দিয়ে এলাকা প্রকম্পিত করে তুলে। কমান্ডার আব্দুর নূরের বাড়ী খাজাঞ্চী ইউনিয়নের টিমাইঘর গ্রামে। তিনি কয়েক বছর পূর্বে আমেরিকার মিশিগান শহরে একজন বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন।
মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বনাথ প্রবাসীদের ভূমিকা ছিল খুবই প্রশংসনীয়। যুক্তরাজ্য প্রবাসী সদুরগাঁও এর রমজান আলী, দৌলতপুরের আবুল গউছ চৌধুরী ও জগদিশপুরের কলমদর আলী, জানাই্য়া’র মনু মিয়া, সরওয়ালার ইছকন্দর আলীসহ অনেকেই মুজিবনগর সরকারকে অস্ত্র কেনার জন্য অর্থ দান করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বনাথবাসীর অবদান অপরিসীম। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০বছর পরও মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সঠিক তালিকা হয়নি। ১২৬জন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় রয়েছে। ১২জনের নাম এখনও তালিকাবিহীন। পাঁচজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছেন। এক সময় মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যেক্ষদর্শীদের হয়তঃ খোঁজে পাওয়া যাবে না। তাই এই অঞ্চলের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবী।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *