এ এইচ এম ফিরোজ আলী
আজ বুধবার ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয়ের ৫০তম দিবস। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার। এই দিন তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার সৈন্যবাহিনী নিয়ে পরাজয় মেনে আত্মসমর্পন করেছিল পাকিস্তানিরা। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এ দিনে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যূদয় ঘটেছিল, স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। দেশের স্বাধীনতার জন্য সরকারী হিসাবে ২লক্ষ, বেসরকারীভাবে প্রায় ৫লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। ১৫ লাখেরও বেশি এ দেশের মানুষ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তাদের এ দেশীয় দোসর জামায়াতে ইসলামী, মুসলিমলীগ, নেজামে ইসলামসহ ঘাতক বাহিনীর হাতে নানাভাবে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। ১ কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে শুধু মাত্র জীবন বাঁচাতে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে স্মরণার্থীর বিড়ম্বিত জীবন গ্রহণে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বাধীনতার জন্য পৃথিবীর আর কোন দেশের এত মানুষ জীবন দান, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ত্যাগ শিকার করেননি। মহান এই বিজয়ের মহা নায়ক ছিলেন, একজন। তিনি বাঙালির প্রাণের স্পন্দন। তাঁর সব চিন্তা, চেতনা, স্বপ্ন, দর্শন ছিল, বাংলা ও বাঙালি জাতিকে নিয়ে। চলনে-বলনে, কথা-বার্তায়, আচার-আচরণে, পোশাক-আশাকে, বিচার-বিবেচনায়, আন্দোলন- সংগ্রামে তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ ও খাঁটি বাঙালি। এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি ছিল, তাঁর জীবনের সাধনা। তিনি হচ্ছেন, আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ২০ মিনিটের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার জ¦ালাময়ী ভাষণে, শুধু বাংলাদেশের ৫৫ হাজার বর্গমাইল কাপেনি, প্রকম্পিত হয়েছিল সারা দুনিয়া। ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’। বঙ্গবন্ধু এমন কৌশলি ভাষণ দিয়ে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রস্তুত করেছিলেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রতিনিধিরা ১০ এপ্রিল প্রণীত স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রের আলোকে ১৭এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করেন। যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, যুবক-যুবতি, জেলে, বেঁদে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারসহ নারী পুরুষ। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসক গোষ্টি তাদের দীর্ঘ ২৩ বছরের শাসনামলে বাঙালি যখনি, ন্যায় সংঙ্গত দাবি করেছিল তখনই ধর্মের দোহাই দিয়ে তা কঠোর ভাবে দমন করেছে। এ দেশটাকে তারা শোষন করেছে ইসলামের নামে। আমাদের স্বায়ত্ব শাসন, মায়ের ভাষা বাংলার দাবীসহ সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল, পাকিস্তানি ও তাদের এ দেশীয় এজেন্টদের বিবেচনায়, ইসলাম বিরোধী বা ভারতীয় চক্রান্ত। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। তাই, ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে যখন পাকিস্তানের আইন সভার সদস্য বিশিষ্ট আইনজীবি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি করেছিলেন। তখন পাকিস্তানিরা ধীরেন্দ্রনাথের দাবীকে বিচ্ছিন্ন ও কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিল। ধর্মের নামে বাঙালীকে পাকিস্তানিদের শোষনের মতলব বুঝতে বঙ্গবন্ধুর বেশি সময় লাগেনি। যে কারণে তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তার রাজনৈতিক জীবন ও কর্ম অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনায় বহুমাত্রিকতায় মুর্ত হয়েছিল।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম উম্মেষ ঘটেছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিত্বের চেতনা মুর্ত হয়েছিল রবিন্দ্রনাথের রচনায় ও গানে- যখন তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি,’ বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ূ, বাংলার ফল, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে, স্বার্থক জন্ম আমার জন্মেছি এই দেশে-প্রভৃতি গানে বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা নানা রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। ৬০০ বছর আগে বাংলার কবি চন্ডিদাস লিখেছিলেন-শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাঁহার উপরে নাই, দেড়শত বছর আগে মরমী কবি লালন শাহ লিখেছিলেন ‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে- যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ আর খ্রিষ্টান/জাতিগোত্র নাহি রবে’। প্রায় ১০০ বছর আগে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন,‘ হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন/কান্ডারী বলে ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মোর’। ফলে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল ভিত্তি ছিল মানবতাবাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তান কেন্দ্রীক পাঞ্জাবি শোষক চক্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শোষনের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। ২৩ বছরের সীমাহীন শোষনে পাকিস্তানের উষর মরুভূমি হয়েছিল, শস্য শ্যামল, আর সোনার বাংলা পরিণত হয়েছিল শশ্মাণে। বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের অনীহা বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং বাংলাদেশে গণহত্যার প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা যুদ্ধ অনিবার্য্য হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সংঙ্গে যুক্ত রাখার জন্য নৃশংসতম গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল। পাকিস্তানের এ দেশীয় দোসর ছিল, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলামসহ উগ্র মৌলবাদি গোষ্টি। ইসলাম রক্ষার নামে স্বাধীনতার বিরোধীতা করে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে গঠন করেছে, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও তাদের ঘাতক বাহিনী। এই ঘাতক দলের নেতা ছিলেন গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোজাহিদ, কামরুজ্জামানসহ অসংখ্য তাদের কর্মীবাহিনী। জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রামের’ প্রতিদিনের পাতায় জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আজম, পাকিস্তানকে ইসলামের সমার্থক বানিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তান না থাকলে দুনিয়ার বুকে ইসলামের নাম নিশানা থাকবে না। পাকিস্তানের ৯০ হাজারেরও বেশি নৃশংস সেনাবাহিনী সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান রক্ষায় তারা বাঙালি হত্যায় নেমে ছিল। ১৯৭২ সনের ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু গণপরিষদের প্রদত্ত ভাষণে ধর্ম নিরপেক্ষতা সম্পর্কে বলেছিলেন- ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ধর্ম কর্ম করার অধিকার থাকবে। মুসলমানরা মুসলমানদের ধর্ম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টানরা তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাঁধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন না। ২৫ বছর দেখেছি, ধর্মের নামে শোষন, ধর্মের নামে ব্যাভিচার, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ধর্ষণ, বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলছে। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার চলবে না। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের শুধু সামরিক পরাজয় হয়নি। তাদের ধর্মের নামে রাজনীতি, হানাহানি, হত্যা ও ধ্বংসের পরাজয় ঘটেছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল সকল ধর্মের মানুষ ধর্মীয় বিভাজনের উর্ধ্বে উঠে অসাম্প্রধায়িক বাঙালিত্বের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ থাকার কারণে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন, এই চেতনার প্রধান রূপকার, যার ভিত নির্মাণ করেছিলেন, কবি গুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির ঐক্যে পাকিস্তান ভেঙে ধর্মের নামে রাজনীতি ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ভেঙ্গে গিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য যে, এ দেশটি অধিকাংশ সময় শাসন করেছে পাকিস্তানপন্থি’ মৌলবাদী সাম্প্রদায়ীক অপসক্তি। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে যখন গণহত্যার কথা উঠে, তখন বাংলাদেশ থেকে সমর্থন জানান বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মের নামে জিয়াউর রহমান বাঙালি-বাংলাদেশী ধর্ম নিরপেক্ষতা-ইসলাম সমরতন্ত্র-গণতন্ত্র প্রভৃতি দ্বন্দ্বে বিভক্ত করেছিলেন। ১৯৭২ সালের সংবিধান কার্যকর থাকলে একদিনে ৬৪ জেলায় বোমা হামলার সাহস কেউ করতো না। ধর্মের নামে হানাহানি জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ বোমাবাজদের সৃষ্টি হত না।
ব্রিটিশরা যখন ঔপনিবেসিক শাসন ছেড়ে চলে যাবে, তখন এ ভুখন্ডে বসবাসকারীদের হিন্দু-মুসলমান দু-ভাগ করে দেয়। ব্রিটিশদের চক্রান্তে পাকিস্তান ভারত দু্িট রাষ্টের সৃষ্টি হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশে) ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পায় আওয়ামী লীগ। ভোট পেয়েছিল ৭২.৫৭ শতাংশ। এই নির্বাচন ছিল ৬ দফার ভিত্তিতে। কিন্তু ২৭.৪৩শতাংশ লোক ভোট দেয়নি স্বাধীনতার পক্ষে। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, এই লোকগুলো ৬ দফা ও স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল। এরাই মুক্তিযুদ্ধে আলবদর, রাজাকার, আশসামস বাহিনী গঠন করে। ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথের রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবী করেছিলেন, তখন পূর্ব পাকিস্তানের ১১০জন বুদ্ধিজীবি বিবৃতি দিয়েছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে।
১৯৩৭ সালে আমাদের ইসলামী জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম ফরিদপুরে এসেছিলেন। সেখানে কবিকে এক রাত পানিও পান করতে দেয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, এটা হিন্দু হয়ে গিয়েছে শ্যামা সঙ্গীত লিখেছে, ভজন লিখেছে, অতএব, সে আর মুসলমান নেই। সেই ধারাবাহিকতায় দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পর বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে নতুন কণ্ঠে পুরাতন সুর ভেসে উঠেছে। এ কথা বুঝতে হবে যে, বঙ্গবন্ধু সাংবিধানিক ভাবে বাঙালির জাতির পিতা। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সমার্থক। বাংলাদেশের মানচিত্র হচ্ছে তার প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে বিরোধীতা করার কোন সুযোগ নেই। বিজয় দিবসে দেশী বিদেশী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সবাইকে রুখে দাড়াবার অঙ্গীকার করতেই হবে।
লেখক
কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক