মাহমুল আলম, খবরের কাগজ : বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক বিভিন্ন মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করার অভিযোগ সামনে আসছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা কথা বলেছেন। আইনজ্ঞরা বলছেন, যার বিরুদ্ধে অসত্য অভিযোগ আনা হচ্ছে, রায়ে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হলে মামলাকারীর সমান শাস্তি হতে পারে। অর্থাৎ দোষী প্রমাণ হলে আসামির যে শাস্তি হতো, নির্দোষ প্রমাণ হলে মামলাকারীকে একই শাস্তি দেওয়া হতে পারে।
তাদের মতে, মামলায় ঢালাওভাবে লোকজনকে আসামি করা বন্ধ করতে চাইলে যারা এসব মামলা করেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত থাকতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ না থাকার কারণে সরকার বিব্রতবোধ করার কথা বললেও মিথ্যা মামলা দায়ের অব্যাহত আছে।
কোনো অন্যায় বা বেআইনি কর্মকাণ্ডের দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার আছে। এ কারণে মামলা-মোকদ্দমার প্রয়োজন হয়। কিন্তু অনেক সময় কাউকে হয়রানি বা সামাজিকভাবে হেয় করতেও মামলা করা হয়। অনেকে আবার মিথ্যা সাক্ষ্যও দিয়ে থাকেন। মিথ্যা মামলা করা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া- দুটিই ফৌজদারি অপরাধ এবং এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে।
খবরের কাগজের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আইনজীবীরা বলছেন, মিথ্যা অভিযোগকারী কিংবা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো, ওই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে হবে। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের যদি মনে হয়, আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা, ভিত্তিহীন, তুচ্ছ, বিরক্তিকর বা হয়রানিমূলক এবং আসামির প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে মামলাটি করা হয়েছে, তাহলে এ ধরনের মামলা মিথ্যা মামলা হিসেবে গণ্য হবে। মামলা মিথ্যা বা ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হলে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগকারী বা মামলা দায়েরকারীকে দণ্ড দিতে পারেন। এ ছাড়া সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বাদী হয়ে পৃথক মামলা দায়ের করতে পারেন।
মামলা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হলে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিতে পারেন। এমনকি আদালত মিথ্যা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে দণ্ডমূলক ব্যবস্থাও নিতে পারেন। আমলযোগ্য নয়- এ রকম কোনো মামলায় কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তার বিরুদ্ধেও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ দিতে পারেন।
কারও বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বরিশাল পুলিশ লাইনসে এক অনুষ্ঠান শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘এখন অনেক মামলা হচ্ছে, তাতে অনেক নিরপরাধ লোকের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি বাহিনীর প্রধানদের বলছি, যারা এ ধরনের মামলা করছে, তাদের বিরুদ্ধেও অ্যাকশন নেওয়ার জন্য।
তিনি বলেন, ‘যদি এ ধরনের মামলা নেওয়া হয়, তাহলে বাদীর বিরুদ্ধে যেন অ্যাকশন নেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমরা এ ধরনের একটি সার্কুলার দিয়েছি, যেন এ ধরনের মামলা না নেওয়া হয়।
গত ২১ অক্টোবর তেমন একটি মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। যিনি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ মানবাধিকার পরিপন্থি নানা আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। আবার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা নেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে আদালতেও লড়েছিলেন সিনিয়র এই আইনজীবী।
আবার অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু সিদ্ধান্তের সমালোচনাও করেন মুক্তিযোদ্ধা জেড আই খান পান্না। বিশেষ করে সংবিধান পুনর্লিখন ভাবনার কঠোর সমালোচক তিনি। তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে যে সংবিধান রচিত হয়েছে, তার ঘোষণাপত্র পাল্টানো যাবে না। যদি করে, তাহলে যুদ্ধ না, মহাযুদ্ধ হবে।
এ কথা বলার পর গত ১৭ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক এই হত্যাচেষ্টা মামলায় তাকে আসামি করা হয়। গত ১৯ অক্টোবর দৈনিক খবরের কাগজের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘ছাত্র আন্দোলনে মিছিলকারীরাও আসামি’। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মিছিলের অগ্রভাগে থাকা মানুষকেও হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে নারীরাও রয়েছেন। মামলার বাদী আবার এসব নারী আসামিকে চেনেনও না। মামলায় এক নারী আসামিকে পুরুষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকা হত্যার ঘটনাস্থল হলেও ঢাকার বাইরে থাকা অনেককেও আসামি করা হয়েছে।’
রাজধানীর ধানমন্ডির মোহাম্মদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অভিভাবক হিসেবে মিছিলের অগ্রভাগে থাকা ‘গৃহিণী শামীমা’, নাটোরের সিংড়া থানার কৃষক আজিজ, মুন্সীগঞ্জের সাঈদ শেখ, গাজীপুরের মোজ্জামেল হক কাকন, কেরানীগঞ্জের সরোওয়ার্দী শেখের ভোগান্তির উদাহরণ দিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। মামলার বাদী বাছিরুল নিজেই প্রতিবেদককে জানান, তিনি মামলা করেননি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সাম্প্রতিক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলে শনিবার (১৬ নভেম্বর) জেড আই খান পান্না দৈনিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ প্রতিবেদন দেওয়ার পর আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যা অভিযোগে মামলাকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। এমন উদাহরণও আছে। তবে তা খুবই রেয়ার। এতটাই রেয়ার যে, তা এখন চট করে স্মরণও করতে পারছি না।’
হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। আদালতে তার পক্ষে শুনানি করেন আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম।