পাঠ্যবই সংশোধনের কমিটি নিয়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর চাপ, যা ঘটেছে

সারাদেশ
শেয়ার করুন

অনলাইন ডেস্ক :: বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রণীত ও মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিলের পর এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। তবে শনিবার ওই কমিটি বাতিলের পর এনসিটিবি কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বাতিলের কোন কারণ উল্লেখ বা ব্যাখ্যা করেনি।

যদিও গত পনেরই সেপ্টেম্বর ওই কমিটি গঠনের পর দুজন সদস্য- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন ও সামিনা লুৎফার বিষয়ে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনের নেতারা প্রকাশ্যেই আপত্তি তুলে কমিটি পুনর্গঠনের দাবি করেছিলেন।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান এবং বাতিল হওয়া কমিটির একজন সদস্য অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বিবিসি বাংলাকে অবশ্য বলছেন এই কমিটি বাতিলের কারণ তারও জানা নেই।

“ওই কমিটির দুটি বৈঠক হয়েছিলো। এখন বাতিল হওয়াতে পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন কার্যক্রমে কোন সমস্যা হবে না। বিষয় ভিত্তিক শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে পরিমার্জনের কাজ শেষ পর্যায়ে আছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

বিষয়টি নিয়ে অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি। আর সামিনা লুৎফা ফোন রিসিভ করেননি।

তবে অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন ও সামিনা লুৎফা দুজনই শিক্ষক নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত।

এর সাথে জড়িত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন আওয়ামী লীগ যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় থাকার জন্য ধর্মভিত্তিক নানা সংগঠনকে প্রশ্রয় দিয়েছিলো, তাদের বিভিন্ন দাবির প্রতি নমনীয় হয়েছিলো।

“এটি দীর্ঘমেয়াদের দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে এবং এখনো তারই প্রতিফলন ঘটছে। বর্তমান সরকারের জনসমর্থন আছে। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের অবস্থান দুর্বল এবং তাদের মধ্যে আত্মসমর্পণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে,” বলছিলেন তিনি।

আরও পড়তে পারেন:
এনসিটিবি বলছে কমিটি বাতিল হলেও পরিমার্জনের কাজ চলছে।
ছবির ক্যাপশান,এনসিটিবি বলছে কমিটি বাতিল হলেও পরিমার্জনের কাজ চলছে।

প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ আমলে হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছিলো, যা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিলো। হেফাজতে ইসলামের ২৯টি প্রস্তাবকে গ্রহণ করতে গিয়ে ২০১৭ সালে ছাপানো বইয়ে ব্যাপক সংযোজন বিয়োজন করা হয়েছিলো।

এমনকি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি গল্প সপ্তম শ্রেণির বইয়ে ছাপা হওয়ার পরেও হেফাজতের চাপে বাদ দেয়া হয়েছিলো।

চলতি বছরেই হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে সচেতনতামূলক পাঠ ‘শরীফার গল্প’ কিছু ধর্মভিত্তিক সংগঠনের দাবির মুখে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো আওয়ামী লীগ সরকার।

অনেকেই মনে করছেন এবারেও অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মভিত্তিক কিছু দল ও গোষ্ঠীর চাপেই পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের জন্য গঠিত কমিটি বাতিল করলো।

এছাড়া বাংলাদেশে চলতি বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কয়েকটি শ্রেণিতে নতুন একটি কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম চালুর যে সিদ্ধান্ত ছিলো সেই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই বাতিল করেছে।

পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সরব হয়েছে বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন
ছবির ক্যাপশান,পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সরব হয়েছে বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন

পরিমার্জন কমিটি নিয়ে কী হয়েছে

শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত পনেরই সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খ ম কবিরুল ইসলামকে আহবায়ক করে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য দশ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে।

ওই কমিটিতে অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন ও সামিনা লুৎফাকে রাখা হলে মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত মজলিস নেতা মামুনুল হক প্রকাশ্য সভায় ‘ইসলাম বিদ্বেষী হিসেবে’ তাদের দিকে ইঙ্গিত করে ওই কমিটি পুনর্গঠন করে কমিটিতে তার ভাষায় ‘আলেম ওলামাদের’ অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান।

এর আগে কমিটি গঠনের পর সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় আসা আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আহমাদুল্লাহ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় লিখেন “ধর্মপ্রাণ মানুষের সন্তানরা কি পড়বে, তা ঠিক করবে চিহ্নিত ধর্ম বিদ্বেষীরা!” এর আগে তিনি দুজনের নাম উল্লেখ করে পোস্ট দিলেও পরে নাম সরিয়ে নেন।

আবার ২৬শে সেপ্টেম্বর জামালপুরে এক সভায় খেলাফত মজলিস নেতা মামুনুল হক অভিযোগ করেন “শিক্ষা কমিশন নামে যে কমিশন গঠন করা হয়েছে তার মধ্যে সমকামিতার প্রমোটকারী রয়েছেন”। তিনি তাদের বাদ দেয়ার দাবি করেন।

কিন্তু কেন কমিটির বিরোধিতা করা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী বিবিসি বাংলাকে বলেন “এখানে এমন কিছু লোককে রাখা হয়েছিলো যারা ইসলাম বিদ্বেষী ও নাস্তিকতা লালন করেন। এদের দ্বারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পাঠ্যপুস্তক হতে পারে না। এ কারণেই আমরা ওই কমিটির বিরোধিতা করেছি”।

কিন্তু ওই কমিটি তো ইসলামি শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন কিংবা ইসলামি ধারার বইপুস্তক নিয়ে কাজ করছিলেন না। তাহলে ধর্মভিত্তিক দলের নেতারা এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যে ধর্ম লালন করে শিক্ষায় সেটিই গুরুত্ব দিতে হবে। বিদেশি বা অন্য সংস্কৃতির কিছু সেখানে থাকবে কেন?”

আরও পড়তে পারেন:
হেফাজতে ইসলামের চাপে আওয়ামী লীগ সরকার পাঠ্যবইতে অনেক পরিবর্তন এনেছিল
ছবির ক্যাপশান,হেফাজতে ইসলামের চাপে আওয়ামী লীগ সরকার পাঠ্যবইতে অনেক পরিবর্তন এনেছিল

সর্বশেষ শনিবার কমিটি বাতিলের পর এক পক্ষ সরকারের সমালোচনা করছে ‘ধর্মভিত্তিক সংগঠনের নেতাদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করায়’।

আবার এসব সংগঠনের সঙ্গে জড়িত বা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীলরা পাল্টা প্রচারণা চালিয়ে কমিটি বাতিলের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলছেন আগের সরকার নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ধর্মান্ধদের প্রশ্রয় দিয়ে হাতে রাখার কৌশল নিয়েছিলো এবং সেটিই দীর্ঘমেয়াদে দেশের ক্ষতি করেছে।

“এ সরকারের আমলে এটি প্রত্যাশিত নয়। কারণ এ সরকারের জনসমর্থন আছে। তাকে ধর্মীয়, লিঙ্গীয় ও জাতিগত বৈচিত্র্য স্বীকার করতে হবে। না হলে বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়া যাবে না,” বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলছেন, পরিমার্জন কমিটি গঠন ও বাতিল -কোনটিই সরকার ঠিক ভাবে করেনি।

“ওই কমিটি গঠনটিই যৌক্তিক হয়নি। আবার যেভাবে বাতিল করা হলো তাও সঠিক হয়নি। এটি তো শুধু বইয়ের মলাট, শ্লোগান, গল্প, কবিতা পরিবর্তনের বিষয় নয়। কারিকুলাম এমন হতে হবে যার ওপর ভিত্তি করে একজন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হবে, বিশ্ব নাগরিক হবার ভিত পাবে। কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তকে তার প্রতিফলন থাকতে হবে। অথচ এ কমিটিতে কারিকুলাম যারা বোঝেন বা এ নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের কাউকে রাখা হয়নি”।

পুরো প্রক্রিয়াতে শিক্ষার প্রতি নিদারুণ অবজ্ঞাই ফুটে উঠেছে বলে তিনি মনে করেন।

“আমাদের পাঠ্যপুস্তক হতে হবে আমাদের শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা, অভিভাবকরা চাহিদা, জব মার্কেটের অবস্থা, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি যাতে ধর্মও গুরুত্বপূর্ণ-এর সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে। কিন্তু এগুলোকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি” তিনি বলছেন।

তার মতে, সব পক্ষের অংশগ্রহণে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে তার মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রমে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা পরিমার্জন আনার চেষ্টা হলে তা যৌক্তিক হতো।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *