এ এইচ এম ফিরোজ আলী ::
১৭মে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরনীয় ও মর্যাদাপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক দিন। ৫বছর ৯মাস ১৭দিন নির্বাসনে থাকার পর দেশে ফিরে এসেছিলেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা এক রাতে সকল স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে সামরিক শাসকের সকল ষড়যন্ত্র, বাঁধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে ছুটে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে। তিনি দেশে ফিরে এসে অনেক আন্দোলন সংগ্রামের পর রাষ্ট্রক্ষমতা আরোহন করে বিশে^ বাংলাদেশকে উচু আসনে প্রতিষ্টিত করেছেন। যে কারনে বিশে^র অনেক দেশ, জ্ঞানী গুণি বিশ^বিদ্যালয় গবেষকরা শেখ হাসিনার পরিশ্রম-ত্যাগ রাজনীতি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ভুয়সী প্রশংসা করছেন। বাঙালির জীবন মান পরিবর্তনে শেখ হাসিনা একজন ক্যারিশম্যাটিক ও বিশনারী লিডারের খ্যাতি অর্জন করেছেন। বিশে^র চোখে এখন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি দাতা।
শেখ হাসিনার জীবন রূপকথার ফিনিক্স পাখির মত। তিনি ধবংষযজ্ঞের মধ্যে টিকে থাকার সক্ষমতা ও ভস্মের মধ্য থেকে উড়াল দেয়ার যোগ্যতা দেখাচ্ছেন। তাঁর অঙ্গীকার যেন, তিনি হারতে নারাজ। শেখ হাসিনার জীবন কাহিনী সত্যিই বিরল ও বিষ্ময়কর। পিতার রাজনীতির জীবনে দু:সাহসিকতা ও সততার প্রভাব তাঁর দেহ মনে। শেখ হাসিনা এখন বিশে^র কাছে সততা ও সাহসিকতার মুর্তপ্রর্তীক।
শেখ হাসিনার স্বামী বিশিষ্ট পরমানু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন, একজন বিস্ময়কর মেধাবি ব্যক্তি। তিনি উচ্চ শিক্ষায় বৃত্তি নিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে লেখা পড়া করছিলেন। বিবিসি বাংলার বর্ণনা মতে, ১৯৭৫সালের ৩০জুলাই শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শিশু পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় ও শিশু কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নিয়ে জার্মানিতে যান। ৯আগষ্ট জামার্নির কার্লস শহর থেকে বন শহরে এবং সেখান থেকে বেলজিয়ামের রাজধানি ব্রাসেলসে যান। ১৯৭৫সালের ১৫আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার সময় তাঁরা ব্রাসেলসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদুত সানাউল হকের বাসায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকেই নিয়োগ দিয়েছিলেন। ব্রাসেলসের সময় ভোর সাড়ে ৬টায় জার্মানির রাষ্ট্রদূত হুমায়ুর রশিদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বপরিবারে হত্যাকান্ডের ঘটনা টেলিফোনে সানাউল হককে জানান। এ সংবাদ পেয়েই সানাউল হক শেখ হাসিনাসহ, সকলকে বাসায় আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানান। এমন কি চাইলে তাঁর গাড়িও দেননি। একথা ঢাকার এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমরা যেন উনার (সানাউল হকের) বুঝা হয়েছিলাম,।
অবশেষে ড. ওয়াজেদ মিয়া সকলকে নিয়ে জার্মানিতে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসায় পৌছান। আধাঘন্টা পর যুগোস্লাভিয়ায় সফরে আসা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন সে বাসায় পৌছান। ড. ওয়াজেদ মিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে বিনয়ের সহিত অনুরোধ করে বলেছিলেন, খন্দকার মোস্তাক যদি আপনাকে মন্ত্রীসভায় যোগদানের অনুরোধ করেন, তাহলে আপনি কোন মতেই যোগদান করবেন না। তাঁর কথা রক্ষা করেছিলেন ড. কামাল হোসেন। তখন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটু বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার খোজ খবর নিতে হুমায়ুর রশিদকে টেলিফোন করেছিলেন। জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ওআই পুরীরকে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে ভারতে আশ্রয়দানে অনুরোধ করলে পরদিন দুই রাষ্ট্রদূত একত্র হয়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরাগান্ধির পরামশ্য দাতা ভিপিধর ও পিএন হাক্সরের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন। তখন তাঁরা দু’জন দেশের বাইরে ছিলেন। নিরুপায় হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী একজন রাষ্ট্রদূত হয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরাগান্ধির সাথে টেলিফোনে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে ভারতে আশ্রয় দানের অনুরোধ করেন। ইন্দ্রিরাগান্ধি রাজি হয়ে ১৯আগষ্ট তাদেরকে দিল্লিতে পাঠানোর নির্দেশ দিলে ৫দিন পর ২৪আগষ্ট ইয়ার ইন্ডিয়া বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে শেখ হাসিনা ভারতের পালাম বিমানবন্দরে পৌছান। তারপর ৪সেপেটম্বর শেখ হাসিনা ইন্দ্রিরাগান্ধির সাথে দেখা করলে, ইন্দ্রিরাগান্ধি শেখ হাসিনাকে শান্তনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এক ছেলে, এক মেয়ে আছে, তাদেরকে তোমার মা-বাবা মনে করে জীবনে বেঁচে থাকো’। সত্যঘোষ ও পিকে সেন নামের দুজন পুলিশ অফিসার শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। এক পর্যায়ে ভারতও শেখ হাসিনার জীবন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ১৯৮০সালে আয়ামীলীগের শীর্ষ নেতারা ভারতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে আসার বিষয়ে আলাচনা করেন।
১৯৮১সালের ১৪-১৬ফেব্রুয়ারী আওয়ামীলীগের সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের সভাপতি নির্বাচিত করেন। ২৪ফেব্রুয়ারি আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতা আব্দুল মালেক উকিল, জিল্লুর রহমান, ড. কামাল হোসেন, আব্দুস সামাদ আজাদ, আব্দুল মান্নান, জোহরা তাজ উদ্দিন, বেগম সাজেদা চৌ, এম কুরবান আলী, আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, আইভি রহমান, বেগম শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ভারতে গিয়ে শেখ হাসিনার সাথে স্বাক্ষাত করেন। এসময় শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দিল্লীতে কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ড. কামাল হোসেন ও সাজেদা চৌধুরীকে রেখে সবাই দেশে ফিরে আসেন। তাঁরা দু’জন শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন-তারিখ নির্ধারণ করেন। ১৭মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিন কিংবা ২৬মার্চ স্বাধীনতা দিবসে আসার দিন ধার্য করা হলে জয় ও পুতুলের পরীক্ষা ও পুতুলের জলবসন্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তারিখ পরিবর্তন করে ১৭মে নির্ধারণ করা হয়।
বিবিসি ও আকাশবানী, কলকাতা সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সংবাদ প্রচারের পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও স্বাধীনতা বিরোধী চক্র সারাদেশে লিফলেট ও হ্যান্ড বিল বিতরণ করে, শেখ হাসিনার আগমনে প্রতিরোধের ডাক দেয়। অন্যদিকে আওয়ামীলীগের নির্যাতিত নিপীড়িত হতাশাগ্রস্থ নেতাকর্মীরা হাঁস-মোরগ হালের বলদ বিক্রি করে বঙ্গকন্যাকে দেখতে ও বরণ করতে দুই তিনদিন আগে থেকেই ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তখন অত্যাধুনিক ট্রেইন ও বাস ছিল না। মুরির টিন বাস ও মেইল ট্রেইনে ঢাকা আসা-যাওয়া ছিল এক মাত্র অবলস্বন। ঢাকার আশপাশে নেতাকর্মীরা পায়ে হেঁটে রেলষ্ট্রেশনে, বিপনী বিতানের বারান্দায় ও কম টাকার হোটেলে চাড়পোকার কামড় খেয়ে ঢাকায় ছিলেন। অধিকাংশ নেতাকর্মীর হাতে লুঙ্গি, গেঞ্জি ও গামছা ছিল।
১৭ মে ছিল রবিবার। সেই প্রতীক্ষিত মহেন্দ্রক্ষন। সেদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি ও তুফানের মধ্যে বিমান বন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। ঢাকা ছিল মিছিলের নগরি। রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার নেতাকর্মী বৃষ্টির মধ্যে তালগাছের মত দাঁড়িয়ে ছিলেন। সকলের মুখে ছিল, স্বাধীনতার অমর শ্লোগান, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, ‘ঝড় বৃষ্টি আধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে, শেখ হাসিনার আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম, শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছিল ঢাকার আকাশ-বাতাস। বিকাল ৪টায় যখন শেখ হাসিনাকে বহনকারি বিমানটি ঢাকার আকাশে দেখা মাত্রই সকল শৃঙ্খলা ভেঙ্গে আবেগীজনতা কুর্মিটুলা বিমানবন্দরে ঢুকে যায় এবং বিমানের সিড়িতে শেখ হাসিনার চেহারা দেখা মাত্রই হাজার হাজার নেতাকর্মী হাউ-মাউ করে কাঁদতে থাকেন। বিমান বন্দর থেকে শেরে বাংলা নগরের সভামঞ্চে পৌছতে সময় লাগে ৩ঘন্টা। সেদিন কার মিছিলে যোগ দেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
সন্ধা সাড়ে ৭টায় শেখ হাসিনা গণসম্বধনা মঞ্চে উঠার পর চর্তুদিকে হাত নাড়ালে ইতিহাসের সব চেয়ে বড় করতালির ঢেউ দেখা গিয়েছিল। প্রায় ১০লক্ষাধিক লোকের অধিক সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমার চাওয়া-পাওয়া ও হারাবার কিছু নেই, পিতা-মাতা ও ভাই শেখ রাসেলকে হারিয়ে আপনাদের মাঝে এসেছি, আমি আপনাদের মেয়ে, বোন হিসেবে আপনাদের পাশে থাকতে চাই। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধে নিজের জীবন উৎসর্গ, মুক্তিযোদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাঁসি ফোটাতে চাই। এসময় লাখো লাখো জনতা হাত তুলে তাঁর বক্তব্য সমর্থন জানিয়ে ছিল।
দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর ৯৬সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী ও টানা ৪বারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশকে উন্নয়নের চুড়ান্ত গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার পথে ২১বার ঘাতকের হামলার শিকার ও কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। পিতা মুজিবের মতোই অসীম সাহসীকতা ও জাদুকরি নেতৃত্ব নিয়ে চলায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গঠন আজ এক বিমূর্ত সত্য। যোগাযোগ খাতে বিপ্লব, পারমানবিক বিদুৎ প্রতিষ্ঠা, ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো, পায়রা সমুদ্র বন্দর, মাতার বাড়ি প্রকল্প, গভীর সমুদ্র বন্দর, বছরের প্রথম দিনে ১০কোটি বই বিতরণ, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, পোষাক, মানবসম্পদ, মৎস, ঔষধ রপ্তানী, প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বিশ^ ফোরামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। দেশি-বিদেশি সকল সমালোচনা হজম করে শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ^ ইতিহাসে নজির স্থাপন করলেন। বিশে^র বিভিন্ন দেশ দারিদ্র পিড়িত ও তলা বিহীন ঝুড়ি দেশে এমন অবকাঠামো দেখে অবাক হচ্ছেন। শেখ হাসিনা একজন কৃতজ্ঞ নারী। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী চরম দূদিনে জীবনের ঝুকি নিয়ে দুই সন্তান ও বোন রেহানার জীবন বাঁচাতে প্রাণপন চেষ্টার কৃতজ্ঞতার স্বরুপ হুমায়ুর রশীদ চৌধুরীকে সংসদের স্পীকার বানিয়ে ছিলেন। মুজিব নগর সরকার গঠনে কুষ্টিয়ার সিএসপি অফিসার তৌফিক এলাহিকে তাঁর উপদেষ্টা বানিয়েছেন। বিশ^সেরা অর্থনীতিবিদ শাহ এসএম কিবরিয়া, আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে অর্থমন্ত্রী ও ড. আব্দুল মোমেনকে বিভিন্ন অবদানের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন। সর্ববস্তায় বিশ^ মিডিয়ায় শেখ হাসিনা এখন মানবিক, মৃত্যুঞ্জয়ী, প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের নতুন ইতিহাসের নির্মাতা।
লেখক কলামিষ্ট ও সিলেট জেলা আওয়ামীীগের সদস্য
এএইচএম ফিরোজ আলী