স্বাধীনতার পর আওয়ামীলীগের বড় অর্জন পদ্মা সেতু নির্মাণ

Uncategorized
শেয়ার করুন

এএইচএম ফিরোজ আলীঃ এশিয়া মহাদেশের প্রাচীনতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নাম বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ। বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভাষা, শিক্ষা-সাংস্কৃতির মুক্তির সংগ্রামে দলটি ওতোপ্রতভাবে জড়িত। স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে শুরু হওয়া দলটি জাতির প্রতিটি সংকট, দুর্যোগ, দূর্বিপাকে পাশে থাকা আমজনতার দল হচ্ছে, আওয়ামীলীগ। গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রবল প্রতিকূলতায় জীবনবাজি রেখে সংগ্রাম করেছেন দলের লাখো নেতাকর্মীরা। দলটি এ দেশের মানুষের মাতৃ সংগঠন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পঞ্জিভূর্ত ক্ষোভের বর্হিপ্রকাশ আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য। ১৭৫৭সালের ২৩জুন নবাব সিরাজউদ্দলার পতনের তারিখটি দলের প্রতিষ্ঠার জন্য বেঁচে নেয়া হয়। এ বছর ২৩ জুন দলটির ৭৩বছর পূর্ণ হল।
বঙ্গবন্ধু ভাল করে জানতেন, সাংগঠনিক শক্তির আবশ্যকতা। তাই তিনি ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৯সালে ২৩ জুন পাকিস্তানের প্রধান বিরোধীদল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠা করা হয় । এদিন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি ও সামছুল হক সাধারন সম্পাদক এবং জেলে থাকা বঙ্গবন্ধুকে যুগ্ম সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৩-৬৫ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর দলের সাধারন সম্পাদক এবং ১৯৬৫-৭৪ সাল পর্যন্ত ৮বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের ২৪ বছর শাসনে ১২ বছর জেল খেটেছেন তিনি। আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠার পর দিন থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেননি দলের নেতাকর্মীরা। তবুও নব চেতনা, নব-উৎসাহ উদ্দিপনা, দৃঢ় মনোবল নিয়ে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ছিলেন নেতাকর্মীরা। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রুন্ট নির্বাচন, ৬২’র সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামীলীগের সংগ্রামের যাত্রা তীব্র হয়ে উঠে। পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব মতে, ১৯৪৯-৬৯ সাল সময়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করা হয়েছিল, ৩,১১২ কোটি টাকার সম্পদ। ১৯৫৪-৬৯ সাল সময়ে রাজস্ব ও উন্নয়ন খাতে মাথা পিছু ব্যয় পূর্ব পাকিস্তানে ছিল, ৭০-২৪০টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয়েছিল ৩৯০-৫২১টাকা। এ কারনেই স্বাধীনতা সংগ্রাম অনিবার্য হয়েছিল। ৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জনে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক অপমৃত্যু ঘটে এবং স্বাধীনতার পথ প্রসারিত হয়। ৭১’র ৭ মার্চ মুক্তির মোহনায় দাঁিড়য়ে ভাষণে তর্জনী তুলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। আমি যদি হুকুম নাও দেবার পারি, তোমরা সবকিছু বন্ধ করে দেবে।’ দীর্ঘ ৯মাস যুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা।
১৯৬৬সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের বিরোধী দল সমূহের জাতীয় কনভেনশনে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবী পেশ করেন। ১৮-২০ মার্চ আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ছয় দফা অনুমোদন হয়। এ ছয় দফা ছিল পাকিস্তানের জন্য রাজনৈমিক এক এটেম বোমা। জেনারেল আইয়ুব খান ছয় দফাকে ‘বিচ্ছন্নতাবাদী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ধ্বংসাত্বক আখ্যা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ১নং দুশমন চিহ্নিত করে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের হুমকি দেয়’। দৃঢ় প্রত্যয়ই বিচক্ষণ বঙ্গবন্ধু বিচলিত না হয়ে ছয় দফা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। ২০ মার্চ থেকে ৮ মে ৩৫দিন সময়ে বঙ্গবন্ধু ৩২টি জনসভা করে বিদ্যুৎ গতিতে সারা বাংলায় ছয় দফা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। আইয়ুব-মোনায়েম খানের সরকার ভীত হয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা রুজু করে এবং ১২টি মামলায় হুলিয়া জারী করে। ৮ মে নারায়নগঞ্জে সর্ববৃহৎ জনসভা থেকে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু সহ ৮শত নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। ৭ জুন দেশব্যাপী হরতাল ডাকা হলে তেজগাঁও শ্রমিক নেতা মনু মিয়া পুলিশের গুলিতে নিহত হন এবং শত শত নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। ১৫ জুন ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তফাজ্জুল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার ও পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে আবার ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে আটক করা হয়। ৬৯ সালে ১৮ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে ৩৫জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। জনতা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে বঙ্গবন্ধু পদে ভূষিত করে। ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তরুণ শেখ মুজিব মন্ত্রী হয়েও দলকে সুসংগঠিত করতে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেন। মন্ত্রীত্বের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়, এমন শিক্ষা দিয়েই দলের নেতাকর্মীদের আদর্শবাদী করে তুলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে সর্বোত্তম যে কাজটি করেছিলেন, তা হচ্ছে, দলের ভেতর ত্যাগী-নীতি-আদর্শবান হাজার হাজার কর্মী তৈরী করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ে দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানের জেলে বন্দি থাকাবস্থায় রণাঙ্গণে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান দিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেন।
১৯৮১সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জাতীয় সম্মেলনে নির্বাসনে থাকা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হলে এ বছর ১৭মে তিনি দেশে ফিরে আসেন। সে দিন তাঁকে দেশে আসতে বাধা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সকল বাধা-আপত্তি ও সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমানের লাল চোখ উপেক্ষা করে বাংলার মানুষের কাছে ফিরে আসেন। শেখ হাসিনার দেশে ফেরার দিন প্রচন্ড ঝড়, বৃষ্টির মাঝে লাখো জনতা শেখ হাসিনাকে মিছিলে মিছিলে বরণ করেছিলেন। সেদিন নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে আবেগ উচ্ছাস, আস্থা, বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, আজ অবধি সেই আস্থা, বিশ্বাস ধরে রেখেছেন শেখ হাসিনা। তাঁর সাহস, সততা, দৃঢ়তা এবং রাজনৈতিক বিচ্চক্ষণতার নিকট পরাভূত হয়েছে সব ষড়যন্ত্র। ৪১টি বছর ধরে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই আওয়ামীলীগ চারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয়েছে। শেখ হাসিনার জীবননাশের জন্য কম পক্ষে ২১বার হামলা হয়েছিল। ২০০৪ সালে ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে গেলেও আহত হন তিনি। এ ঘটনায় আইভি রহমানসহ ২৪জন নিহত হন। ১৯৮৮সালের চট্টগ্রামে লালদিঘী ময়দানেও হামলার টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা। ২০০০ সালের ২০ জুলাই কোটালি পাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুতে রাখা হয়েছিল তাকে হত্যার জন্য। কারাবরণ, কারানির্যাতন, সাজানো মিথ্যা মামলায় হয়রানী সত্বেও দৃঢ় চিত্তে এগিয়ে চলেছেন সেই ছাত্র জীবন থেকে রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেয়া শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ৮ মাস কারাবন্দি ছিলেন সপরিবারে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, ভোট ও ভাতের অধিকার আদায় সংগ্রামে সামনের সারীর যোদ্ধা ছিলেন শেখ হাসিনা। ২০০৭ সালে সেনা শাসিত সরকারের আমলেও জেলে বন্দি ছিলেন তিনি। দলের নেতাকর্মীদের একমাত্র আশ্রয়স্থল হচ্ছেন, শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রতিবাদী অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা ও দেশত্যাগী করা হয়। ২০০১সাল থেকে ২০০৬সাল পর্যন্ত ২৬ হাজার নেতাকর্মীকে খুন করা হয়েছিল।
আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠার পর এ ভূখন্ডের সকল প্রাপ্তি ও অর্জন সবই হয়েছে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নতি হয়েছে। ২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে। এখন থেকে মাত্র দুই দশকের প্রান্তসীমায় বাংলাদেশ হবে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশ। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র মোকাবেলা ও দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বে, বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন শেখ হাসিনা। স্বাধীনতা অর্জনের পর পদ্মা সেতু নির্মাণ আওয়ামীলীগের আরেকটি বড় সাফল্য। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে সার্চ ইঞ্জিল গুগলের হিসাব মতে, বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যমে আড়াই কোটিরও বেশি সংবাদ ও ভিডিও প্রচার হয়েছে। তাতে শেখ হাসিনাকে বিশ্বের সৎ সাহসি রাষ্ট্র প্রধান আখ্যায়িত করা হয়। প্রভাবশালী মার্কিন পত্রিকায় ‘ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল’ বলেছে, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনামের উন্নয়নের সাথে মিল রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের সফল অর্থনীতির আখ্যা দিয়ে জার্নাল বলেছে, গত ১ দশকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়, মার্কিন ডলারের নিরিখে ৮০% বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক বেশির ভাগ সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। বৃটেনের ওয়াল্ড ইকোনমিক ‘টেবিল-২০২১’ বলেছে, বাংলাদেশ এখন সব ধরনের অর্থনীতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫সাল নাগাদ দেশটি বিশ্বের ২৫তম অর্থনীতিক দেশ হয়ে যাবে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি, গঙ্গা চুক্তি, সমুদ্র বিজয়, নিজস্ব স্যাটেলাইট স্থাপন, দারিদ্র বিমোচন, সারাদেশে শতভাগ বিদ্যুৎতায়ন, অবকাটামোগত উন্নয়ন, বিনামূল্যে বই বিতরণ, ঢাকায় প্লাইওভার ও মেট্রোরেল নির্মাণ, ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল, নারীর ক্ষমতায়ন, করোনাকালিন সময়ে নগদ অর্থ ও ত্রাণ বিতরণ, ছিন্নমুল মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ, সামাজিক খাতে বিভিন্ন ধরনের ভাতা প্রদান, দরিদ্র পরিবারের মধ্যে কার্ডের মাধ্যমে খাদ্য বিতরণ, কর্নফুলী টানেল নির্মাণ সহ এদেশের বড় বড় মেঘা প্রকল্প আওয়ামীলীগের হাতেই বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বর্তমান সময়ে আওয়ামীলীগে তৃণমুল পর্যায়ে সংগঠনে লোক বেশি হলেও সাংগঠনিক কাঠামো খুবই দুর্বল। বিভিন্ন নির্বাচনে অনুপ্রবেশকারী কর্মীরা বুকে নৌকার ছবি লাগিয়ে অন্য প্রতীকে ভোট দেয়া ছিল ওপেন সেক্রেট। তাই সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থে মেধাবী, ত্যাগী ও নীতি আদর্শের লোকদের নিয়ে কমিটি গঠন এবং হাইব্রিডমুক্ত আওয়ামীলীগ করতে শেখ হাসিনার প্রতি তৃণমুলের নেতাকর্মীরা জোর দাবী জানিয়েছেন।

লেখক: সম্পাদক বিশ্বনাথের ডাক ২৪ ডটকম


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *