এএইচএম ফিরোজ আলী:: বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের সমৃদ্ধশালী ইতিাহসের শ্রেষ্ট মহানায়ক ছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি পেতে, জাতীয়, আঞ্চলিক পর্যায়ে অনেক দেশপ্রেমিক আদর্শবান মানুষও সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সহচর মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ। তিনি ছিলেন, জাতির পিতার ডানহস্ত ও বিশ^াসের ঠিকানা। একজন দেশপ্রেমিক ও মনুষ্যত্বের সাধক এবং চিন্তাবিদ ছিলেন তিনি। বিষ্ময়কর প্রতিভার অধিকারী সামাদ আজাদ স্বল্প সময়ের জীবন পেলেও বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়ে হয়েছেন, সর্বকালের। ভাটি অঞ্চলের হাওর বেষ্টিত অজোপাড়া গাঁেয়র জন্ম নেয়া কৃতিমান এ পুরুষের অবদান বাংলার ইতিহাসে সমুজ্জল। প্রচার বিমুখ এ রাজনীতিবিদের মৃত্যুর পর দীর্ঘ জীবনের কর্মকান্ড যেমন প্রচার হয়নি, তেমনি তাঁর স্মৃতি রক্ষায় কোনো কার্যকরি পদক্ষেপও নেয়া হয়নি।
আব্দুস সামাদ আজাদ ১৯২২সালের ১৫ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ‘ভূরাখালি, গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন এবং ৮৩ বছর ৩ মাস ১২ দিনের সময় ঢাকার বারডেম হাসপাতালে মুত্যুবরণ করেন। তিনির পিতা শরীয়ত উল্লাহ পঞ্চম পুত্র ছিলেন। মাতার গাঁও ও হাবিবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ১৯৪৩সালে সুনামগঞ্জ জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৪৫সালে সিলেট এম সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করে ১৯৫০সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে আইন ও ইতিহাসে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন।
তরুণ ও সাহসী সামাদ আজাদ ১৯৪০সালে সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবন শুরু করে ১৯৪৫সালে আসাম (সিলেট সহ) মুসলিম ফেডারশনের সভাপতি ছিলেন। আসামকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় ইংরেজ শাসক তাঁকে গ্রেফতার করে। ১৯৪৪-৪৮ (৪ বছর) তিনি সিলেট জেলা মুসলিম ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। ৫২সালে মায়ের ভাষা বাংলার দাবীতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করায় পাকিস্তান আমলে প্রথম কারাভোগ করেন। ১৯৫৩সালে যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হওয়া পর সরকার তাঁর উপর হুলিয়া জারি এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৫৪-৫৭ সালে আওয়ামীলীগের শ্রম-সম্পাদক ছিলেন এবং যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৫৮ সালে আইয়ুব সরকার তাঁকে গ্রেফতার করলে ৪ বছর পর ৬২সালে মুক্তিলাভের পর ৬৩ সালে পূণরায় গ্রেফতার হয়ে আরও ১বছর কারাভোগ করেন। ৬৪ সালে পাকিস্তান সরকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু করলে শক্ত হাতে দমনে মাঠে কাজ করেন এবং ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা প্রচারে পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জাতীয় ৪ নেতাদের সাথে ২২আগষ্ট তাঁকে গ্রেফতার করে সাময়িক আদালতে ২ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে মুজিবনগর সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সরকার গঠনের পর পুর্নমন্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও ভ্রামমান রাষ্টদূত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনসমর্থন আদায়ে ঘুরে বেড়ান। দেশ স্বাধীন হওয়ার ২দিন পর প্রথম পররাষ্টমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে হাঙ্গেরির বুধা পিষ্ঠে বিশ^ শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৩-৭৫সালে তিনি কৃষি ও স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ৭৩সালে নির্বাচনে সুনামগঞ্জের ২টি আসন থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে নির্বাচিত হয়ে বিরোধী দলীয় উপনেতা এবং ৯৬সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি ইনডেমনিটি বিল বাতিল বিষয়ক সংসদীয় কমিটি ও পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সদস্য হয়ে মহান জাতীয় সংসদে উপমহাদেশের সেরা এক পার্লামেন্টারিয়ানের খ্যাতি অর্জন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দক্ষ এ কুটনিতিবিদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে নিয়ে বিশে^র বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদও ছিলেন তাঁর একজন সহযোগি। ৭২ সালের ৮ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর পেয়ে আগেই ছুটে যান দিল্লিতে। ইন্দিরা গান্ধির সাথে আলোচনার পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তি নিশ্চিত যেনে সেজদায় পড়েছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। দেশের যেকোন দুর্যোগে ধীরে-স্থীরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। বিভিন্ন আপদে-বিপদে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশে থাকতেন তিনি। দেশের প্রশাসনে তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন ভদ্র লোক। প্রশাসনের লোকদের তিনি এ কাজটা করেন- এমন কথা বলতেন না, তাঁর ভাষা ছিল, ‘যদি পারেন এই কাজটা করবেন’। আমি সামাদ আজাদকে ৮০দশক থেকে চিনি। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন আপোষহীন। সিলেটের ছাত্রনেতাদের নিয়ে বৈঠক করে আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিতেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রুপরেখা প্রণয়নে তিনি ছিলেন অন্যতম। আওয়ামীলীগ বিরোধী দলে থাকাকালীন সময়ে নিজ গ্রাম ভুরাখালি গ্রামে যাতায়াত করতেন বিশ^নাথ-জগন্নাথপুর রাস্তা দিয়ে। তাঁর আগমনের খবর শুনে আমরা দলীয় নেতাকর্মীরা বিশ^নাথের রাস্তায় দাড়িঁয়ে থাকলে তিনি গাড়ি থামিয়ে নেমে সকলের কৌশলাদী জিজ্ঞাসা করতেন এবং মাথায় হাত বুলাতেন। ৫/১০ জনের পথ সভায়ও বক্তব্য দিতেন। তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন এবং নাম ধরে ডাকতেন।
১৯৯৮সালের ঘটনা, দীর্ঘ ২১বছর পর ১৯৯৬সালের ১২জুনের নিবাচনে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট আসবেন। সামাদ আজাদ ও বাবু সুরঞ্জিত সেন দু’দিন আগে সিলেট পৌছেছেন। নেতাকর্মীদের পদচারণার সিলেট লোকারণ্য। সিলেট সার্কেট হাউজে প্রধানমন্ত্রী অবস্থান করছেন। আ.ন.ম শফিকুল হকের সাথে আমি প্রধানমন্ত্রীর রুমে ঢুকে পড়ি। প্রথমে আমি চুপিচুপি করে সামাদ আজাদকে বলেছিলাম, লিডার লেখাপড়া করে দলের অনেক নেতাকর্মী বেকার, সরকারী চাকুরীতে যদি দলের কিছু লোক নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে ভালো। তিনি সাথে সাথে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করলেন। কিছুক্ষণ পর প্রধানমন্ত্রী একটু হেঁসে হেঁসে বললেন, ‘কাকা এমন করলে সরকারের বদনাম হবে,। সামাদ আজাদ আর কথা বাড়াননি। তার এসব কথা এখন শুধুমাত্র স্মৃতি ও ইতিহাস।
গত ২২ আগষ্ট সোমবার সামাদ আজাদের নিজ গ্রাম ভূরাখালিতে যাই। গ্রামটি জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওরের একেবারে পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত। জগন্নাথপুর থেকে ইঞ্জিন নৌকা যুগে পৌছতে সময় লাগে ১ঘন্টা। হাওরের চর্তুরদিকে থৈ থৈ পানি। জীবনের প্রথম ভূরাখালি গ্রামে। নৌকা তীরে ভীড়ার সাথে সাথে জানতে চেয়েছিলাম স্বাধীন বাংলার প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামাদ আজাদের ঘর কোনটি। তখন ঘরটি ছিল তালাবদ্ধ। প্রথম দফায় দেখতে না পারলেও নামাজ শেষে ঘরের ভেতরে ঢুকে আবেগ- আপ্লোত হয়ে যাই। ঘরের ভেতরে ২টি চেয়ার, একটি পালং, বঙ্গবন্ধুর ১টি ছবি, সামাদ আজাদ ১টি ছবি ও তাঁর পুত্র আজিজুস সামাদ ডনের ছবিসহ ৩টি মাত্র ছবি ঘরের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। এ ঘরে আর কিছু নেই। এ ঘরেই সাধারন মানুষের মতো শুয়ে থাকতেন কিংবদন্তি এ নেতা। বাড়িতে মসজিদ, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কমিনিটি ক্লিনিক রয়েছে। ঐতিহাসিক এই বাড়িটিতে প্রবল বন্যার সময় ও শীতকালে শতশত পর্যটন দেখার জন্য আসা-যাওয়া করে থাকেন। কিন্তু জাতীয় এই নেতার জীবনের কোন স্মৃতি, দেখার মতো এ বাড়ীতে নেই। ফলে মনভরা আশা নিয়ে আসা ভুক্ত ও পর্যটকরা হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়। এমন অবস্থা দেখে নিজেই মর্মাহত হয়েছিলাম।
সামাদ আজাদের নিকট আত্নীয় সাইদুর রহমান ও এনামুল হক জানালেন, তিনি দেশের জন্য কাজ করলেও নিজের জন্য কিছু করে যাননি। তিনি ছিলেন দেশের জন্য এক নিবেদিত প্রাণ। এনামুল হক দুটি ঘর দেখিয়ে জানালেন, পঞ্চাশ বছরের মতো সময়ে শত শত লোককে নিজ হাতে খাওয়া দাওয়া আপ্যায়ন করেছি। এখনও লোকজন সামাদ আজাদের স্মৃতি দেখার জন্য চলে আসেন। কিন্তু আমাদের হাতে রক্ষিত তাঁর কোন স্মৃতি নেই। তার ভিটে মাঠিতে একটি স্মৃতি যাদুঘর নির্মাণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষন করছি।
আব্দুস সামাদ আজাদ প্রায়ই বলতেন, ‘আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এ দেশেতেই মরি,। তাঁর এমন দেশ প্রেমের স্মৃতি এখন মানুষের মুখে মুখে। তিনি বঙ্গবন্ধুর সহপাঠি হয়ে সৌভাগ্যের স্বর্ণশিখরে আরোহনের একমাত্র উপায় ছিল তাঁর মেধা। আজীবন সংগ্রাম করেছেন মানুষ ও মানুষ্যত্বের জন্য। যুগের পর যুগ তাঁর সংগ্রামী জীবনাচার তুলে ধরতে এতিহ্যবাহী ভূরাখালী গ্রামে একটি যাদুঘর নির্মান এখন সময়ের দাবী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি তিনির ‘কাকা’ আব্দুস সামাদ আজাদের স্মৃতি রক্ষায় ১টি যাদুঘর স্থাপন করেন, তাহলে সামাদ আজাদের আত্মা শান্তি পাবে এবং নতুন প্রজন্ম তার ইতিহাস জেনে দেশ প্রেমে উদ্ভুদ্ধ হবে।