রেলের সর্বগ্রাসী অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনার অবসান হবে কি ?

জাতীয় সারাদেশ
শেয়ার করুন

এএইচএম ফিরোজ আলী:: পৃথিবীর উন্নত-অনুন্নত দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নিরাপদ ও স্বল্প খরচে আরামদায়ক যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম এখন রেলপথ। এক সময় সমগ্র পৃথিবীতে পানি পথের গুরুত্ব থাকলেও সময়ের প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রেল একটি জনপ্রিয় ও প্রহণযোগ্য পরিবহন সংস্থা। বৃটিশরা তাঁদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্ব বুঝাতে উপ-মহাদেশে রেলপথ স্থাপন করেছিল। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭সেপ্টেম্বর জর্জ স্টিফেনসন ইংল্যান্ডের স্টকটক থেকে ডালিটন পর্যন্ত ২৬কিলোমিটার ধাতব রেললাইন চালু করে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ১৮৪৪সালে স্টিফেনসন কলকাতার হাওড়া-রানীগঞ্জ শহর পর্যন্ত কয়লাও খনিজ সম্পদ পরিবহনে রেললাইন নির্মাণে ইস্টইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানী গঠন করে উপ-মহাদেশের মাটিতে শাসন ও ব্যবসার শক্ত ভীত তৈরী করেন। ১৮৫৩সালে লর্ড ডালহোসী উপ-মহাদেশে প্রথম রেলপথ চালু করেন। ১৮৬২সালে বাংলাদেশের দর্শনা-কুষ্টিয়া প্রথম রেলপথ স্থাপিত হয়। ইতিহাসের তথ্য মতে, কুষ্টিয়ার জাগতি রেলস্টেশন দেশের প্রথম স্টেশন।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে রেললাইন স্থাপনের গুরুত্ব বিবেচনা করে, কর্নেল জেপি কেনেডি গঙ্গানদীর পূর্ব দিকে সুন্দরবন হয়ে ঢাকা পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের প্রস্তাব করলে ১৮৫৪ সালে বৃটিশরা বার্মা দখল করে নেয় এবং তাঁদের সুবিধার্থে এ প্রস্তাব বাদ দিয়ে রেঙ্গুন-কলকাতা রেলপথ চালু করে। বাংলাদেশে এখন ব্রডগেজ, মিটারগেজ ও ডুয়েলগেজ- এ তিন ধরনের রেলপথ বিদ্যমান। ১৯১৪সালে পদ্মা নদীর উপর ১.৮কিলোমিটার ‘হার্ডিজ ব্রিজ’ রেলসেতু নির্মাণ করা হয়। যমুনা নদীর উপর ৪.৮কিলোমিটার দেশের দীর্ঘতম ডুয়েলগেজ সেতুসহ ৩হাজার ৬৫০টি রেলসেতু ও ২হাজার ৯৫৫.৫৩ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। যমুনা নদীর পূর্বাংশকে পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমকে পশ্চিমাঞ্চল, রূপসা নদীর পূর্ব প্রান্তের ৩২ কিলোমিটার রূপসা-বাগেরহাটকে ব্রডগেজ তৃতীয় অংশ ধরা হয়। ঢাকা স্টেট রেলওয়ে নামক একটি কোম্পানী ১৮৮২-৮৪ সময়ে দমদম জংশন-খুলনা ২০৪ কিলোমিটার সেকসনটি এবং ১৯১৬ সালের প্রথম মাসে ‘হার্ডিজ ব্রীজসহ’ ভেড়ামারা শাটোল সেকশন চালু করা হয়। এসব তথ্য ইতিহাসের।
গত পাঁচ দশকে রেলের উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হলেও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এ রেল সংস্থাটি যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন বা ব্যবস্থাপনার তেমন কোন উন্নয়ন মুলক পরিবর্তন দেখাতে পারেনি। রেলের কর্মকর্তা কর্মচারীর অনিয়ম-দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলা, রেলসম্পদ লুটপাটের কারণে সংস্থাটির মুখ প্রায় থুবড়ে গেছে। পণ্য পরিবহনে দেশে রেলের অবদান ২৮% থেকে ১৬% এ নেমে গেছে। বিপুল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগের পরও বিমানের মত এ সংস্থাকে গিলে খাচ্ছে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। ফলে রেলের হারানো গৌরব ফিরছে না। যাত্রী সেবার মান এখন ডাষ্টবিনে আটকে আছে। ট্রেনের মোট আয়ের ৭৩.৩% আয় হয় শুধুমাত্র আন্তঃনগর ট্রেন থেকে।
বিভিন্ন তথ্যমতে, গত দশ বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি রেলে বিনিয়োগ করে, রেলের ইঞ্জিন, কোচ নড়বড়ে কোচে মরিচা পড়ে রং ঝরে ঝরে পড়ছে। সীটে কাপড় নেই, থাকলেও র্দুগন্ধ, কোচে ও টয়লেটে ময়লা আবর্জনায় ভরপুর। রেলের স্লিলপার, পাথর, তেল ছুরির মত বড় বড় ঘটনা ঘটছে। অথচ তা গোপন রাখা হচ্ছে। সর্বাবস্থায় রেলওয়ে সংস্থাটি-দুর্নীতির বড় এক কারখানা। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ উন্নয়নে ৪হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ২০১৫-১৮ সালে ডাবল লাইনের কাজ শেষ করেও কোন কাজে আসেনি। ঢাকা-সিলেট, চট্টগ্রাম-সিলেট লাইনে শায়েস্তাগঞ্জের কাছে এসেই ট্রেনের গতি কমে যায়। ২০২২সালের ভয়াল বন্যায় শিল্প নগরি ছাতক-সিলেট রেললাইনটি মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্থ হলে এখনও মেরামত করা হয়নি। এ লাইনে রেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। দেশের প্রতিটি রেল স্টেশনে ময়লা-আবর্জনা, মশার ভন ভন শব্দ, যেখানে সেখানে মল-মূত্র, অবাঞ্ছিত নারী ও নেশাগ্রস্থদের আড্ডায় যাত্রীদের স্টেশনে বসার কোন পরিবেশ নেই। জিআরপি পুলিশ তা দেখেও না দেখার ভান করে। সিলেট রেল স্টেশনটি মরহুম হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী একটি অত্যাধুনিক স্টেশন হিসেবে নির্মাণ করলেও স্টেশনটি এখন চরম অবহেলা অযত্নে সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। স্টেশনটির আশে-পাশে ময়লা আবর্জনা ঘাস-লতাপাতা ও মলমুত্রের গন্ধে মুখ ঢেকে চলতে হয়। দেশের বড় বড় স্টেশনে রেল কর্মকারী, সিএনজি চালক সিন্ডিকেট গঠন করে অপরিচিত যাত্রীদের বিভিন্ন ভাবে হয়রানী করছে
জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিকের তথ্য মতে ১৯৭৫ সালে সড়ক, রেল ও  নৌ এ তিন পথে যাত্রী ভ্রমনের সংখ্যা ছিল  ১হাজার ৭০০কোটি। ২০০৩-০৪সালে  ৪কোটি ৩০লাখ, ২০১৩-১৪সালে ৬কোটি এবং ২০১৯সালে শুধু মাত্র ট্রেনে ভ্রমণ করছেন ১৯কোটি যাত্রী। বর্তমান সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা জড়িত কারণে রেলে ভ্রমনকারি যাত্রীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নোভেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, ‘আধুনিক উন্নয়ন চিন্তায় যে কোন রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় বিষয় হল দীর্ঘস্থায়ী ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা’। ইতিমধ্যে পৃথিবীজুড়ে রেল এক শক্তিশালি ও সম্ভাবনাময় পরিবহন হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিন রনি রেলের অনিয়ম দূর্ণীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্লেকার্ড হাতে নিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে অবস্থান করে আন্দোলন করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, অনলাইনে টিকিটের জন্য তার মোবাইল থেকে টাকা কেটে নিলেও টিকিট দেয়া হয়নি। আন্দোলনের এক পর্যায়ে রেলের মানউন্নয়নে তিনি ৬দফা দাবিও পেশ করেছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এক সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম, সিলেট-চট্টগ্রাম, ঢাকা-কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেইল রেলে গাদাগাদি করে উপরে-নিচে বসে যাত্রীরা যাতাযাত করতেন। তখন ১ঘন্টার রাস্তায় ৩ঘন্টা সময় লেগে যেত। ১৯৮৫সালে আন্ত:নগর ট্রেন চালু হলে ২০২০সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১০৪টি আন্ত:নগন টেইন (আপ-ডাউন), ৫২টি এক্সপ্রেস, ৬৪টি কম্পিউটার (ডেমু) ১৩৫টি লোকাল শাটল ট্রেন চালু রয়েছে। আন্ত:নগন ট্রেন চালু হওয়ার পর যাত্রী সংখ্যা বাড়লেও সেবার মান কমে দূর্নীতি চরম আকার ধারন করেছে। রেলের ঘন-ঘন সিদ্ধান্তেও যাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বেশ কিছুদিন আগ থেকে আন্ত:নগর ট্রেন ছাড়ার ৫দিন পূর্ব থেকে কাউন্টারে ভোটার আইডি কার্ড দেখিয়ে যাত্রীরা টিকেট সংগ্রহের ঘোষনা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম দিন কাউন্টার খোলার ১ঘন্টার মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট পাওয়া যায় নি। ‘টিকেট শেষ হয়েছে, বলে যাত্রীদের বিদায় করে দেয়া হয়। যাত্রীর মোবাইল নম্বর দিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করে টিকিট সংগ্রহের ঘোষনা করা হলেও আগের মতই প্রথম দিনেই টিকেট পাওয়া যায়না। যাত্রীরা কোন মতে, কাকুতি-মিনতি করে, ‘একটু ম্যানেজ করে দেন, বললেই বাড়তি দাম রেখে কাউন্টার থেকে টিকিট দেয়া হয়ে থাকে। এ বছর ১০/১২দিন লাইনে দাড়িঁয়ে টিকেট সংগ্রহ করতে গেলে আমি নিজেও মাত্র ১দিন পেয়েছি। সিলেট রেল স্ট্রেশনে এমন ঘটনা নিত্যদিনের। কমলাপুর রেল স্টেশনে কম্পিউটারে থাকা কর্মচারিদের কথাই বলা যায়না। রেলের একাধিক সুত্র মতে, কর্মকর্তা কর্মচারিরা নিজেরাই আগে ভাগে টিকিট কেটে রেখে দেয় এবং পরে অতিরিক্ত মুল্যে বিক্রি করেন। ট্রেনের এই ধরনের টিকিট বিক্রি এখন জমজমাট ব্যবসা।
যে কোন আন্ত:নগর ট্রেইন ছাড়ার পরপরই ফেরিওয়ালা, চা-পানসুপারি, বাদাম, ডিম, চানাচুর, লেবু, আনারস ও পানি বিক্রেতাদের নিকট থেকে ট্রেইনের এটেনডেন্স ও পুলিশ টাকা নিয়ে ব্যবসার সুযোগ করে দেয়। সীটের টিকিট ছাড়াও স্টেন্ড (দাঁড়ানো) টিকিট দিয়ে প্রতিটি কোচ যাত্রী দিয়ে ভরপুর করে দেয়া হয়। এ সুযোগে অনেক যাত্রীর জিনিসপত্র বা মালামাল উধাও হয়ে যায়। হিজড়াদের হাক-চিৎকার করে যাত্রীদের সাথে অসুভ আচরন চরম অপমান জনক। তাদের নিকট থেকেও টাকা নেয় পুলিশ। রাতের ট্রেইনে প্রতিটি স্টেশনে মাইকে যাত্রী উঠানামার ঘোষনা দেয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ সময় বিভিন্ন ট্রেইনে ঘোষনা না হওয়ায় এক স্টেশনের যাত্রী অন্য স্টেশনে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। ঢাকা-চট্টগ্রাম, সিলেট-ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথে সবচেয়ে বেশি যাত্রী চলাচল করেন। সিলেট থেকে কেউ কুলাউড়া টিকিট করে সেখানে নেমে গেলে বাকি রাস্তা অ্যাটেনডেন্সরা একই সীট একাধিকবার বিক্রি করে থাকে। ট্রেইনে ও স্টেশনে যাত্রীদের টিকিটও তেমন চেকিং হয়না। যে সকল যাত্রীদের টাকার বিনিময়ে ট্রেন চড়ার সুযোগ দেয়া হয়, তাদের গেইট পাস করে দিতে পুলিশ ও অ্যাটেনডেন্স ব্যস্ত থাকেন। রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর কথায় গার্ডকে বহিস্কার করা হলে দূর্নীবাজ এসব কর্মচারিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়না।
দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দেশেও যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেলপথ বেশি কার্যকর ও নিরাপদ মাধ্যম। রেলের সময় ব্যবস্থপনা, টিকিট কালো বাজারে বিক্রি রোধে কঠোর ব্যবস্থাপনা, দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারিদের চিহিৃত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা বিরাট ক্ষতির সম্মূখীন হয়ে দাঁড়াবে। এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রীর বিষয়টি নজর দেয়া একান্ত জরুরী।

লেখক,
কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *