মুক্তিযোদ্ধা বাবার স্বীকৃতির জন্য কন্যার আকুতি

Uncategorized
শেয়ার করুন

জান্নাতুল শুভ্রা মনি : যুদ্ধকরে স্বাধীন হয়েছে -এমন দেশের সংখ্যা পৃথিবীতে বেশি নয় মোটেও। তবে এর একটি যখন বাংলাদেশ, তখন বিশ্বের বুকে এ দেশটি আলাদাভাবে মর্যাদা পাবে, স্বাধীনচেতা, লড়াকু আর যুদ্ধজয়ী বীর-বাহাদুরদের জন্মভূমি হিসেবে দেশটির স্বকীয় পরিচিতি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যাদের কারনে আজ আমরা বিজয়ী, স্বাধীন সার্বভৌমত্বের অধিকারী, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি সুন্দর মানচিত্র কিংবা বিশ্বের ১ নাম্বার অর্থবহ (লাল-সবুজ) পতাকার মালিক, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের যদি স্বীকৃতি দেওয়া না হয়, অবমূল্যায়নের ঘানি টেনে টেনে পরপারে চলে যেতে দেয়া হয়, তাহলে তো ইতিহাস আমাদের কোনদিনও ক্ষমা করবে না। কারন আমাদের এতো এতো অর্জনের মূলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অমূল্য অবদান যে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। তারা নিজেদের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে একাত্তরের ধ্বংসস্তূপ থেকে এই সুন্দর বাংলাদেশ আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ৪৯তম বিজয় উদযাপন করছে দেশের আপামর জনতা। প্রতিবারই বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা, হৈ-হুল্লোড় আর ফুর্তি-আমোদধর্মী নানা আয়োজন-অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে জাতি উদযাপন করে আসছে দিনটি। কিন্তু এর ব্যতিক্রম থেকে গেলাম আমি। আমি আনন্দিত হতে পারিনি একটি মুহূর্তের জন্যও। তীব্র চাপা কষ্ট প্রতিনিয়ত আমাকে আহত করে, ব্যথিত করে! আর্তনাদ করে ডুকরে কাঁদি ডিসেম্বর আসলেই। অতৃপ্তি বাসা বাঁধে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির কারনে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি বলে। ভুলতে পারিনা আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার কথা, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার অকৃত্রিম অবদানের কথা। কিছুতেই মানতে পারিনা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও সরকারি ও দরকারি স্বীকৃতিটুকু না পেয়েই তার পারপারে চলে যাবার কথা। আমার তো মনে হয়- পরপারে এখনও আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার আত্মা অতৃপ্ত, সেই সাথে আমারও। কারন বাবা জীবন বাজি রেখে দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধজয় করেও এর স্বীকৃতিটুকু পাননি আর আমি সেই হতভাগা মুক্তিযোদ্ধা বাবার কন্যা হয়েও কেবল স্বীকৃতির অভাবে ‘মুক্তিযোদ্ধার কন্যা’র মতো গৌরবোজ্জ্বল মুকুটখানি মাথায় ব্যবহার করতে পারি না। প্রতি বছরই আমি বিজয় দিবস উদযাপন করি। দিনের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শুরু করি পবিত্র এ দিনটি। আজন্ম এভাবেই পালন করে চলেছি শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস, শহীদ দিবস এবং স্বাধীনতা দিবস। বাবার জীবদ্দশায় তার হাত ধরে মধ্যরাতেও শহীদমিনারে ফুল দিতে যাওয়া হতো। এভাবেই ধমনীতে, শোনিতে মিশে আছে শহীদ মিনার আর শহীদ স্মৃতির প্রতি দায়িত্বশীলতা। আর তাই এবারের মহান বিজয়ের এ মাসে প্রিয় বাবাকে নিয়ে কিছু কথা তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছি। দুই. মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাতক থানার পূর্ব দিকের কিয়দংশ এবং ভোলাগঞ্জ (বর্তমানে কোম্পানিগঞ্জ থানা) অঞ্চল ৬নং সেক্টরের একটি সাব-সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। এই সাব-সেক্টরের উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন আব্দুল হক এম এন এ আর সংগঠক ও ক্যাম্প ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে ছিলেন- হেমেন্দ্র কুমার দাস পুরকায়স্থ, কমরেড মানিক মিয়া, ড. হারিছ আলী, ড. আব্দুর রহিম, মদরিছ আলী, বি এ এম এ খালেক, আব্দুল গণি (দিরাই) ও ময়নুদ্দিন (শ্রীমঙ্গল)। তারা প্রত্যেকেই খুব নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সাব-সেক্টরটির কিছু উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের মধ্যে ছিলো গৌরীনগর যুদ্ধ। রণক্ষেত্রের জন্য গৌরীনগর এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। সেখান থেকে সালুটিকর ও বিমানবন্দরের দুরত্ব মাত্র ৬-৭ কিলোমিটার। ফলে সালুটিকরে অবস্থিত পাক বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে আঘাত হানা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো। তাছাড়া যুদ্ধের শেষের দিকে বাম ফ্রন্টের গেরিলা গ্রুপ তৈরির একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কিছুটা ট্রেনিং এর জায়গাও পান তারা। সুনামগঞ্জ অঞ্চল হতে এরকম একটি গ্রুপকে ট্রেনিং-এ পাঠানো হয়েছিলো। তাঁরা ট্রেনিং সমাপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সুনামগঞ্জ অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। এ দলটির মধ্যে সুনামগঞ্জ অঞ্চলের সাইফুর রহমান শামসু (আরপিন নগর, সুনামগঞ্জ), শিবনাথ চৌহান (হাছন নগর, সুনামগঞ্জ), বামপন্থি নেতাদের মধ্যে বরুণ রায়, আলী ইউনুস এডভোকেট, গুলহার আহমেদ, নজির হোসেন, আব্দস শহীদ চৌধুরী (দিরাই), আব্দুল গণি (দিরাই) ও সৈয়দ আব্দুল হান্নান (জগন্নাথপুর) মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে এবং বামপন্থি গেরিলা বাহিনী তৈরি করতে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। উল্লেখ্য যে, আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ‘আব্দুল গণি (দিরাই)’ দীর্ঘ নয় মাস চেলা ও ইউথক্যাম্প ভোলাগঞ্জ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং চূড়ান্ত বিজয়ের পর চেলা সাব-সেক্টর কর্তৃপক্ষের কাছে সমস্ত দায়িত্ব হস্তান্তর করে এগারো দিন পর তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সে সময় বাবার সাথে যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের সকলের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় থাকলেও আমার হতভাগ্য বাবার নামটি অদৃশ্য কারণে তালিকাভুক্ত হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার বাবা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সাথে দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এর কিছুদিন পর দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (সাবেক যুগ্ম-সচিব) মরহুম মাইন উদ্দিন খন্দকারের সহযোগিতায় স্থানীয় উপজেলা সদরে একটি গণপাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজও বিদ্যমান। তখনকার উপজেলা চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য নাছির উদ্দিন চৌধুরীও এই পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় বাবার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাছাড়া আমার বাবা ছিলেন একজন সমাজসচেতন ও শিক্ষিত মানুষ। ছিলেন শক্তিমান লেখক সত্ত্বা, একজন সাহসী সাংবাদিক। তিনি “সুনামগঞ্জ বার্তা”, “যুগভেরী” ও জাতীয় দৈনিক “সংবাদ” ইত্যাদি পত্রিকায় কাজ করেছন বহুদিন। নির্বিঘ্নে তুলে ধরেছেন স্থানীয় জনপদের মাটি ও মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া আর সমস্যা সম্ভাবনার কথা। তাইতো মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ, পীর হবীবুর রহমান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, প্রসুন কান্তি বরুন রায় প্রমুখ নেতৃবৃন্দ আমার বাবাকে ভালোবাসতেন, কাছে ডাকতেন, পাশে রাখতেন


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *