মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকার ও ভারতের ভূমিকা :এএইচএম ফিরোজ আলী

Uncategorized
শেয়ার করুন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যেকটি ঘটনা এক একটি ইতিহাস। ৭১ এর ১৭ এপ্রিল শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। আমাদের জাতীয় জীবনে দিনটির গুরুত্ব খুবই অপরিসীম। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ১৭ এপ্রিলের শপথ গ্রহন অনুষ্টান। এ অনুষ্টানের মাধ্যমে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস, উত্তাল ও ভীবিষিকাময় দিনটি ছিল শনিবার। এ দিন মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর নিকট বাংলাদেশ প্রতিষ্টার খবর জানিয়ে দেয়া হয়েছিল।
১লা এপ্রিল তাজ উদ্দিন আহমদ, আমিরুল ইসলাম দিল্লীতে পৌছান। অধ্যাপক রেহমান সোবহান, এমআর সিদ্দিকী, আনিসুর রহমান এবং অধ্যাপক নুরুল ইসলামসহ অনেকেই সে সময় দিল্লিতে পৌছে যান। ৩ এপ্রিল তাজ উদ্দিন আহমদ এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। তাজ উদ্দিন আহমদ ই্িন্দরা গান্ধীকে আশ্বস্ত করে বলেন, “আমরা বঙ্গবন্ধুর নিদের্শনা মতে, সব কাজ পরিচালনা করছি” বাংলাদেশ থেকে আসা স্মরনার্থীদের আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, গোলাবারুদসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে সব ধরণের সহায়তার অনুরোধ করেন। দ্বিতীয় বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের বিষয়ে অবহিত করে একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের কথা জানালে ইন্দিরা গান্ধী তাতে সম্মতি দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের নিদের্শ দেন। পাকিস্তানিরা বিশ্ব মহলে প্রচার করছিল যে, এটা স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়, বিদেশের মাটিতে বসে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ইতিমধ্যে গণপরিষদের সদস্য ও আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতারা ভারতে পৌছেযান। ১০ এপ্রিল ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের কর্মকর্তা কেপি দত্তের সহায়তায় আগরতলা সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এক বৈঠকে মুজিবনগর সরকার গঠন করে ঐ দিন শপথ গ্রহণের কথা থাকলেও নিরাপত্তা জনিত কারনে শপথ অনুষ্ঠান হয়নি। তবে এ দিন প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি কলকাতাসহ দেশি-বিদেশী পত্র-পত্রিকায় অস্থায়ী সরকার গঠনের কথা প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপ্রতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজ উদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। ১৩ এপ্রিল ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করে মন্ত্রীপরিষদ সম্প্রসারন করা হয়। ১৪ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম এমএজি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করেন।
বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট একটি ইতিহাসের স্বর্ণালী অধ্যায় রচিত হয়েছিল বৈদ্যনাথ তলায়। সেই দিন কবর রচিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের। মেহেরপুরে তখন মহুকমা প্রশাসক,সিএসপি অফিসার তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী শপথ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে ছিলেন। বেলা ১১টায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠানটি মাত্র ৪৫মিনিটের মধ্যেই শেষ করতে হয়। শত শত দেশি-বিদেশে সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা কর্মী, ছাত্র, শিক্ষক এবং গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে একটি সাধারণ মঞ্চে গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যগণ। প্রধানমন্ত্রী এক এক করে মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন এবং ঘোষণাপত্রও পাঠ করেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও আমিরুল ইসলাম ঘোষণা পত্রটির খসড়া তৈরি করে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সংক্ষিপ্ত ভাষণে পাকিস্তানিদের গণহত্যা বন্ধ, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থন জানানোর জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহবান জানান। অনুষ্ঠানস্থলের কয়েক মাইল ঘিরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিদের্শে কয়েক শত অ্যান্টি ইয়ার ক্র্যাপ্ট এবং জমজম বিমানবন্দরে কয়েক ডজন মিগ ফাইটিং ইয়ার ক্র্যাপ্ট প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। অনুষ্টানের শেষ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ অস্থায়ী সরকারের নামকরণ করেন মুজিবনগর সরকার। সেই ঘোষণা থেকে বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর পরই হানাদার বাহিনী অনুষ্ঠান স্থল তছনছ করে দেয়। ১৮ এপ্রিল ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে মুজিবনগর সরকারের সংবাদ প্রচার ও প্রকাশিত হয় এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস অবাক বিস্ময়ে প্রত্যেক্ষ করলেন বিশ্ববাসী।
নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হবে চুয়াডাঙ্গায় এবং সেখানে অস্থায়ী সরকারের রাজধানী- এই পরিকল্পনাটি আকাশ বাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত হওয়ায় পাকিস্তানিরা চুয়াডাঙ্গার দিকে নজর দেয়। ১লা এপ্রিল পাকিস্তানি সেনার ২৭ নং বেলুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানীর অধিক পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে কুষ্টিয়াকে শক্রু মুক্ত করা হয়েছিল। এই কারনে ক্ষীপ্ত বর্বর বাহিনী ১৩ এপ্রিল বৃষ্টির মত বোমা বর্ষন করে চুয়াডাঙ্গাকে দখল করে নেয়। এমন পরিস্থিতিতে অতিগোপনে শপথ অনুষ্ঠান চুয়াডাঙ্গার পরিবর্তে বৈদ্যনাথ তলা গ্রামের আম বাগানে ১৭এপ্রিল সময় নির্ধারণ করা হয়। কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে অবস্থিত অস্থায়ী সরকারের অফিসের কেউ ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত এ খবর জানতেন না। প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিলেন।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামীলীগ। বাকী দুটি আসনের মধ্যে একটি পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমীন এবং অপরটিতে পাবর্ত্য চট্ট্রগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায় নির্বাচিত হন। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের মধ্যে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) মাত্র ৮১টি আসন লাভ করে। ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন এবং সংরক্ষিত ১০টি আসনের সবটিতে জয়লাভ করে আওয়ামীলীগ। এতে দলীয় আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৮টি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার মানুষকে দীর্ঘদিন স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন, নির্বাচনে নিরঙ্কুষ বিজয় লাভের সঙ্গে সঙ্গেই সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিবেকের কাছে তিনি জীম্মি হয়ে পড়েন। আওয়ামীলীগের এই বিজয়কে বিশ্বের ইতিহাসে এক অসাধারণ বিজয় বলে ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়। এ নির্বাচনের ফলাফল স্বাধীনতার পথকে প্রসারিত করে দেয়। ৭১ সালের ফেব্রæয়ারী মাসে আওয়ামীলীগের পার্লামেন্টারি পার্টি (গণপরিষদ) এর সভায় বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান পার্লামেন্টের মেজরিটি পাটির লিডার ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ডেপুটি লিডার নির্বাচিত করা হয়। প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার নির্বাচিত হয়েছিলেন এম মনসুর আলী। নির্বাচনী ফলাফলে বঙ্গবন্ধু সমগ্র পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী এবং এম মনসুর আলী পূর্ব পাকিস্তানের ভাবি মূর্খমন্ত্রী হওয়ার কথাছিল। বাঙালির নেতৃত্ব কখনও মেনে নেয়নি। যে কারনে স্বাধীনতার সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ৭ মার্চ ভাষণে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু তাঁর কন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বাঙালিকে যুদ্ধেমন্ত্রে উজ্জীবিত করে ছিলেন।
ইয়াহিয়া খান সামরিক ট্রাইব্যুনালে জেলে থাকা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁিস দেয়ার পরিকল্পনাও করেছিল। বঙ্গবন্ধু জেল থেকে নিজের কবর খোঁড়াও দেখে মৃদু হেঁসেছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, আমার ফাঁিস হলেও প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, আমার কবরের উপর একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে উঠবেই। বাঙালির উপর বিশ্বাস করেই বঙ্গবন্ধু বলতেন, সাত কোটি বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে পারবা না। বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি নিয়ে আর্ন্তজাতিক মহল খুবই চিন্তিত ছিলেন। মার্কিনীদের মনোভাব ছিল, বঙ্গবন্ধুকে যদি হত্যা বা ফাঁসি দেয়া হয়, তাহলে পূর্ব ও পাকিস্তানকে একত্রিভূত রাখার নূন্যতম সুযোগ বা সম্ভাবনা থাকবে না। ইয়াহিয়া খানের বাসভবনে এক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নীতি হলো “পাকিস্তানের ঐক্য ও অখ্যন্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা”। খন্দকার মোশতাকও যুদ্ধবিরতির জন্য তৎপর ছিল। এ দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের নিকট বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও গণহত্যা বন্ধের জোর দাবি করে বিশ্বে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। বিচারপতি অধ্যাপক আবু সাঈদ যুক্তরাজ্য সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে যুদ্ধের অস্ত্রের জন্য অর্থ জোগাড় এবং স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। জাতীয় চার নেতাকে নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে বঙ্গবন্ধু তিলে তিলে প্রস্তুত করেও তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সব বিষয়ে করণীয় আগে-বাগে জানিয়ে দিয়ে ছিলেন তিনি।

১৭ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষনা পত্র বা সনদকে গণপরিষদে তো বটেই, সাংবিধানিকভাবে অনুমোদন দিয়ে তা সংবিধানের অবিচ্ছদ্য অংশ হিসেবে রাখা হয় যা ৭২ সালের প্রণিত বাংলাদেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি ছিল। মুজিবনগর সরকার ছিল রাষ্ট্রপ্রতি শাসিত সরকার এবং বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাষ্ট্রপতি। ৭২ এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পরিবর্তন করে মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার গঠন করেন এবং ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব ভার গ্রহন করেন। মুজিবনগর স্থানটি বিশ্বের একটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ৩০ লাখ শহিদ ও ৩ লাখ ইজ্জত হারানো মা-বোনদের অতœত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার গুরুত্বপুর্ণ স্থানটি জীবনে একবার হলেও এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের দেখে আসা দায়িত্ব ও কর্তব্য।

এএইচএম ফিরোজ আলী
লেখক, কলামিষ্ট ও সমাজবিশ্লষক
মোবা: ০১৭১১৪৭৩১৫৫


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *