এএইচএম ফিরোজ আলী:: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যেকটি ঘটনা এক একটি ইতিহাস। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন একটি দিন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ দিনটি যেমন আনন্দের, তেমনি বেদনারও বটে। আমাদের জাতীয় জীবনে দিনটির গুরুত্ব খুবই অপরিসীম। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা ১৭ এপ্রিল একটি গৌরবের দিন। সে দিনটি ছিল শনিবার। এ দিনে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে ছিলেন। এ সরকারের অধীনেই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। আজ ১৭ এপ্রিল শনিবার মুজিবনগর সরকারের সূবর্ণজয়ন্তী বা পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস উত্তাল ও ভীবিষিকাময় দিনগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ১৭ এপ্রিল। এ দিন মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন। বাঙালির ইতিহাসে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ছিল এক ঐতিহাসিক মূহুর্ত। এ অস্থায়ী সরকারের অধীনে পরিচালিত হয় নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী থাকাস্বত্বেও বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযোদ্ধারা রনাঙ্গণে শপথ নিতেন। আজ ঐতিহাসিক এ দিনে মুজিবনগর সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে জাতি।
১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারী লাহোরে বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবী সম্বলিত বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা পেশ করেন। জেনারেল আইয়ুব খান ৬ দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ধবংসাত্নাক কর্মসূচী বলে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামীলীগের উপর চরম ক্ষীপ্ত হন এবং হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেন। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করলে ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ বছর ২৮ মার্চ এক ঘোষণায় ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন। অবশেষে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম এক ব্যক্তি, এক ভোটের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার অধীনে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। সে সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৬৪ লাখ। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) ভোটার ছিলেন ৩ কোটি ২২ লাখ। জাতীয় পরিষদের এ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামীলীগ। বাকী দুটি আসনের মধ্যে একটি পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমীন এবং অপরটিতে পাবর্ত্য চট্ট্রগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায় নির্বাচিত হন। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের মধ্যে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) মাত্র ৮১টি আসন লাভ করে। ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের এলাকা ভিত্তিক নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে আওয়ামীলীগ। সংরক্ষিত ১০টি আসনের সবটিতে জয়লাভ করে আওয়ামীলীগ। এতে দলীয় আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৮টি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার মানুষকে দীর্ঘদিন স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন, নির্বাচনে নিরঙ্কুষ বিজয় লাভের সঙ্গে সঙ্গেই সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিবেকের কাছে তিনি জীম্মি হয়ে পড়েন। আওয়ামীলীগের এই বিজয়কে বিশ্বের ইতিহাসে এক অসাধারণ বিজয় বলে বিবেচনা করা হয়। এ নির্বাচনের ফলাফল স্বাধীনতার পথকে প্রসারিত করে দেয়। ৬ দফা ও ১১ দফার প্রতি পূর্ব বাংলার মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালির স্বাধীনতার শুভ সূচনা করেন। ৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আওয়ামীলীগের পার্লামেন্টারি পার্টি (গণপরিষদ) এর সভায় বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান পার্লামেন্টের মেজরিটি পাটির লিডার ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ডেপুটি লিডার নির্বাচিত করা হয়। প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার নির্বাচিত হয়েছিলেন এম মনসুর আলী। নির্বাচনী ফলাফলে বঙ্গবন্ধু সমগ্র পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী এবং এম মনসুর আলী পূর্ব পাকিস্তানের ভাবি মূর্খমন্ত্রী হওয়ার কথাছিল। কিন্তু পাকিস্তানিরা পরাজয় না মেনে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা শুরু করে। পাকিস্তান শাসনে বাঙালির নেতৃত্ব কখনও মেনে নিতে পারেনি তাঁরা। যে কারনে স্বাধীনতার সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ৭ মার্চ ভাষণে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু তাঁর কন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বাঙালিকে যুদ্ধেমন্ত্রে উজ্জীবিত করে ছিলেন।
১৯৭১সালের ২৫মার্চ কালো রাতে “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে পূর্ব বাংলায় গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী। ২৬শে মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পর পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ২৭ মার্চ কারফিউ প্রত্যাহার করা হলে দলে দলে মানুষ ভারতের দিকে পালাতে থাকেন। এমনি এক অবস্থায় ১লা এপ্রিল তাজ উদ্দিন আহমদ, আমিরুল ইসলাম দিল্লীতে পৌছান। অধ্যাপক রেহমান সোবহান, এমআর সিদ্দিকী, আনিসুর রহমান এবং অধ্যাপক নুরুল ইসলামসহ অনেকেই সে সময় দিল্লিীতে পৌছে যান। ৩ এপ্রিল তাজ উদ্দিন আহমদ এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। তাজ উদ্দিন আহমদ ই্িন্দরা গান্ধীকে আশ্বস্ত করে বলেন, “আমরা বঙ্গবন্ধুর নিদের্শনা মতে, সব কাজ পরিচালনা করছি এবং আপনি (ইন্দিরা গান্ধী)” বাংলাদেশ থেকে আসা স্মরনার্থীদের আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, গোলাবারুদসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে সব ধরণের সহায়তার অনুরোধ করেন। দ্বিতীয় বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের বিষয়ে অবহিত করে একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের কথা জানালে ইন্দিরা গান্ধী তাতে সম্মতি দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের নিদের্শ দেন। পাকিস্তানিরা বিশ্ব মহলে প্রচার করছিল যে, এটা স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়, বিদেশের মাটিতে বসে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ইতিমধ্যে গণপরিষদের সদস্য ও আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতারা ভারতে পৌছে যান। ১০ এপ্রিল ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের কর্মকর্তা কেপি দত্তের সহায়তায় আগরতলা সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এক বৈঠকে মুজিবনগর সরকার গঠন করে ঐ দিন শপথ গ্রহণের কথা থাকলেও নিরাপত্তা জনিত কারনে শপথ অনুষ্ঠান হয়নি। তবে এ দিন প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি কলকাতাসহ দেশি-বিদেশী পত্র-পত্রিকায় অস্থায়ী সরকার গঠনের কথা প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপ্রতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজ উদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। ১৩ এপ্রিল ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করে মন্ত্রীপরিষদ সম্প্রসারন করা হয়। ১৪ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম এমএজি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করেন।
নতুন এই সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হবে চুয়াডাঙ্গায় এবং সেখানে হবে অস্থায়ী সরকারের রাজধানী- এই পরিকল্পনাটি আকাশ বাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত হওয়ায় পাকিস্তানিরা চুয়াডাঙ্গার দিকে নজর দেয়। ১লা এপ্রিল পাকিস্তানি সেনার ২৭ নং বেলুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানীর অধিক পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে কুষ্টিয়াকে শক্রু মুক্ত করা হয়েছিল। এই কারনে ক্ষীপ্ত বর্বর বাহিনী ১৩ এপ্রিল বৃষ্টির মত বোমা বর্ষন করে চুয়াডাঙ্গাকে দখল করে নেয়। এমন পরিস্থিতিতে অতি গোপনে শপথ অনুষ্ঠান চুয়াডাঙ্গার পরিবর্তে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহুকমার বৈদ্যনাথ তলা গ্রামের আম বাগানে ১৭এপ্রিল শপথ অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ করা হয়। কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে অবস্থিত অস্থায়ী সরকারের অফিসের কেউ ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত এ খবর জানতেন না। প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিলেন।
অবশেষে ১৭ এপ্রিল ইতিহাসের সেই মহেন্দ্রক্ষণ। বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট একটি ইতিহাসের স্বর্ণালী অধ্যায় রচিত হয়েছিল বৈদ্যনাথ তলায়। ইতিহাস রচিত হল “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু”র এবং সেই দিন কবর রচিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের। মেহেরপুরে তখন মহুকমা প্রশাসক,সিএসপি অফিসার ছিলেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। তিনি শপথ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে ছিলেন। বেলা ১১টায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠানটি মাত্র ৪৫মিনিটের মধ্যেই শেষ করতে হয়। শত শত দেশি-বিদেশে সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা কর্মী, ছাত্র, শিক্ষক এবং গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে একটি সাধারণ মঞ্চে গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যগণ। প্রধানমন্ত্রী এক এক করে মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন এবং ঘোষণাপত্রও পাঠ করেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও আমিরুল ইসলাম ঘোষণা পত্রটির খসড়া তৈরি করে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সংক্ষিপ্ত ভাষণে পাকিস্তানিদের গণহত্যা বন্ধ, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থন জানানোর জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহবান জানান। অনুষ্ঠানস্থলের কয়েক মাইল ঘিরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিদের্শে কয়েক শত অ্যান্টি ইয়ার ক্র্যাপ্ট এবং জমজম বিমানবন্দরে কয়েক ডজন মিগ ফাইটিং ইয়ার ক্র্যাপ্ট প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। অনুষ্টানের শেষ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ অস্থায়ী সরকারের নামকরণ করেন মুজিবনগর সরকার। সেই ঘোষণা থেকে বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর পরই হানাদার বাহিনী অনুষ্ঠান স্থল তছনছ করে দেয়। অল্পের জন্য মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা রক্ষা পান। ১৮এপ্রিল ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে মুজিবনগর সরকারের সংবাদ প্রচার ও প্রকাশিত হয় এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস অবাক বিস্ময়ে প্রত্যেক্ষ করলেন বিশ্ববাসী। কলকাতা ও আগরতলা থেকে মুজিবনগর সরকারের সব কাযক্রম পরিচালনা করা হয়েছিল। উচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারকরা থাকতেন কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডের অফিসে। আর যারা আগরতলায় থাকতেন তারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। এক পর্যায়ে সবাই কলকাতার অফিসে গিয়ে সরকার পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করেন। আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতারা অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতেন। বিচারপতি অধ্যাপক আবু সাঈদ যুক্তরাজ্য সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে যুদ্ধের অস্ত্রের জন্য অর্থ জোগাড় এবং স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর সেনা সদর দপ্তর, এক বেতার বার্তায় বলেছিল, “দ্য বিগ বার্ড ইন দ্য কেইজ” অর্থাৎ বড় পাখিটিকে খাঁচায় ভরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করাকে বড় সাফল্য দেখেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ইয়াহিয়া খান সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁিস দেয়ার পরিকল্পনাও করেছিল। বঙ্গবন্ধু জেল থেকে নিজের কবর খোঁড়াও দেখে মৃদু হেঁসেছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, আমার ফাঁিস হলেও প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। বঙ্গবন্ধুর ফাঁিস নিয়ে আর্ন্তজাতিক মহল খুবই চিন্তিত ছিলেন। মার্কিনীদের মনোভাব ছিল বঙ্গবন্ধুকে যদি হত্যা বা ফাঁসি দেয়া হয়, তাহলে পূর্ব ও পাকিস্তানকে একত্রিভূত রাখার নূন্যতম সুযোগ বা সম্ভাবনা থাকবে না। ইয়াহিয়া খানের বাসভবনে এক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নীতি হলো “পাকিস্তানের ঐক্য ও অখ্যান্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা”। খন্দকার মোশতাকও যুদ্ধবিরতির জন্য তৎপর ছিলেন।
এ দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের নিকট বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও গণহত্যা বন্ধের জোর দাবি করে বিশ্বে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দিতে পারলেই যুদ্ধ থেমে যাবে মনে করেছিলেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে ২৫মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন, ইয়াহিয়া খান যদি মনে করে যে, আমাকে হত্যা করলে মুক্তির সংগ্রাম শেষ হয়ে যাবে, তাহলে তাঁর ধারণা হবে ভূল। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, আমার কবরের উপর একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে উঠবেই। বাঙালির উপর বিশ্বাস করেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সাত কোটি বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে পারবা না। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে পূর্ব বাংলার আনাচে-কানাচে, শহরে, গ্রামে-গঞ্জে ঘুরেছেন, সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে, মাথায় হাত বুলিয়ে বাঙালিকে আপন করে নিয়ে ছিলেন। ৬ দফার দাবীকে ১১দফায় পরিনত করে স্বাধীনতার মুক্তির মোহনায় একত্র করতে পেরেছিলেন জাতীকে। জাতীয় চার নেতাকে নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে তিলে তিলে প্রস্তুত করেও তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সব বিষয়ে করণীয় আগে-বাগে জানিয়ে দিয়ে ছিলেন তিনি।
আমি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারিনি বটে। তবে, যুদ্ধে বর্বর হানাদার ও তাদের এদেশিয়া দোসরদের অনেক তান্ডব দেখেছি। তারা বলছিল, বঙ্গবন্ধু ইসলামের বিরুদ্ধে দেশে গন্ডগুল শুরু করেছেন। এ কথাও নিজের কানে শুনেছি। সে সময় মেয়েরা ঘরের বাহিরে, স্কুলে যাওয়া এবং পর পুরুষের মুখ দেখা ছিল হারাম। লন্ডনীদের বাড়িতে মিলাদ পড়া, দাওয়াত খাওয়াও ছিল হারাম। আওয়ামীলীগ ইসলাম বিরোধী ভারতের দালাল-এমন কথা পাকিস্তান পন্থিদের মূখে শুনতে শুনতে এখন আর কানে শুনি না। বঙ্গবন্ধুর শত জন্মবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী পালন দেখব, এ কথা কোনদিন ভাবতেও পারিনি। মহান আল্লাহর দয়ায় সরাসরি দেখতে না পারলেও টিভি সহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেখে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। সূবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে উপ মহাদেশের চারজন রাষ্ট্রপ্রধান এসেছিলেন। অনেক বড় বড় দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এতে অনেক খুশি ও আনন্দিত হয়েছি। কিন্তু কষ্ট পেয়েছি কিছু লোক ইসলামের কথা বলে কচি, কচি অবুঝ শিশুদের দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদ করতে রাষ্ট্রের সম্পদ ও প্রাণহানী ঘঠিয়েছেন। এতে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি চরম ভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের ব্যক্তিগত সফরে আসেননি। সরকারের আমন্ত্রনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সূবর্ণজয়ন্তী উৎসবে যোগদান করতে মেহমান হয়ে এসেছিলেন। আমরা মেহমানকে যথাযথ সম্মান দেখাতে পারিনি। যারা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিরোধীতা করে দেশের ক্ষতি করেছেন, তারা হয়ত জানেন না একাত্তর সালে ভারত এক কোটি মানুষকে আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সর্বপুরি স্বাধীনতার জন্য বিশ্বে জনমত গড়ে তুলে প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত ছিল বাঙালিদের পাশে। সরকারের বিরুদ্ধে আলোচনা-সমালোচনা করা স্বাভাবিক। কিন্তু উপকারী রাষ্ট্রের উপকার স্বীকার না করে অপমান করা কোন জাতী, গোষ্টি, রাষ্ট্র এবং ধর্ম সমর্থন করে না। যারা এমন তান্ডব করেছেন তারা হয় অজ্ঞ, না হয় অন্ধ। মুক্তিকামী মানুষ এসব রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করা না হলে এদেশের অপূরণীয় ক্ষতিও হতে পারে। পরিশেষে বলি ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও তিন লক্ষ ইজ্জত হারানো মা-বোনদের কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌম রক্ষায় এদেশের সকল নাগরিককে সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাড়াঁতে হবে।
লেখক, কলামিষ্ট ও সমাজবিশ্লষক
এবং সদস্য সিলেট জেলা আওয়ামীলীগ।