এএইচএম ফিরোজ আলী:: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ২ মাস ২০ দিন পর ৩রা নভেম্বর মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য ও কলংকময় একটি দিন। এ দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জন প্রকোষ্টে জাতীয় চার নেতা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ, মন্ত্রী সভার অন্যতম সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের এই নিষ্টুর হত্যাকান্ডের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল বিশ্ব বিবেক। নিরাপদ স্থান কারাগারে থাকাবস্থায় বর্বরোচিত এমন খুনের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধুর দৌহিক অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে যাদের অসাধারন অবদান ছিল, তাদের হত্যা করে স্বাধীন বাংলাদেশ ও আওয়ামীলীগকে ধ্বংস করা ছিল ঘাতকদের মূল টার্গেট। আজ জাতি স্মরণ করবে বাঙালির এই শ্রেষ্ট সন্তানদের।
২৫শে মার্চ কালো রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর মুজিবনগর সরকার গঠন করে মাত্র নয় মাসে দেশ স্বাধীন করা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সরকারে যোগদানের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করায় তাদের হত্যার মূল কারন বলে ইতিহাসে স্বাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। এ হত্যাকান্ড ছিল জাতির পিতাকে হত্যার ধারাবাহিকতা। হত্যাকারীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস, বাঙলি জাতিকে নেতৃত্ব ও মেধাশূন্য করা ছিল জেল হত্যাকান্ডের অন্যতম কারণ। একই উদ্দেশ্যে ৭১সালের ১৪ ডিসেম্বর দেশবরণ্য বুদ্ধিজীবি যারা এ ভুখন্ডকে স্বাধীন করতে চেষ্টা করেছেন, পথ দেখিয়েছেন জাতির সেই সব বীর সন্তানদের পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রতিশোধ নিতে দেশটিকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের আবর্তে নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘাতক মুসলে উদ্দিনকে ঢুকতে দেয়ার আগে ডিআইজি প্রিজন টেলিফোনে রাষ্ট্রপতি কুখ্যাত মোশতাকের অনুমতি নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ঘটনাবহুল রাজনীতির বিরল স্বাক্ষী লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকার সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তাঁর এক বইয়ে এসব তুলে ধরেছেন। ৩রা নভেম্বর ভোর ৪টায় খন্দকার মোশতাক কর্ণেল রশীদসহ কয়েকজনকে জেলের ভেতরে ঢোকার সম্মতি দেয়। ফারুক-রশীদ পরিকল্পিত পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য রিসালদার মুসলে উদ্দিন তার দলবল দিয়ে কারাগারে প্রবেশ করে। কারাগারের একটি কক্ষে তাজ উদ্দিন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং অপর সেলে ছিলেন মুনসুর আলী ও কামারুজ্জামান। তাদের দুজনকে তাজ উদ্দিন আহমেদের সেলে এনে খুব কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে নৃশংসভাবে খুন করা হয় বঙ্গবন্ধুর প্রাণপ্রিয় জাতীয় চার নেতাকে। তিনজন সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারালেও তাজ উদ্দিন আহমদ পেটে ও পায়ে গুলি লাগায় রক্তক্ষরণের ফলে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে মারা যান। বর্বর ঘাতক মুসলে উদ্দিন ও তার গ্যাংরা চলে যাওয়ার আগে সেলটিকে খুব শক্ত করে তালাবদ্ধ করে রেখে যায়। যে কারনে মৃত্যুর আগে তাজ উদ্দিনের মূখে কেউ একফোঁটা পানিও দিতে পারেননি। কি নির্মম ইতিহাস !
হত্যা কান্ডের পরদিন ডিআইজি প্রিজন কাজী আব্দুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হলে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৮সালের ১৫ অক্টোবর ২০জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করা হয়। ২০০৪সালে ২০ জন আসামীর মধ্যে ১২জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে যাবতজ্জীবন, রিসালদার মুসলে উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী, এলডি তফাদার আবুল হাসেম মৃধাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। কেএম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম মজনু, মেজর অবঃ খায়রুজ্জামানকে খালাস প্রদান করেন। ২০০৮ সালে ২৮ আগষ্ট হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক ২ আসামীকে বেকসুর খালাস ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ৪জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
১৯৭০ সালে ঐতিহাসিক নির্বাচনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমদ ও কামারুজ্জামান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারী পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপনেতা, তাজ উদ্দিন আহমদ পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা ও কামারুজ্জামান সচিব নির্বাচিত হন। আর প্রাদেশিক পরিষদের নেতা নির্বাচিত হন, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। সাবেক ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমদ তাঁর এক লেখায় বলেছেন, (দৈনিক ভোরের কাগজ, ০৩-১১-২০১৮ইং তারিখে) ১৯৭১ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতীয় চার নেতাসহ তাদেরকে একটি ঠিকানা মূখস্থ করালেন বঙ্গবন্ধু, “সানি ভিলা, ২১ রাজেন্দ্র রোড, নর্দান, পাক ভবানীপুর, কলকাতা। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এখানেই হবে তোমাদের জায়গা। ভূট্টো-ইয়াহিয়া ষড়যন্ত্র শুরু করছেন, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ক্ষমতা দেবে না। আমি নিশ্চিত ওরা আক্রমন করবে। আক্রান্ত হলে সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সুসংগঠিত করবে”। জাতীয় পরিষদের সদস্য চিত্র রঞ্জন সুতার প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডাঃ আবু হেনাকে আগেই কলকাতা পাটিয়ে সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কলকাতার সেই ঐতিহাসিক ৮নং টিয়েটার রোডে অবস্থান করতেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরিচালনাকারী এই জাতীয় চার নেতা।
১৯৬৬ সালে দেশের সংকটময় মুহুর্তে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পেয়ে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পালন করেন। তিনি ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর একজন অন্যতম আইনজীবি ছিলেন। ২৫ মার্চ ৭১সালে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ৭২ সালে তিনি সংসদের উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন করে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন জাতীয় এই চার নেতা। প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিনের সঙ্গে সুচিন্তিত মতবিনিময় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের চিন্তার মাধ্যমে সৈদয় নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধকালিন সরকার পরিচালনা করে মুক্তিযুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রন রাখতে সক্ষম হন। তাঁর সুযোগ্যে নেতৃত্বের ফলে আপামর জনতা মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিয়ে ধীরে ধীরে সুচিত হতে থাকে বিজয়ের ধারা। এ সরকারের দূরদর্শী কর্মকান্ডের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা আদায় করা সম্ভব হয়। অক্টোবর মাসে ভারতে সফররত তৎকালিন সুভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেবের উপস্থিতিতে ইন্ধিরা গান্ধির কাছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দাবী করেন। ফলে ৬ ডিসেম্বর ভারত স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়। পরের দিন ভারতীয় বাহিনী মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয় এবং ৭ ডিসেম্বর যশোর সেনানিবাসের পতন ঘটে। এসময় যশোরে ছুটে আসেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, স্বাধীনতা ঘোষণার পর আওয়ামীলীগের উপর পাক বাহিনী কর্তৃক যত ঝড়-তুফান মহা বিপদ এসেছে, বঙ্গবন্ধুকে বার বার গ্রেফতার করা হয়েছে। তখনই আমাদের জাতীয় এই চার নেতাই আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে দল পরিচালনা ও নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অপূর্ব দক্ষতার সহিত স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকার পরিচালনা করে বিজয় ছিনিয়ে এনে পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজির স্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান এই জাতীয় চার নেতার অবদান শুধু উল্লেখ্যযোগ্য নয়, চিরস্মরণীয়ও বটে। তাদের বীরত্বগাথা অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাঙালির জাতির জন্য জাতীয় এই চার নেতার মৃত্যু ছিল অপূরণীয়।
লেখক, কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক