ভয় আর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা নিয়ে খেলেছেন ট্রাম্প, তাতেই ধরাশায়ী কমলা

আন্তর্জাতিক জাতীয়
শেয়ার করুন

নিউইয়র্ক টাইমস :: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কমলা হ্যারিসকে হারিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনে জয়ী হতে তিনি মূল্যস্ফীতি নিয়ে মানুষের উদ্বেগকে কাজে লাগিয়েছেন। একই সঙ্গে অবৈধ অভিবাসন বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের মন জয় করেছেন। হোয়াইট হাউসে শক্তিশালী রাজনীতির ধারা ফেরানোর আশায় অনেকেই তাঁকে ভোট দিয়েছেন। পুনর্নির্বাচনে ২০২০ সালে হেরে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ১২০ বছরের ইতিহাসে তিনিই প্রথম সাবেক প্রেসিডেন্ট, যিনি আবার প্রেসিডেন্ট হয়ে হোয়াইট হাউসে ফিরছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত সময়ে শক্তিশালী নেতা হিসেবে কমলার বিপরীতে ট্রাম্পকেই  বেছে নিয়েছেন ভোটাররা। একজন প্রমাণিত অর্থনৈতিক চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করেছেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের ৩৪টি অভিযোগ ভোটারদের মনে দাগ কাটতে পারেনি। এ ছাড়া ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ক্যাপিটলে তাঁর সমর্থকদের হামলায় উসকানি কিংবা গোপন নথি নিজের কাছে রাখার যেসব অভিযোগ উঠেছিল, সেসব বিষয় ভোটারদের রুখতে পারেনি।

ট্রাম্পের এবারের নির্বাচনী প্রচারজুড়েও ছিল নাটকীয়তা। তাঁকে দুবার হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। সব বাধা দূর করে ৭৮ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসছেন তিনি।

নির্বাচনের দিন সকালে ফ্লোরিডার পাম বিচে সমর্থকদের উদ্দেশে ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকান জনগণ তাদের দেশের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করার দিন হিসাবে একে চিরকাল স্মরণ রাখবে।

সিনেটে দীর্ঘদিন সংখ্যালঘু হিসেবে থাকার পর এবার ওয়াশিংটনে সিনেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই ফিরছেন তিনি। এতে মন্ত্রিসভায় বিশ্বস্ত লোকদের সহজেই বসাতে পারার সুযোগ হবে তাঁর। প্রতিনিধি পরিষদে এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি রিপাবলিকানরা। তবে সেখানেও নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

গত জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে জো বাইডেন সরে দাঁড়ানোর পর থেকে ব্যাপক প্রচার করেন কমলা হ্যারিস। তিনি জিতলে মার্কিন নির্বাচনে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হতেন। তবে শেষ পর্যন্ত করোনা–পরবর্তী মূল্যস্ফীতি, ব্যাপক বাড়িভাড়া ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মতো বিষয়গুলো থেকে উত্তরণ ঘটানোর জন্য নীতিনির্ধারণ কমলার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। নির্বাচনী প্রচারের সময় তিনি অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর নীতি পরিষ্কারভাবে সামনে আনতে পারেননি বলেও সমালোচনা রয়েছে।

ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারে কড়া অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের মূলে ছিল মেক্সিকোর সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া এবং লাখো অবৈধ অভিবাসীকে তাড়ানোর মতো বিষয়। তিনি দেশীয় শিল্পকে শক্তিশালী করতে আমদানি শুল্ক বাড়ানোর কথা বলেছেন। নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিনগুলোতে তিনি ব্যাপক ব্যয়বহুল আর্থিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি ভ্রমণে কর বিলুপ্তি, অতিরিক্ত কাজের জন্য ভাতা বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানোর মতো কথা বলেছেন।

বাইডেন প্রশাসনের অজনপ্রিয়তা ও ব্যর্থতাগুলোর জন্য কমলাকে দায়ী করে নির্বাচনের শেষ দিকে ব্যাপক প্রচার করেছেন ট্রাম্প। তাঁর স্লোগান ছিল, ‘কমলা ভেঙেছেন ট্রাম্প ঠিক করবেন।’ এ ছাড়া বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, মানুষ পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে ছিল। ট্রাম্পের বার্তাগুলোতে তাই ক্ষমতায় থাকা কমলার জন্য কঠিন হয়ে গেছে।

এবারের নির্বাচনের শুরুটাই ছিল প্রার্থী নির্বাচন ঘিরে ভোটারদের মধ্যে অসন্তোষের বিষয়টি। শুরুতে বাইডেন ও ট্রাম্পের মতো দুই বয়স্ক ব্যক্তির লড়াইকে গ্রহণ করেননি ভোটাররা। সংঘাত, বিভক্তি ও অর্থনৈতিক স্থানচ্যুতিতে বিরক্ত মার্কিন নাগরিকেরা নতুন করে শুরুর জন্য মুখিয়ে ছিলেন।

গত জুন মাসে বাইডেন ও ট্রাম্পের প্রথম বিতর্কের পর বাইডেন মারাত্মকভাবে ধাক্কা খেয়ে সরে যেতে বাধ্য হন। এর দুই সপ্তাহ পরেই পেনসিলভানিয়ায় নির্বাচনে সমাবেশে ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সেখানে রক্তাক্ত ট্রাম্প ‘ফাইট’, ‘ফাইট’ বলে যে দৃঢ়তা দেখান, সেসব ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আবার রিপাবলিকান দলের জাতীয় সম্মেলন হয়। তাতে ট্রাম্পকে নভেম্বরের নির্বাচনে স্পষ্ট জয়ী হওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়।

বাইডেন সরে দাঁড়ানোর পর ডেমোক্র্যাটরা কিছুটা স্বস্তি ফিরে পায়। নতুন করে কমলা হ্যারিস সব শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিয়ে শুরু হয় কমলা-ট্রাম্পের নির্বাচনী লড়াই।

কমলা হ্যারিস ট্রাম্পের সাবেক প্রশাসনের অনেক রিপাবলিকান ব্যক্তির সমর্থন পেয়েছেন। তাঁদের পক্ষ থেকে ট্রাম্পকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিকে এসে কমলার প্রচারশিবির থেকে ট্রাম্পকে ফ্যাসিস্ট হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অন্যদিকে ট্রাম্পের প্রচারশিবির থেকে যেসব বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে, সেগুলোতে সীমান্তে অভিবাসীদের আক্রমণ চলছে এমন চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া হিস্পানিক অপরাধীদের ছবি, ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি সহিংসতা, মানুষের মধ্যে ভয় ও আস্থা নষ্ট করে এমন নানা ধরনের আবেদন সৃষ্টিকারী বিষয়বস্তু প্রচার করা হয়েছে। ট্রাম্পের পক্ষ থেকে কমলাকে অলস, নির্বোধ, পাথরের মতো নিশ্চল বলে আক্রমণ শানানো হয়েছে।

ট্রাম্পের দেওয়া এসব আক্রমণাত্মক বক্তব্য মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে। তিনি অপরাধ নির্মূলে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহারের মতো কথা বলেছেন। এ ছাড়া দেশের মধ্যে থাকা শত্রুদের নির্মূল করার হুমকিও দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিকে তিনি রিপাবলিকান সমালোচক লিজ চেনিকে আক্রমণ করেও বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের বক্তব্য তাঁর জন্য ভোটারবিমুখ পরিস্থিতি তৈরি করেনি। তাঁর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র আবার ফিরবে বলে যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন, মানুষ সেটাই গ্রহণ করেছে বেশি।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *