এএইচএম ফিরোজ আলী ::
আবুল মাল আবুল মুহিত ছিলেন, একজন অসাধারন প্রতিভার অধিকারী। তিনি একজন বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, ভাষা সৈনিক। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক মনুষত্বের সাধক। দেশের অর্থনীতিবিদদের অন্যতম। ছাত্র ও কর্ম জীবনে তাঁর সুনাম ও খ্যাতি আর্ন্তজাতিক মহলে ছড়িয়ে পড়ে। মানব জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি। তিনি বাংলা ও বাঙালির গর্ব এবং অহংকার। তাঁর কৃতিত্বের রেকড বিশ্বজুড়ে। তিনি সৎ চরিত্রবান, সত্যবাদী, স্পষ্টভাষী, দেশ ও জাতির এক অনুপ্রেরণার প্রতীক। বনাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী প্রচারবিমুখ মুহিত ছিলেন, বিশ^বরণ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবন সাধনা ছিল, কাজ, লেখাপড়া ও মানুষের কল্যাণ করা। একজন অর্থমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে বেশি বাজেট পেশ করেছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারন অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত হন।
গতকাল বুধবার ৩০এপ্রিল আবুল মাল আবুল মুহিতের চতুর্থতম মৃত্যুদিবস ছিল। ২০২২সালের ২৯এপ্রিল শুক্রবার দিবাগত রাত ১২:৫৬ মিনিট ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা গ্রহণের পর সুস্থ হলেও ধীরে ধীরে তাঁর শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছিল। মৃত্যকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর (১৯৩৫-২০২২)। ঢাকা গুনশান জামেমসজিদ ও সংসদভবন এলাকায় জানাজার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে সর্বস্তরের জনসাধারনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কফিন রাখা হয়েছিল। মহামান্য রাষ্ট্রপতির পক্ষে, সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এসএম সালাউদ্দিন ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে, সামরিক সচিব বিগ্রেডিয়ার জেনারেল কবির আহমদ, স্পিকারের পক্ষে, আর্মস কমোডোর এসএম নাঈম রহমান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান, ড. জাফর উল্লাহ, মন্ত্রী, এমপি, রাজনীতিবিদ, সচিব, ছাত্র-শিক্ষকসহ হাজার হাজার মানুষের চোখের জলে ভাসিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। ঢাকা থেকে সড়ক পথে জন্মস্থান সিলেটের হাফিজ কমপ্লেক্স, চৌহাট্টা কেন্দ্রীয় শহীদমিনার, আলিয়া মাদরাসা ময়দানে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর রায়নগর পারিবাবিক গোরস্তানে দাফন করা হয়। কর্মগুনে মুহিত নজীরবিহীনভাবে মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুহিতের মৃত্যুর সংবাদ প্রচার হলে দেশে-বিদেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল।
আবুল মাল আব্দুল মুহিত ১৯৪৯সালে সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক, ১৯৫১সালে সিলেট মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে মেধার স্বাক্ষর রাখেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৫৪সালে চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম স্থান এবং পরের বছর স্নাতকউডিগ্রী অর্জন করেন। তখন দেশের খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের প্রশংসা অর্জন করেন। তাঁর লেখাপড়ার ইচ্ছাশক্তি ছিল চুম্বক শক্তির মতো। মেধাবি মুহিতের সাথে ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের সু-সম্পর্ক গড়ে ওঠায় বিশ^বিদ্যালয়ের এসএম হল ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ভিপি সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে তৎকালিন সময়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। সে সময় মুহিত নামটি বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানে ছড়িয়ে পড়ে।
দেশে লেখাপড়া শেষ করে মুহিত যুক্তরাজ্য গিয়ে চাকুরীতে যোগদান করে অক্সফোড বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যায়ন শুরু করেন। ১৯৫০-৫৯সময়ে পাকিস্তান সিভিল সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব ছিলেন এবং ৬৯সালে যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান দূতাবাসের পরামর্শ হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে কর্মরত থাকাবস্থায় পাকিস্তান কর্ম কমিশনের প্রধান উপ-সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৬সালে চাকুরিতে থাকাবস্থায় পূর্বপাকিস্তানের সাথে পশ্চিমপাকিস্তানের বৈষম্যের ঐতিহাসিক এক প্রতিবেদন পাকিস্তান কংগ্রেসে দাখিল করে ঝড় সৃষ্টি করেন। এটাছিল, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের বৈষম্যের প্রথম প্রতিবেদন। ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের প্রথম কূটনীতিবিদ মুহিত, স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে নিজের অবস্থান তুলে ধরে চাকুরী থেকে পদত্যাগ করেন এবং সেখানে যুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৭১সালে অস্থায়ী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের ওয়াশিংটন দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করেন। ৭২সালে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের সচিব, ৭৭সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগের সচিব, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৭২সালে বাংলাদেশ বিশ^ব্যাংকের সদস্য হওয়ার পর সেপ্টেম্বর মাসে মুহিত বিশ^ব্যাংকের ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা গ্রæপের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক নিযুক্ত হন। তিনি ৭৭-৮১সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক বিভাগের সচিব ছিলেন। ৮১সালে স্বেচ্ছায় চাকুরী ছেড়ে দেয়ার পর এরশাদ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব করলে, মুহিত নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার শর্তে মন্ত্রী হন। কিন্ত দুই বছর যাওয়ার পরও সরকার অঙ্গীকার ভঙ্গ করায় তিনি পদত্যাগ করেন। তাঁরপর তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হয়ে কাজ করেন। ১৯৮৩সালে বাংলাদেশ থেকে এসকাপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯সালে তিনি সিলেট-১আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ২০১৮সাল পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে বেশি বাজেট পেশ করেন। মন্ত্রী-এমপি, সচিব,বড় বড় পদে চাকুরি করলেও কোন অনিয়ম, দুর্নীতি তাঁকে স্পশ করতে পারেনি। এ হিসেবে তিনি ইতিহাসের এক বিরল ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে নিয়ে আমার কিছু স্মৃতিকথা তুলে ধরছি। ২০০৩সালে ছাতক থেকে একটি খোলা ট্রাকে দাঁড়িয়ে গাড়ীর বহর নিয়ে সিলেটের দিকে আসছিলেন। তখন সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের লামাকাজি এলাকায় এক বিশাল জনসভা চলছিল। গাড়ী বহর জনসভার কাছে পৌছলে মুহুমুহ শ্লোগানে মুহিতকে স্বাগত জানানো হয়। তখন তিনি জনতার মিছিলে দাঁড়িয়ে যান। আমি শ্লোগান দেয়ায়, তিনি আমাকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে সিলেটের বাসায় চলে আসেন। একপর্যায়ে আমার নিকট জানতে চান, তুমি আমার সম্পর্কে এতকিছু জানো কি করে ? আমি বলেছিলাম, আপনার কয়েকটি বই পড়ে জেনেছি এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি। হেঁসে হেঁসে মুহিত বলেছিলেন, জীবন সংগ্রামে তুমি জয়ী হবে। একপর্যায়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন, একনাগাড়ে ৩৫বছর তিনি ১৮ঘন্টা দিবানিশি বই পড়েছিলেন। আমি তাঁর মুখের দিকে হ্যাঁ করে থাকিয়ে ছিলাম। পাশে বসা ড. মোমেন হেঁসে বললেন, বই পড়া ভাইয়ের বড় অভ্যাস। মুহিত বলেছিলেন, ভালো বই মানুষের পরম বন্ধু। বই মানুষকে সভ্যতা ও আদব শেখায়। যে যত বেশি বই পড়বে, তত সে সভ্য হতে পারবে। পরের ঘটনা, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মচারীদের নিয়োগবিধি নেই, গ্রেড পরিবর্তন হয় না, পেনশন শতভাগের পরিবর্তে ৮০ভাগ দেয়া হয়। এ জঠিল সমস্যা শুনে মুহিত বিস্মিত হয়েছিলেন। কর্মচারীদের কথা মনযোগ সহকারে শুনে শতভাগ পেনশন, গ্রেড পরিবর্তনে তাঁর ভূমিকা প্রশংসনীয়। যদিও এখন পর্যন্ত নিয়োগবিধি হয়নি। মাঠ কর্মচারীরা তাঁকে ঢাকায় সংবর্ধনা দিতে চাইলে মুহিতের সময়ের অভাবে সম্ভব হয়নি।
সিলেট আইন কলেজের প্রতিষ্ঠাকালিন অধ্যক্ষ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, এডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ ও শিক্ষানুরাগী সৈয়দা শাহারা বানুর তৃতীয় পুত্র ছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে স্ত্রী সাবিয়া মুহিত, কন্যা সামিনা মুহিত, পুত্র শাহেদ মুহিত ও সামির মুহিতসহ দেশ বিদেশে অনেক সহকর্মি ছাত্র-শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজন রেখে গেছেন। পিতা আব্দুল হাফিজ ছিলেন, নিখিল ভারত মুসলিমলীগের সিলেট শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সিলেট গণভোট এবং পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে সক্রিয় ছিলেন। মা ভাষাআন্দোলনের নেত্রী ছিলেন। সাহারবানু ছুফি কবি সৈয়দ আশহর আলী চৌধুরীর নাতনি ছিলেন। দাদা খান বাহাদুর আব্দুর রহিম রায়নগর মুন্সী আব্দুল কাদের ও মতিবিবি বিনতে মোহাম্মদ উজায়েরের ছেলে। দাদী হাফিজাবানু ছিলেন পাঠানটুলার আব্দুল কাদেরের মেয়ে এবং শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামিদের বোন। জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন তিনির বোন ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন তাঁর ছোট ভাই।
বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচনে আবুল মাল আব্দুল মুহিতের অবদান অবিস্মরনীয়। অর্থনীতিক মুক্তি ও সমাজ প্রগতির ধারাকে এগিয়ে নিতে তাঁর চিন্তা, চেতনা, মানসিকতা ছিল, বাস্তব সম্মত। তিনি নিজের বিশ^াস ও জানাকে যেমন প্রতিষ্ঠায় তৎপর ছিলেন, তেমনি বিপরীত মেরুর লোকদের সম্মান করে তাদের চিন্তা ভাবনা জানতেন। মানুষকে কাছের টানার প্রখর ইচ্ছাশক্তি ছিল, তাঁর অসাধারন। তিনি অন্যায় করতেন না এবং অন্যায়কে প্রশ্রয়ও দিতেন না। সাধারন মানুষের মধ্যে অসাধারন পন্ডিত্ব ব্যক্তিছিলেন মুহিত। জাতির এই শ্রেষ্ট সন্তান মুহিতকে নিয়ে গবেষণা এবং তাঁর আত্মজীবনী পাঠ্য বইয়ে অর্ন্তভুক্ত করা একান্ত আবশ্যক। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আলোকিত এ মানুষের জীবন কর্ম নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেম ও মনুষত্ব বিকাশে অনুপ্রেরণা যুগাবে। মহান এই গুণীব্যক্তি যেন পরকালে শান্তিতে থাকেন, এ কামনা করছি।
লেখক
এএইচএম ফিরোজ আলী
কলামিষ্ট, সমাজবিশ্লেষক
সিলেট।