বাণিজ্য যুদ্ধের উত্তেজনা প্রশমিত করে এশীয় দেশগুলো কীভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারে, সেই পথ খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নানা চ্যালেঞ্জ ও সংঘাতে জর্জরিত বর্তমান বিশ্ব কাঠামোতে কীভাবে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমতার ভিত্তিতে উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে নিজের ভাবনা তিনি তুলে ধরেছেন ‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে।
গতকাল সকালে জাপানের টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও তাত্তি¡কদের অংশগ্রহণে এ সম্মেলনের উদ্বোধন হয়। সম্মেলনের এবারের প্রতিপাদ্য ‘বিশৃঙ্খলা দূর করে একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা চাই। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথীর মোহাম্মদ, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন এবং ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তে সম্মেলনে যোগদান করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, মানবতা আর শুভ শক্তির জয় হবেই। বিশ্ব আজ অনেক প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে, এই উদীয়মান এশিয়ার দিকে। উদ্ভাবনে, অনুপ্রেরণায় বিশ্বকে শান্তি আর সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে এশিয়াকেই নেতৃত্ব দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নত এশিয়া গড়ে তোলার লক্ষে আজ পাঁচটি ধারণা পেশ করে বলেছেন, বাংলাদেশ সংলাপের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে চায়। যা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে শান্তিপূর্ণভাবে মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর জন্য একটি উদাহারণ হতে পারে।
এশিয়ার নেতৃবৃন্দের সামনে একটি সমৃদ্ধ এশিয়া গড়ে তোলার জন্য পাঁচটি ধারণা উপস্থাপনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একে বাস্তবে রূপদান করতে সরকার হিসেবে আমরা আমাদের ভূমিকা পালন করেছি এবং এ সম্পর্কে আপনাদের অভিমত ব্যক্ত করার জন্য এখানে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
প্রথম ধারণায় তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্ব বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এবং সংঘাতে পরিপূর্ণ।
তাই, আমাদের বৃহৎ উদারতায় বিশ্বকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার করা প্রয়োজন, বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জগুলো যৌথভাবে মোকাবেলা করা, স্বচ্ছতা ও ন্যায় বিচার সুরক্ষা করা এবং উদ্ভাবনী ধারণা এবং পদক্ষেপের ব্যবহার করে সহযোগিতার নতুন উদ্দীপনা জোরদার করা।
প্রধানমন্ত্রী তার দ্বিতীয় ধারনায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অংশীদারিত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, দলগত কর্মকান্ডকে অতিক্রম করে অর্থনীতিকে উদ্ভাবনী চর্চার মধ্যদিয়ে যেতে হবে। পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সম্মানের উপর ভিত্তি করে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে, জনগণের লাভের জন্য এবং সাধারণ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সকলের জন্য সমান সুবিধাজনক কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
তৃতীয় ধারণায় তিনি আরো বলেন, এশীয় দেশগুলোকে খোলা মন নিয়ে পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে, অন্তর্ভুক্তিমূলকভাবে, সমতা, অংশীদারিত্ব এবং যৌথ অনুদানের ভিত্তিতে। চতুর্থ ধারণায় শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিক ধারাবাহিকতা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবার জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে টেকসই এবং সমতাভিত্তিক উন্নয়নের ওপর এশিয়ার ভবিষ্যত নির্ভর করছে।
তিনি বলেন, আমাদের সংঘবদ্ধভাবে উন্নয়ন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে। সে জন্য আমরা একটি গোত্রবদ্ধ হয়ে দলগত ভাবে বিশ্ব শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে পারি, যার লক্ষ্য হবে একটি বহুমুখী বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর যথাযথ অধিকার এবং স্বার্থকে সংরক্ষণ করা।
যোগাযোগ সম্পসারণের প্রতি গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা যোগাযোগ ব্যবস্থারই একটি গতিশীলতা যেটি বিশ্বজুড়ে শান্তি এবং সমৃদ্ধির ভিত রচনা করেছে। অবকাঠামো, মুক্ত বাণিজ্য এবং সহজ বিনিয়োগ এশিয়ার উন্নয়নের ভিত্তি ।
জাপানি বিনিয়োগের জন্য সহায়তা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জন্য আরও জাপানি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহায়তা কামনা করেছেন। জাইকার প্রেসিডেন্ট শিনীচি কিতাওকা গতকাল টোকিওতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করলে তিনি এ আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা লেখক (সচিব) মো. নজরুল ইসলাম বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেন, প্রধানমন্ত্রী জাপানের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধান করে আরও বিনিয়োগের অনুরোধ জানান। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে জাপানকে বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে জাপান আমাদের অনেক সাহায্য করেছে। তিনি তরুণ প্রজন্মকে সুদক্ষ করার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য জাইকার প্রতি আহ্বান জানান।
জাইকার প্রেসিডেন্ট অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বিনিময়ের মাধ্যমে মানব সম্পদের বিকাশের জন্য কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বলেও জানান মো. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী জাইকার প্রেসিডেন্টকে জানান, জাপানের মতোই কৃষি থেকে শিল্পায়নের পথে চলতি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ এখন কৃষি যান্ত্রিকীকরণের দিকে এগিয়ে চলছে। এই প্রসঙ্গে তিনি জাপানকে রোল মডেল হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বিশ্বে প্রধান্য বজায় রাখার লক্ষ্যে এশিয়ার উন্নত, উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে ঢাকায় সন্ত্রাসী হামলায় জাপানের নাগরিকদের মৃত্যুর কথাও স্মরণ করেন এবং তার দুঃখ ও সহানুভূতি প্রকাশ করেন।
জাইকা প্রেসিডেন্ট তৃতীয় মেয়াদে পুননির্বাচিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। বাংলাদেশ ও জাপানের দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনাকে ফলপ্রসূ হিসাবে বর্ণনা করে জাইকার প্রেসিডেন্ট বলেন, তারা এখন বাংলাদেশের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবেন। জাইকা প্রেসিডেন্ট বলেন, তারা বাংলাদেশে গবেষণা কর্মসূচি আরও জোরদার করবেন।
এ সসময় উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী এএইচএম মুস্তাফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক, জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। সুত্র ইনকিলাব