এ এইচ এম ফিরোজ আলী
আজ ১০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বিশ্বনাথ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর দিনটি ছিল শুক্রবার। এ দিনে আনুষ্টানিকভাবে বিশ্বনাথকে হানাদার মুক্ত ঘোষনা করা হয়েছিল। সেদিন লাল সবুজের পতাকা স্বাধীনতার প্রতীক বিশ্বনাথের আকাশে উড়তে থাকে। এ দিবসটির সাথে এ অঞ্চলের মানুষের হাঁসি-কান্না, সুখ-দুঃখ এবং করুণ অনেক স্মৃতি বিজড়িত রয়েছে। ৭১ সাল থেকে ২০২০ সালে পুরো ৪৯ বছর পূর্ণ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যেমন, বিশ্বনাথবাসির গর্ব ও আনন্দের সীমা নেই, তেমনি দুঃখের ক্ষত অনেক গভীর এবং তা মর্মে মর্মে উপলব্দি করছেন মুক্তিগামি মানুষ। ৭১ সালের মুক্তিগামি মানুষের ক্ষতের দাগ এখনও শুকায়নি। দীর্ঘ ৪৯ বছর পূর্বের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ঘটনা বলি নিয়ে তৈরী করা হয়েছে আজকের এ প্রতিবেদন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে এবং অনেকগুলো সাব সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। বিশ্বনাথ থানা ছিল, ৪ ও ৫ নং সেক্টরে। ১৯৭১ সনের ২০ নভেম্বর ৪নং সেক্টরের ১নং কোম্পানি কমান্ডার মো: আব্দুন নুর কমলগঞ্জ থানার পতনসার ইউনিয়ন শত্রুমুক্ত ঘোষনা করে ৫-৭ ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে সমশের নগরকে শত্রুমুক্ত ঘোষনা করেন। তাঁর পর তিনি নিজ এলাকার দিকে অগ্রসর হয়ে, ৯ ডিসেম্বর তাজপুর, দয়ামির, কুরুয়া, নাজির বাজার, রশিদপুর পথসভা করে বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করেন। রশিদপুর এসে জানতে পারেন, বিশ্বনাথ থানার তৎকালিন ওসি আবুল হোসেন এবং দারগা আলী হোসেন, স্থানীয় রাজাকারদের পরামর্শে মুক্তিযোদ্ধাদের পতাকা উত্তোলন করতে বাঁধা দিচ্ছেন এবং রাজাকাররা থানা দখল করে বসে আছে। এই সংবাদে কমান্ডার আব্দুন নুর ক্ষুব্ধ হয়ে স্বদল বলে বিশ্বনাথ থানায় এসে পুলিশ ও রাজাকারদের আত্নসমর্পনে বাধ্য করেন। ৯ ডিসেম্বর রাত গভীর হওয়ায় পরদিন সকলের উপস্থিতিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে শত্রুমুক্ত করার ঘোষনা দেয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর শুক্রবার রামসুন্দর অগ্রগামি উচ্চ বিদ্যালয়ে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে বিশ্বনাথকে হানাদার ও রাজাকার মুক্ত ঘোষনা করেন কমান্ডার আব্দুন নুর। এসময় তিনি মীরের চর গ্রামের আব্দুল মতলিব বিএসিকে প্রশাসক ঘোষনা করেন। এসময় সমবেত জনতা জয় বাংলা-জয়বঙ্গবন্ধু শ্লোগান দিয়ে বিশ্বনাথের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। পরদিন ১১ ডিসেম্বর শনিবার দৌলতপুর গ্রামের আব্দুর রব চৌধুরী উরফে সমুজ মিয়ার সভাপতিত্বে বিজয় অনুষ্টানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন ৫নং সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার খাজাঞ্চি ইউনিয়নের টিমাইঘর (রায়পুর) গ্রামের মৌলভী আমজদ আলীর পুত্র আব্দুন নুর। বিশেষ অথিতির বক্তব্য রাখেন ৫নং সেক্টরের লেন্স নায়ক ছোট দিঘলি সোলেমান নগর গ্রামের গোলাম মস্তফা। বিজয় মঞ্চে বক্তব্য রাখেন মরমি কবি হাছন রাজার দৌহিত্র শমসের রাজা চৌধুরী, আব্দুল মতলিব বিএসসি, মীরের চর গ্রামের আব্দুল মন্নান উরপে মনাফ, চানশির কাপন গ্রামের কয়েছ চৌধুরী, মুফতির গাঁও গ্রামের আকমল আলী, ধর্মধা গ্রামের মাষ্টার তজম্মুল আলী, নোয়াগাঁও গ্রামের আছলম খান, রাজনগর গ্রামের একরাম আলী, নরশিংপুর গ্রামের আইন উল্লাহ মহাজন সহ অনেকেই। মুলত ১০ ডিসেম্বার শত্রুমুক্ত ঘোষনা করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং ১১ ডিসেম্বর সমাবেশ করা হয়।
বিশ্বনাথে বিজয়ের পতাকা উত্তোলনে রাজাকার ও থানা পুলিশ বাঁধা দিচ্ছে, এমন সংবাদ চলে যায় দেওয়ান ফরিদ গাজি এবং ৫নং সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী, বিশ্বনাথের দায়িত্বে থাকা ক্যাপটেন আব্দুর রউফের নিকট। তারা বিশ্বনাথ এসে আল বদর প্রধান ২জন মাওলানাকে আটকের নির্দেশ দেন। একজনকে ছেড়ে দেয়া হলেও অপরজনকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। তখন কয়েকজন রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধারা গণ ধোলাই দেয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্বনাথের যেমন সুনাম ও অপরিসিম অবদান রয়েছে, তেমনি দূর্নামও কম হয়নি। এখানে ইসলামের নামে কিছু লোক হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার আল বদর বাহিনী গঠন করে মানুষের ঘরবাড়ি পুড়িয়েছেন। অনেক গ্রামে নারী ধর্ষনের মত ঘটনাও ঘটেছে। অনেককে গুলি করে হত্যাও করা হয়েছে।
৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাক হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় বিশ্বনাথ থানা সদর, লামাকাজি, কামাল বাজার, রশিদপুর, নাজির বাজার, খাজাঞ্চি রেলওয়ে ব্রিজ, গোবিন্দগঞ্জ, পরগনা বাজার সহ অনেক জায়গায় ব্যাংকার খনন করে ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করায় বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্থান্তরের জন্য পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে জেনারেল এহিয়া খানকে অনুরোধ করেছিলেন দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরী। একারনে তৈমুর রাজার রামপাশার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় হানাদার বাহিনী। বাড়িতে থাকা তিনির নিজের পিস্তল, সোনা, গয়না সহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নেয় হানাদার ও তার ধুসররা। জানাইয়া গ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা মনু মিয়ার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় একজন মেয়েকে ধর্ষন করে পাক হানাদাররা। মনু মিয়াকে না পেয়ে তার চাচাতো ভাই ময়না মিয়াকে গ্রেফতার করে পরে মুক্তি দেয়া হয়। মদন মোহন কলেজের অধ্যক্ষ কৃষ্ণ কুমার পাল চৌধুরীকে আশ্রয় দেয়ার কারেন স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় হরিকলস গ্রামের পদ্যকেশ বাবুর বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। ক্যাপটেন করম খানের নেতৃত্বে পদ্যকেশ চৌধুরীর ভাই ভোমকেশ চৌধুরীকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। তার লাশও খুজে পাওয়া যায়নি। বিশ্বনাথ পুরান বাজারের মিষ্ট ব্যবসায়ি কমলগঞ্জের বাসিন্দা ধীরেন্দ্র কুমার দাশকে গুলি করে হত্যা করে হানাদার ও রাজাকার বাহিনী। দেওকলস গ্রামের সরদার পাড়া গ্রামের আব্দুস সাত্তারকে হানাদাররা ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে। তাঁর শরীর থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বের করে অন্যদের মুখে দেয়া হত। খাজাঞ্চি ইউনিয়নের কর্মকলাপতি গ্রামের ডাক বিভাগের চাকুরিজীবি বসন্ত কুমার দাশের বাড়িঘর পুড়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। লামাকাজি ইউনিয়নের দিঘলি গ্রামের পার্শবর্তী এলাকার জিতেন্দ্র সেন, নারায়ন সেনসহ ৩জনকে উলঙ্গ করে গুলি করে হত্যা করা হয়। অলংকারি ইউনিয়নের পেশকারগাঁও গ্রামের আইয়ুব আলী, সুরুজ আলী, নিপেন্দ্র কুমার দাস সহ এই এলাকার ১৫/১৬ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাক হায়েনারা। স্থানীয় জনসাধারনের মতে, এখানে অনেক লোককে জড়োকরে হত্যা করা হয়েছে। খাজাঞ্চি ইউনিয়নের কুমারপাড়া গ্রামের সুনাউল্লা ভোলাগঞ্জ গ্রামের আব্দুর রহমানের স্ত্রী সহ এই এলাকার অনেক নারী পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। নুর পুর গ্রামের ডাক্তার আব্দুল করিম, পাহাড়পুর গ্রামের লিলু মিয়া, গমরাগুল গ্রামের মজম্মিল আলী, ঘাসি গ্রামের ছমরু মিয়া, লালার গাঁও গ্রামের ডাক্তার মানিক চন্দ্র দাশের জামাতা রনদাশ সহ অনেককে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে পাক হানাদার ও রাজাকার বাহিনী। সিলেট শহরের বর্তমান ক্যাডেড কলেজ এলাকায় পাকবাহিনীর হেড কোয়াটার ছিল। সেখানে রাজাকাররা সংবাদ দিলে হিন্দু ও আওয়ামীলীগ সমর্থকদের ধরে নিয়ে অত্যাচার নির্যাতন করা হতো। রাজাকাররা প্রতিদিন প্রত্যেক গ্রাম থেকে গরু, মহিষ, হাঁস-মুরগি, ছাগল-ভেড়া ধরে নিয়ে পাক হানাদারদের খাবারের জন্য তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যেত। এভাবেই রাজাকারদের সহায়তায় বিশ্বনাথের বিভিন্ন অঞ্চলে ৭১সালে মানুষের উপর বর্বর নির্যাতনের তান্ডব চালানো হয়েছিল। দীর্ঘদিন সরেজমিনে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দী ও কমান্ডার আব্দুন নুরের নিজ হাতে লেখা থেকে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। (অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন তথ্যবাদ পড়লে সংশোধনের জন্য সহায়তা কামনা করছি)।
লেখক সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
১০ ডিসেম্বর ২০২০ইং