নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্বনাথ থানার চাঞ্চল্যকর ডাবল মার্ডারের আসামী খুনি সাইফুলকে বাদী পক্ষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় আটক করতে সক্ষম হয়েছে। অল্পের জন্য সাইফুল পালিয়ে যেতে পারেনি। স্কুলছাত্র সুমেল হত্যা মামলার বাদী ইব্রাহিম আলী সিজিল গোপনে খবর পান যে, আসামী সাইফুল ঢাকায় অবস্থান করছে। সে মহামান্য হাইকোর্টের নিদের্শ অমান্য করে সিলেটের আদালত পাড়ায় কয়েকদিন ঘুরাফেরা করে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকার সেগুনবাগিছা এলাকার একটি ১১তলা বিল্ডিংয়ে সাইফুল অবস্থান করছে। এ খবর পেয়ে চারদিন পূর্বে (গত সোমবার) সুমেলের চাচা মামলার বাদী ইব্রাহিম আলী সিজিল, আফজল, কুতুব উদ্দিন ও দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আনোয়ার হোসেন ধন মিয়া ঢাকায় চলে যান। তারা সেগুনবাগিছা এলাকার ১১তলা বিল্ডিংটি চিহ্নিত করে গোপনে সাইফুলের আসা যাওয়ার বিষয়টি নজরে রাখেন।
আজ ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সাইফুল বাসা থেকে বের হয়ে হাইকোর্টে চলে যায়। সেখান থেকে বাদী পক্ষ পিছু নেয় এবং হাইকোর্ট এলাকার একটি রেষ্টুরেন্টে সাইফুলকে নাস্তা করতে দেখতে পায়। সেখান থেকেও তারা পিছু নেন। একপর্যায়ে সাইফুল বিকাল তিনটার দিকে সেগুনবাগিছার বাসার ভেতরে ঢুকলে বাসাটি বাদীপক্ষের লোকজন ঘেরাও করে ফেলে। সাইফুল বাসার ভেতরে নিশ্চিত অবস্থান করছে এমন খবর নিয়ে একজন রমনা থানায় চলে যান। সেখান থেকে রমনা থানা মাত্র ৩মিনিটের রাস্তা। কিন্তু রমনা থানা পুলিশ বিশ্বনাথ থানা পুলিশের অনুমতি ছাড়া সাইফুলকে গ্রেফতার করতে অনিহা প্রকাশ করে। তারপর সিজিল বিশ্বনাথ থানার ওসিকে বিষয়টি অবহিত করলে ওসি গাজী আতাউর রহমান ই-মেইলে রমনা থানাকে গ্রেফতারের জন্য অনুরোধ করেন। মধ্যখানে কয়েক ঘন্টা সময় পেরিয়ে যায় এবং সাইফুল বিষয়টি বুঝতে পেরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। রমনা থানার পুলিশ বাসার ভেতরে ৫তলা পর্যন্ত গিয়ে তল্লাশী করে সাইফুলকে না পেয়ে নিচে নেমে আসে। কিন্তু বাদী পক্ষের লোকজন সাইফুল এই বিল্ডিংয়ে আছে নিশ্চিতভাবে পুলিশকে অবগত করে। কিন্তু পুলিশ দায়সারাভাব দেখাচ্ছিল। একপর্যায়ে বাদী ইব্রাহিম আলী সিজিল ও আফজল দুজন তারা পুলিশের কথা না শুনে বিল্ডিংয়ের ভেতরে প্রবেশ করে ১১তলায় গিয়ে দেখতে পায় সাইফুল সিড়ির নিচে লুকিয়ে আছে। তারা তাকে ঝাপটে ধরে নিচ তলায় পুলিশের সামনে নিয়ে আসেন। এসময় সাইফুল ছুটে যাওয়ার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করে। বাসার বাইরে লোকজন জড়ো হতে থাকেন এবং তখন রমনা থানা পুলিশ সাইফুলকে তল্লাশী শুরু করে থানায় নিয়ে যায়। এভাবে ডাবল মার্ডারের খুনি কোটিপতি সাইফুল বাদী পক্ষের সাহসিকতার কাছেই হার মানতে হয়েছে। সাইফুলের আটকের এমন কাহিনী নিশ্চিত করেছেন বাদী ইব্রাহিম আলী সিজিল ও আফজাল হোসেন। খুনি সাইফুল চৈতননগর ইসলামপুর গ্রামের মৃত আফতাব আলীর পুত্র। সাইফুল গ্রেফতারের খবর মুহুর্তের মধ্যে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, গত ২৮ জানুয়ারী চাউলধনী হাওরে ছরকুম আলী দয়ালকে সাইফুল ও তার বাহিনী হত্যা করে। বিশ্বনাথ থানার প্রাক্তন ওসি শামীম মূসা ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ফজলু সাইফুলকে থানায় পেয়েও গ্রেফতার করেননি। সাইফুলের লাইসেন্সকৃত অস্ত্র এবং বেশকিছু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য থানা পুলিশকে লিখিত ও মৌখিক ভাবে অবহিত করলেও কোন কাজে আসেনি। অবশেষে ওসি শামীম মূসা ও এসআই ফজলুর সাথে পরামর্শ করে সাইফুল চৈতননগর গ্রামের নজির উদ্দিনের বাড়ি ও ক্ষেতের জমিতে গত ১লা মে জোরপূর্বক মাটি কাটা শুরু করে। এতে বাদীপক্ষ বাধা দিলে সাইফুলের বন্দুক ও ৭/৮টি অবৈধ পিস্তল এবং একনালা বন্দুক দিয়ে উপর্যপুরি গুলিবর্ষন করলে স্কুলছাত্র সুমেল নিহত হয়। এসময় সুমেলের বাবা-চাচাসহ ৪জন গুলিবিদ্ধ হন।
ঘটনার পর সিলেটের ডিআইজি, পুলিশ সুপারসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের প্রধানগণ ঘটনাস্থলে গিয়ে সাইফুল ও তার বাহিনীকে গ্রেফতার, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দিলেও নয় মাসে খুনিরা গ্রেফতার হয়নি ও অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। পুলিশের চরম দায়িত্ব অবহেলার কারনে ওসি শামীম মূসা ও এসআই ফজলুকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়। কিন্তু এসআই ফজলুর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হলেও ওসি শামীম মূসার বিরুদ্ধে এখনও বিভাগীয় মামলা দায়েরের খবর পাওয়া যায়নি। এ দুজন সুমেল হত্যা মামলার ঘটনাস্থলের আলামত রক্তও নষ্ট করেছিলেন।
গত ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর সুমেল হত্যার ২০জন আসামী মহামান্য হাইকোর্টে হাজির হয়ে আগাম জামিনের প্রার্থনা করলে ৫জনকে ১২ অক্টোবরের মধ্যে নিম্ন আদালতে হাজির হওয়ার নিদের্শ দেন মহামান্য হাইকোর্ট এবং পুলিশকে হয়রানী না করার জন্য আদেশ দেন। ১৫জনকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করেন মহামান্য হাইকোর্ট। কিন্তু ১২ অক্টোবর সাইফুল, সদরুল, নজরুল, সিরাজ ও আছকির মহামান্য হাইকোর্টের নিদের্শনামতে নিম্ন আদালতে সারেন্ডার করেনি। বরং ডাবল মার্ডার মামলার আসামী হয়ে সিলেটের আদালতপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে রাজার মতো ঘুরাফেরা করতে দেখা যায়। তাকে গ্রেফতারের জন্য বাদী পক্ষ অনেক দৌড়ঝাপ দিলেও কেউ কোন কর্নপাত করেননি। খুনিদের গ্রেফতারের বিষয়টি যেন হঠাৎ থমকে যায়! অবশেষে প্রকৃতির নিয়মেই খুনের অপরাধে অপরাধী সাইফুলকে বাদী ও স্বাক্ষীদের হাতে আটক হতে হয়েছে। আটকের খবর পেয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বিশ্বনাথ থানার ওসি (তদন্ত) রমা প্রসাদ চক্রবর্তী একদল পুলিশ নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন এবং বাদী পক্ষের লোকজনও ঢাকায় যাচেছন বলে খবর পাওয়া গেছে। খুনি সাইফুলের গ্রেফতারে বিশ্বনাথসহ প্রবাসীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।