অনলাইন ডেস্ক :: সংস্কারের জন্য ঐকমত্য গঠনের সংলাপে বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতাই বেশি হচ্ছে। ৭০ অনুচ্ছেদ, চারটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসহ কিছু কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দলকে দেওয়া এবং প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ইস্যুতে বিএনপি কিছুটা ছাড় দিচ্ছে। তবে নারী আসনে নির্বাচন এবং সংসদের উচ্চকক্ষ নিয়ে তারা আগের অবস্থানেই রয়েছে। ধর্মভিত্তিক দলগুলো নারী আসন বাড়ানোর বিপক্ষেই।
অন্যান্য দলের মতামত না নিয়ে লন্ডনে সরকার ও বিএনপির বৈঠকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা নির্ধারণের প্রতিবাদে সংলাপ বয়কট করেছে জামায়াতে ইসলামী। লন্ডন বৈঠক নিয়ে ক্ষুব্ধ জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সংলাপে যোগ দিলেও নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলেছে। তারা অভিযোগ করছে, সরকার ও ঐকমত্য কমিশন বিএনপির দিকে হেলে পড়েছে।
তবে গতকাল মঙ্গলবার দিনভর ২৯ দল ও জোটের সংলাপ শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, ইতিবাচক অগ্রগতি হচ্ছে। জামায়াতের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি আশা করছেন, বুধবার (আজ) দলটি আলোচনায় ফিরবে। রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ সংলাপ হচ্ছে।
ঘোষণা ছাড়াই অনুপস্থিত জামায়াত
গতকাল বেলা ১১টায় শুরু হওয়া দ্বিতীয় ধাপের এ সংলাপে পূর্বঘোষণা ছাড়াই অনুপস্থিত থাকে জামায়াত। পরে জানা যায়, দলটি ‘লন্ডন বৈঠক’-এর প্রতিবাদে বয়কট করেছে। মধ্যাহ্ন বিরতির পর সংলাপে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন অনুরোধ জানালেও জামায়াত তাতে সাড়া দেয়নি।
এতদিন সংলাপে দলের প্রতিনিধিত্ব করা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, ‘একটি দলের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের সময়সীমা ঠিক করায় সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এর প্রতিবাদে জামায়াত সংলাপে যায়নি। সরকার অবস্থান পরিষ্কার করবে বলে জামায়াত আশা করে।’
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলবে এ সংলাপ। এর পর বিরতি দিয়ে রোববার থেকে আবার শুরু হবে। জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে মঙ্গলবারের সংলাপ বয়কট করা হয়েছে। দলটির এক জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেন, ‘শুধু বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে সরকার কীভাবে নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করেছে; কেন একটি দলের সঙ্গে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে– ঐকমত্য কমিশন এর জবাব দিলে জামায়াত সংলাপে ফিরবে।’
ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে সরকারের এ অবস্থানকে জামায়াত সমর্থন করলেও বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে সরকারকে চাপে রেখেছিল। এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণাও দলটি প্রত্যাখ্যান করেছিল।
গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সংস্কার ও বিচারের অগ্রগতি সাপেক্ষে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে। সরকার পতনের পর বিএনপির নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার চেষ্টায় থাকা জামায়াত যৌথ বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে পরদিন বলেছে, ‘এর মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তাঁর নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করেছে।’
আলোচনা চলার এক পর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আসেন। জামায়াতের অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার নিরপেক্ষই রয়েছে।
জামায়াত ১৪ জুন বিবৃতিতে বলেছিল, প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি দেওয়ায় আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে কিনা– আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এটি নিরসনে প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা জাতির সামনে স্পষ্ট করা হবে বলে জামায়াত আশা করে।
লন্ডন বৈঠকের বিষয়ে জামায়াতের জ্যেষ্ঠ এক নেতা সমকালকে বলেন, ‘আমরাই প্রথম বলেছি, রমজানের আগে নির্বাচন হওয়া উচিত। তাই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে আপত্তি নেই। কিন্তু সরকার শুধু বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় সময় নির্ধারণ করেছে। এতে জামায়াতসহ অন্যান্য দলকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।’
৩ জুন মুলতবির পর গতকাল শুরু হওয়া সংলাপে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন পদ্ধতি এবং কোন কোন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দলকে দেওয়া হবে– এসব বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে। এসব নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের মতবিরোধ রয়েছে। জামায়াতের অবস্থান ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের কাছাকাছি। মৌলিক সংস্কার নিয়ে দলটির একই অবস্থান।
সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত এক জামায়াত নেতা সমকালকে বলেন, ‘বিএনপি সংস্কারের পদে পদে বাধা দিচ্ছে। জামায়াত যথাসম্ভব ছাড় দিয়ে নিজের অবস্থান বদল করেছে ঐকমত্যের স্বার্থে। তার পরও শুধু বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করায় বার্তা গেছে– বিএনপি না চাইলে সংস্কার হবে না। তাই সংলাপ এখন অর্থহীন।’
বিএনপির কিছু ছাড়
বিএনপিসহ সব দল ৭০ অনুচ্ছেদ শিথিলে একমত। এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টিসহ কয়েকটি দলের প্রস্তাব– দলীয় এমপিরা অর্থ বিল এবং আস্থা ভোট বাদে অন্যান্য বিষয়ে ভোটদানে স্বাধীন থাকবেন। তবে বিএনপি প্রস্তাব করেছে, এই বিষয় ছাড়াও সংবিধান সংশোধন এবং যুদ্ধাবস্থায় এমপিরা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে ভোট দেবেন।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। বিএনপি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে একমত হয়েছে। এতে বলা থাকবে, বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহার, সংবিধান সংশোধন এবং যুদ্ধাবস্থার বিষয়টি থাকবে। পরবর্তী সময়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে, সে জন্য ইশতেহারে প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করবে বিএনপি। বিএনপি নারী আসন ১০০ নির্ধারণের পক্ষপাতী। তবে সরাসরি নির্বাচন নয়, বিদ্যমান পদ্ধতিতেই আসন বণ্টন চায়।
ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাব করেছিল, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করা হবে। এতে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ অধিকাংশ দল একমত হয়েছিল। বিএনপির প্রস্তাব ছিল– জ্যেষ্ঠতম তিন বিচারপতি থেকে একজনকে প্রধান বিচারপতি করা হবে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, কমিশন প্রস্তাব করেছে– জ্যেষ্ঠতম দুই বিচারপতি থেকে প্রধান বিচারপতি হবেন। বিএনপি এতে একমত।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করেই বিচারপতি নিয়োগ কাউন্সিল অধ্যাদেশ করেছে। বিএনপি এই আইনের পক্ষে। অধ্যাদেশটি যখন সংসদে পাস করা হবে, তখন কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে। বিএনপি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে। বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হলে জ্যেষ্ঠতম দু’জন থেকে প্রধান বিচারপতি হলে সমস্যা নেই।
দ্বিকক্ষ সংসদ বিএনপির ৩১ দফায় রয়েছে জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অধিকাংশ দল এতে একমত। তবে কিছু আপত্তিও রয়েছে। উচ্চকক্ষের নির্বাচন কীভাবে হবে, এই আলোচনা এখনও হয়নি। নিজ নিজ দলে আলোচনা করে মতামত জানাবে।
কমিশন প্রস্তাব করেছে, নিম্নকক্ষে পাস হওয়া বিল উচ্চকক্ষ সংশোধন বা পুনর্বিবেচনার জন্য একবার ফেরত পাঠাতে পারবে। নিম্নকক্ষ পুনরায় পাস করলে উচ্চকক্ষ আটকাতে পারবে না। সালাহউদ্দিন আহমেদ বৈঠকে বলেন, নিম্নকক্ষে কোনো বিল দ্বিতীয়বার পাস হলে তা আর উচ্চকক্ষে পাঠাতে হবে না।
সংবিধান সংশোধনে সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রস্তাব করেছে কমিশন। প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপিও এতে একমত। তবে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হতে হবে বিদ্যমান নারী আসন বণ্টন পদ্ধতিতে।
এতে নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই উচ্চকক্ষে সমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। ফলে উচ্চকক্ষের প্রয়োজনই নেই– অন্যান্য দলের এ অবস্থান বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপি ভোটের সংখ্যানুপাতিক আসন বণ্টনের পক্ষে নয়। কিছু দল এ পদ্ধতি চাইছে। যদি কোনো গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব অন্যান্য দল থেকে আসে বিএনপি বিবেচনা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
ঐকমত্য কমিশন এবং অন্যান্য দল আনুপাতিক পদ্ধতির উচ্চকক্ষকে মৌলিক সংস্কার বলছে। সালাহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, সংসদের সরকারি হিসাব, অনুমিত হিসাব, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিশ্রুতি-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিরোধী দলকে দিতে সম্মত হয়েছে আগেই। মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিগুলো বিরোধী দলগুলোকে আসনের অনুপাতে দেওয়ার বিষয়েও একমত। জামায়াতের বয়কট বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ বিষয়ে তাঁর বলার কিছু নেই। তবে আশা করেন, জামায়াত ফিরবে।
এনসিপির অভিযোগ
সরকার ও কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ বলে অভিযোগ করে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকার গণভোট থেকে সরে গিয়ে একটি দলের কথা মেনে সংসদ নির্বাচনের দিকে গিয়েছে। একটি দল এবং তাদের সমমনাদের প্রাধান্য দিচ্ছে কমিশন।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা বলেন, ১০০ সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে। উচ্চকক্ষের আসন অবশ্যই সাধারণ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে বণ্টন করতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুর, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি একই অবস্থান জানান। তবে এবি পার্টির ফুয়াদ আবদুল্লাহ বলেন, তাদের দল দ্বিকক্ষের সংসদের পক্ষে নয়।
ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ অধিকাংশ ধর্মভিত্তিক দল নারী আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করার বিরোধিতা করেছে। ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, নারীর জন্য ১০০ আসন করতে হলে নির্বাচন হতে হবে ভোটের সংখ্যানুপাতে। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, তত শতাংশ নারী আসন পাবে। সংলাপে জামায়াতের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে ইসলামী আন্দোলন।
আলী রীয়াজ বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদ, চারটি কমিটিসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আসনের অনুপাতে বিরোধী দলকে দেওয়া, নারীদের আসন স্থায়ীভাবে ১০০টি করার জন্য সবাই একমত। এর পর পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চলছে এবং চলবে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে একমত হওয়া যাবে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় বদিউল আলম মজুমদারসহ কমিশনের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন সংলাপে। আগের অসমাপ্ত বিষয় এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে আজ আলোচনা হবে।