বাঙালি জাতীকে মেধাশুন্য করতে জাতীয় চার নেতাকে জেলে হত্যা করা হয়েছিল

আন্তর্জাতিক জাতীয় রাজনীতি সারাদেশ
শেয়ার করুন

এএইচ এম ফিরোজ আলী

আজ ৩রা নভেম্বর শুক্রবার ৪৯তম জেল হত্যা দিবস। জাতীয় জীবনে এদিনটি অত্যন্ত বেদনা বিধুর ও জঘন্যতম কলঙ্কিত, বর্বরত ঘটনার দিন। বিশ্বের মানব সভ্যতার ইতি হাসে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। ১৯৭৫সালের এদিনে ঢাকা কাশিম বাজার কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন, মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপটেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজজামান। রাষ্ট্রের আইন বেষ্টিত নিরাপদ স্থান কারাগারে সংঘটিত হত্যাকা-টি ছিল, ষড়যন্ত্রের একটি ধাপ। জাতিকে মেধা, নেতৃত্ব শূন্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করা ছিল হত্যাকান্তের মূল লক্ষ্য। ১৯৭৫সালের ১৫আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা, বাংলাদেশকে পেছন দিকে ফিরিয়ে নেয়ার সূদুর প্রসারি পরিকল্পনার অংশ।

ঐতিহাসিক তথ্য মতে, আওয়ামীলীগের ভেতরই মূল বিশ্বাস ঘাতকদের জন্ম হয়েছিল। খন্দকার মুশতাক, কেএমও বায়েদুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী তলে তলে মুলসর্বনাশের কারন ছিল। বঙ্গবন্ধু নিজে দেখেও বিশ্বাস করেননি। তিনি ছিলেন এক বিশাল উদার মনের ও অতি মানবিক গুন সম্পন্ন মানুষ। কোন বাঙালি তাকে হত্যা করবে সেটা বিশ^াস করেননি বলে তাঁর ভেতরে ঢুকেই বিশ্বাসের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিল ঘাতকরা।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মুশতাক প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার অনেকেই মুশতাককে সমর্থন দেয়ায় শুধু বাঙালিনয়, সমস্ত দুনিয়া স্তম্ভিত ও হতভম্ভ হয়ে পড়েছিল। এতে খুনিরা সহজে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ৩রা নভেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যাকান্ডের ঘটনা করার সাহস পায়। সাংবিধানিকভাবে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি জাতীয় চার নেতা যাতে ক্ষমতা গ্রহন না করেন, সে কারণেই নিষ্টুর খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খুনী মুশতাক। জেল খানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার জন্য ৫সদস্য বিশিষ্ট একটি ঘাতক দল গঠন করে দলের প্রধান ছিল রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন। প্রখ্যাত সাংবাদিক এ্যস্থনী মাসকারেনহাস তাঁর’ বাংলাদেশ এ্যান্ডলিগ্যাল অব ব্লাড, গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। লেখক গোলাম খুরসিদ তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর, গ্রন্থে বলেছেন, খন্দকার মুশতাক জেল হত্যার পরিকল্পনা করেছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কোন পাল্টা অভ্যূত্থান হলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার নেতাকে হত্যা করা হবে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বঙ্গভবন পাহারায় ছিল ফারুক-রশিদ গ্রুপ। একদিন ফারুক রশিদ দৃঢ় কন্ঠে বলেছিল, শেখ মুজিবের সহযোদ্ধাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। প্রাক্তন তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাঈদ রচিত জেল হত্যা শীর্ষক বইয়ে একথা উল্লেখ রয়েছে। এ বইয়ে আরও বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর মন্ত্রীসভা গঠনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টারের বাসায় আলোচনায় তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মাহবুবুল আলম চাষী মুস্তাকের সাথে ছিলেন। একপর্যায়ে তাহের উদ্দিন ঠাকুর বলেন, আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা সংসদ সদস্য নেতৃত্ব বৃন্দ আনুগত্য লাভে প্রেসিডেন্টলিস্ট করতে পারেন। তখন কর্নেল ফারুক রহমান বলেছিল, স্যারলিস্ট আমাকে দেখাবেন। জাতীয় চার নেতা মস্তাকের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় ২২আগষ্ট গ্রেফতার করে চার জনকে জেলে রাখা হয়। ১৯৭৪সালে তাজ উদ্দিন আহমদকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভা এবং বঙ্গবন্ধুর নিকট থেকে সরানোর চেষ্টাও করেছিল খন্দকার মুশতাক।

জেল খানায় চার নেতাকে কি ভাবে হত্যা করা হয়ছিল, সেই তথ্য ওঠে আসে জেল হত্যা মামলার চার্জশীটে (১৬ অক্টোবর ১৯৯৮দৈনিক জনকণ্ঠ)। তাতে বলা হয় ১৯৭৫সালের ৩নভেম্বর ভোর ৪টা-৫টা ৩০মিনিটের মধ্যে জেল খানায় হত্যা কান্ডটি ঘটে। রাত পৌনে ২টার সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সেনা বাহিনীর চার সদস্য আসেন এবং রিসালদার মোসলে উদ্দিন জীপ থেকে নেমে কারাগারের জেলারকে জানান, ফারুক রশিদ তাদের পাঠয়েছেন এবং জেলে থাকা তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এএইচ এম কামারুজামানকে নিয়ে যেতে হবে। তখন ডিআইজি প্রিজন কাজী আব্দুল আউয়াল অপারগতা প্রকাশ করলে রিসালদার মোসলে উদ্দিন বঙ্গভবনে ফোন করলে কর্ণেল রশিদ ফোন রিসিভ করে এবং খন্দকার মুশতাককে দেয়। মুশতাক ডিআইজি প্রিজনকে কর্নেল রশিদের কথামত কাজ করার নিদের্শ দেয়। এই নির্দেশ পেয়ে কারাগারের ভেতর ঢুকে তাজউদ্দিন ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের ১নং সেলে মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়। ৩জন গুলিতে মারা গেলেও তাজউদ্দিন আহমদের পেঠে ও হাঁটুতে গুলি লাগায় প্রচুর রক্তপাত হচ্ছিল এবং তিনি দীর্ঘক্ষণ বেঁচে ছটফট করছিলেন। একথা একজন কারাবন্দি ঘাতকদের জানালে ঘাতকরা ফিরে বেয়নেট খুচিয়ে খুচিয়ে চার জনের মৃতু নিশ্চিত করে। সকাল ১০টায় ম্যাজিষ্ট্রেট আজমল হোসেন চৌধুরী ও মিজানুর রহমান চৌধুরী, সিভিল সার্জন ডাঃ ফয়েজ উদ্দিন মিয়া, কারা ডাক্তার রফিক উদ্দিন, ডাঃ পূদ্ধার, ডাঃ মনোহর উল্লাহ চার নেতার মরদেহের ময়না তদন্ত ও সুরহাল রিপোর্ট তৈরী করেন। গুলি বর্ষন ও বেয়নেট দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছিল বলে চার্জশীটে (অভিযোগপত্রে) উল্লেখ করা হয়।
ডাকসুর সাবেক ভিপি তোফায়েল আহমদ তাঁর স্মৃতিচারণ মূলক একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছেন, যে দিন কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়, সে দিন তিনি ও দি পিপলস পত্রিকার এডিটর আবিদুর রহমান ময়মনসিংহে কারাগারে বন্দী ছিলেন এবং জেল সুপার নির্মল রায় সর্বপ্রথম তাদের জাতীয় চার নেতার হত্যার খবর জানান। ২২আগস্ট আমাকে জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজজাকসহ আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার করা হয় এবং হত্যার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে অজ্ঞাত কারণে হত্যা না করে পুলিশকন্ট্রোল রোমে নিয়ে ৬দিন আটক রেখে নির্যাতন করা হয়।

হত্যা কান্ডের পর দিন ০৪/১১/১৯৭৫ইং তারিখে তৎকালীন ডিআইজি প্রিজন কাজী আব্দুল আউওয়াল হত্যাকান্ডের ঘটনায় লালবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন এবং ০৫/১১/১৯৭৫ইং তারিখে আইজি প্রিজন নূরুজজামান হাওলাদার হত্যাকান্ডের একটি প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র সচিবের নিকট জমা দেন। দীর্ঘ ২১বছর পর (১৯৭৫-১৯৯৬) বঙ্গবন্ধু এ জাতীয় চার নেতার ইতিহাস ধূয়ে মুছে ফেলার প্রাণপন চেষ্টা করা হয়। বিচারকার্য ও নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৯৬সালে আওয়ামীলীগ বিজয়ী হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বিচারের পথ সুগম করেন। ১৯৯৮সালের ১৫অক্টোবর ২০জনের বিরুদ্ধে সিআইডি জেল হত্যা মামলার চারশীট দাখিল করলে ২০০৪সালের ২০অক্টোবর দায়রা জজ মতিউর রহমান দ-বিধির ৩০২/৩৪ ধারায় ৩আসামীকে মৃত্যুদন্ড, ৩০২/১০৯ধারায় ১২জনকে যাবৎজীবন এবং ৫জনকে খালাস প্রদান করেন। মৃত্যু দন্ডপ্রাপ্ত তিন আসামী রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধা। যাবৎজজীবন সাজাপ্রাপ্তরা খন্দকার আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী, আব্দুল মাজেদ, শরিফুল হোসেন, কিছমত হোসেন, নাজমুল হোসেন আনসার, সৈয়দ ফারুক রহমান, সাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন। খালাস প্রাপ্তরা হলেন, কেএমও বায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মনজুর, তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও মেজর অব: খায়রুজ্জামান। ২০০৮সালের ২৮আগস্ট হাইকোর্ট রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের মৃত্যু দন্ডবহাল রেখে, দফাদার মারফর আলী শাহ ও দফাদার আব্দুল হাসেন মৃধাকে খালাস প্রদান করে এবং যাবজজীবন সাজাপ্রাপ্ত কর্ণেল ফারুক রহমান, লে: কর্ণেল অবঃ শাহারিয়ার রশিদ খান, মেজর অব: বজলুলহুদা মহিউদ্দিনকে খালাস দেয়ায় পুরো দেশ বিষ্মিত ও স্থম্ভবিত হয়েছিল।

২০০৮সালের ২৯ডিসেম্বর আওয়ামীলীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষ মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করলে ২০১৩সালের ৩০এপ্রিল সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ হাই কোর্টের রায় বাতিল করে নি¤œ আদালতের রায় বহাল রাখেন এবং ০১/১২/২০১৫ইং তারিখে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ২০২০সালের ২৭জানুযারী গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার মত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামি স্বগোষিত সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল অব: শাহরিয়ার রসিদ খান, মেজর অব: বজলুল হুদাও মহিউদ্দিনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ২০২০সালের ১২এপ্রিল জেল হত্যা মামলার পলাতক আসামী আব্দুল মাজেদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় ১৯৭১সালের ২৫শে মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন তার ঘোষনা দেয়ার পর তাঁকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলে বঙ্গবন্ধর আদর্শের অনুসারি জাতীয় এ চার নেতার নেতৃত্বেও পরিচালনায় দীর্ঘ ৯মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। আর স্বাধীনতা বিরুধী দেশী-বিদেশি ষড়যন্ত্র কারিরা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে, বাংলার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। বিদেশে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকারিদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করা এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত কুশলীদের মুখোশ উন্নোচন করতে ইতিহাস অপেক্ষা করছে।

লেখক কলামিষ্টা ও সমাজ বিশ্লেষক
এএইচএম ফিরোজ আলী


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *