গ্রামই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণ অর্থনীতির মূল উৎস। কৃষি প্রধান অর্থনীতির সম্পদ কৃষক সমাজ। দেশের মানুষের খাদ্যের যোগান দেন কৃষক। সাংস্কৃতির আদি উৎস গ্রাম। গ্রামকে বলা হয়, প্রাকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমি। গাছ-গাছালি বনের লতা-পাতা, বাশঁ-বেত, খাল-বিল, পুকুর-নদী, কাঁচা-পাকা রাস্তা ও ক্ষেত কৃষি নিয়ে গ্রামের মানুষের জীবন। গ্রামের কারণেই, আমরা ‘মাছে ভাতে বাঙালি,। এক সময় ছিল, গোয়াল ভরা গরু, গোয়ালা ভরা ধান। বিদেশী পর্যটকরা এ দেশের অপরূপ সৌন্দর্য ভোগ করতে ছুটে আসেন গ্রামে। গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, সামাজিক রীতি-নীতিসহ ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটিরই পরিবর্তন ঘটেছে গ্রামে।
স্বাধীনতার আগে ও পরে গ্রামের ৯০ ভাগ মানুষ ছিলেন অভাবী। ৮৫ জন ছিলেন কৃষক। এক সময় গ্রামেই ছিল সৎ, সহজ, সরল মানুষেরই বাস। সে সময় অভাব অনটন মানুষের পিছু ছাড়েনি। সারাদিন পরিশ্রম করে একবেলা খাওয়ার জোগাড় করা ছিল বড় কঠিন। যাদের বেশি কৃষি জমি ছিল, তাঁরা ছিলেন ধনী। দেশে প্রবাসীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। ৫০ দশকের দিকে সিলেটের কিছু লোক ইউরোপে চলে যান। সে সময় থেকে সিলেটের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল কিছুটা স্বচ্ছল। বৃটিশ-পাকিস্তান শাসনের পর মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা ছিল। কার্তিক-চৈত্র মাসে অধিকাংশ অঞ্চলে মঙ্গায় মানুষ খেয়ে না খেয়ে জীবন বাঁচাতেন। আয় রোজগারের একমাত্র ভরসা ছিল কৃষি কাজ। লাঙ্গল, জোয়াল, মই, খাইটা, গরু, মহিষ ছিল কৃষির একমাত্র উপকরণ। এখন কৃষিতে বিপ্লব ঘঠেছে। কৃষি যন্ত্রপাতির কারণে এক জমিতে তিন ফসল উৎপাদন হচ্ছে। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন। কিন্তু জমিতে অধিক সার ব্যবহারের কারনে জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট ও বায়ু দূষণ হচ্ছে। ফসলে কীটনাশক ব্যবহারে ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ অসংক্রমক রোগও বাড়ছে। মিঠাপানির মাছ বিলুপ্ত হলেও ফার্মের মাছের উৎপাদন বেড়েছে। পশুপাখি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। জমিতে ঘাস না থাকায় গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়াসহ গোবাদি পশু পালন কমে গেছে। তবে, হাঁস, মোরগ ও গরুর খামার রয়েছে গ্রামে গ্রামে। এতে অনেক লোক আর্থিকভাবে স্বাবলম্বি হচ্ছেন। হাঁস মোরগের ফার্মের বিষ্টা খোলা জায়গায় ফেলে বাতাঁস দুষিত করা হচ্ছে, পঁচা দুর্গন্ধে মানুষ চলাচল করতে পারেনা এবং গ্রামের পরিবেশও ধ্বংস করা হচ্ছে।
এক সময় গ্রামের মানুষের বাড়ী-ঘর ছিল বাঁশ-বেত, ছন ও মাটির তৈরী। কারও ঘরে চেয়ার টেবিল ছিল না। ঘরে ঘরে শীতলপাঠি ছিল। আত্মীয় স্বজন, খেষ-কুটুম আসলে কাঠের তৈরী খাটে বা টুলে বসতে দেয়া হত। স্বাধীনতার দুই দশক পরে ধীরে ধীরে টিনের তৈরী ঘর বাড়ী নির্মাণ শুরু হয়। এখন গ্রামে বড় বড় দালান দেখতে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এ দেশের প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা হয়। প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামুল্যে বই বিতরণ বিশ্বে বিরল। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। লেখাপড়ার জন্য শিক্ষার্থীরা শহরে যেতে অনাগ্রহি। কিন্তু আদর্শবান শিক্ষকের বড়ই অভাব। আগেকার দিনে একজন আদর্শ শিক্ষক অন্ধকারাচ্ছন এলাকাকে আলোকিত করেছেন। এখন এ ধরনের শিক্ষক নেই বললেই চলে। সকলের মধ্যে বড় লোক হওয়ার মনোভাবে অতিলোভে বাসা বেধেছে সমাজে। বঙ্গবন্ধু একজন আদর্শ শিক্ষকের কারণে তিনি দেশপ্রেমিক ও জাতির পিতা হতে পেরেছিলেন। এখন আর আগেরকার দিনের মত ভোরবেলা দল বেধে মসজিদ, মাদরাসা ও মক্তবে শিশুদের যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায় না। শিক্ষা নয়, অর্থলোভের কারণে গ্রামে ব্যাঙের ছাতার মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিশুদের ভোরবেলা নিয়ে যাওয়ার ইসলামী শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। এখন আদব-কায়দা, ভক্তি-শ্রদ্ধা শিষ্ঠাচার নেই বললেই চলে।
এক সময় গ্রামীণ মানুষের চিকিৎসা ছিল, তাবিজ, কবজ, পানি পড়া, ঝাড়-ফোঁক ও বনের লতাপাতা ইত্যাদি। সে সময় ডায়েরিয়া, কলেরা, অমাশয়, কালাজ্বর, যক্ষা, টাইপয়েড, পানি বসন্ত গুটি বসন্তসহ পানিবাহিত রোগে গ্রামে ব্যাপকহারে মানুষ মারা যেতেন। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুতে বিশ্বে বাংলাদেশ ছিল এক কলঙ্কময়ী দেশ। এসব অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ঔষধ রপ্তানি করছে। তবে, অসংক্রমক রোগ, ক্যান্সার, ডায়বেটিস, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপে প্রতিনিয়ত মানুষ হঠাৎ মারা যাচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে গরীবের চিকিৎসা অভাব। বে-সরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে গলাকাটা ব্যবসা চলছে। এতে নিঃস্ব হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন। দেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় এক সময়ের ভূতুড়ে বাংলাদেশ এখন দিবানিশি জাগ্রত। রাতেও হোটেল, রেস্তোরা, ছোট-বড় কল কারখানা কাজ হচ্ছে। গ্রামের চুরি চামারির হ্রাস পেয়েছে। গ্রামীণ চুরি ডাকাতির অভিযোগে থানায় এখন মামলা নেই বললেই চলে। আগেকার দিনে, রাতে কুপিবাতি ও হারিকেন জ্বালিয়ে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করতেন। অধিকাংশ পরিবারে কেরোসিনের অভাবে রাত জেগে লেখা পড়ার কোন সুযোগ ছিল না। সেসময় স্কুলের চেয়ার-টেবিল, ডেস্ক-বেঞ্চ ছিল বাঁশ বেতের তৈরী। বাঁশের খঞ্চি দিয়ে কলম বানিয়ে পানিতে রং ভিজিয়ে কালি তৈরী করে লেখালেখি করা হত। কোন কোন পরিবার একটি স্লেট কিনে দিতে পারতেন না সন্তানের লেখার জন্য। খালি পায়ে সবাই চলা ফেরা করতেন। কদাচ্ছিত কোন বাড়ীতে কাঠের তৈরী খড়ম ছিল। এখন শিক্ষার্থীরা সব ধরনের আধুনিক সুযোগ সুবিধা পেয়েও লেখা পড়ায় তেমন মনোযোগী হচ্ছে না। লেখা পড়ার পরিবর্তে রাস্তায় মোড়ে, দোকানের পার্শ্বে মোবাইল হাতে নিয়ে পর্ণগ্রাফি ছবি ও গেইমস খেলে চোখ নষ্ট করছে। গ্রামের শতভাগ মানুষ উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে এবং এখন বিশুদ্ধ নলকুপের পানি পান করছেন। শতভাগ স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে।
গ্রামের ঐতিহ্য যাত্রা, বাউল, জারী, সারি, ঘেটু গান হয় না। পানির উৎস শুকিয়া যাওয়ায় এখন বড় বড় জলছা ও গ্রামীণ শিন্নী করা যায় না। খেলাধূলার মাঠ না থাকায় শিশুরা ফার্মের মোরগের মতো স্বাস্থ্যবান হচ্ছে। এ ধরনের শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় অল্প বয়সেই নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এখন খেলাধূলা ও সংস্কৃতি মোবাইলে আবদ্ধ। বিয়ে শাদীর অনুষ্ঠান হতো বাড়ীতেই। পাড়া প্রতিবেশি মিলেমিশে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করতেন। এখন বিবাহের আয়োজন করেন কমিউনিটি সেন্টারে। এতেই গরীব আত্মীয় স্বজনরা ভাল কাপড় চোপড় না থাকায় ও উপহার সামগ্রী না দিতে পারায় অনেকেই বিয়ের খাওয়া-দাওয়া ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত হন। মোবাইলের নেতিবাচক কর্মকান্ডের কারনে অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা পালিয়ে গিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচেছ এবং অনেকেই অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
গ্রামীণ অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। ই-কর্মাস চালু হওয়ায় গ্রামের মানুষের কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। কৃষকরা উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারছেন। অথনৈতিক উন্নয়ন ঘটলেও নীতি নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটেছে। সামাজিক বিচার-আচার, গ্রামীণ শালিস বৈঠক এখন বিবেকহীন ঘুষ খোরদের হাতে। গরীবের টাকা না থাকায় ন্যায় বিচার হয় না। কিছু কিছু অঞ্চলে সর্বনাশা মাদকের ছোবলে যুব সমাজ বিপদগামী হচ্ছে। শহরের মত গ্রামেও কিশোর গ্যাং রয়েছে। সত্য বলার লোকজন এখন সমাজের আড়ালে পড়ে আছেন। গ্রামে দিন দিন শিক্ষিত বেকার যুবকের সংখ্যা বাড়ছে। অনেকে উপায়ান্তর না পেয়ে উচ্চশিক্ষার অজুহাতে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বয়স্ক, বিধবাা, পঙ্গু, প্রতিবদ্ধি, মাতৃত্বকালীন, হিজড়া-জেলে ভাতা, ভিজিএফ, ভিজিডি সহ সরকার বরাদ্ধকৃত সকল বরাদ্ধে অধিকাংশ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বাররা ভাগ বসিয়ে থাকেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ছিন্নমূল ভূমিহীন মানুষের জন্য গুচ্ছগ্রাম বা আশ্রয়ন প্রকল্প নির্মানে যেমন দুর্নীতি হচ্ছে, তেমনি টাকার বদলে গরিবকে বঞ্চিত করে অনেক স্থানে অন্যকে আশ্রয় দেয়া হচ্ছে।
এ দেশের গ্রামই হচ্ছে, সুন্দর ও উন্নয়ন অগ্রতির প্রতীক। কথায় আছে, গ্রাম সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ এবং শহর সৃষ্টি করেছে মানুষ। এখনও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রাম ও শহরের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মতে, গ্রামের উন্নয়নে বেশি বাজেট বরাদ্ধ দিতে হবে। শহরে ময়লা-আবর্জনা ও ধুলাবালির কারনে অক্সিজেন সংকটে হাঁপানি ও শ্বাস কষ্টের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এখন মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন বেশি। গ্রামকে বাঁচাতে হলে সরকারি সকল খাস ভূমি, বনাঞ্চল, জলাশয়, খাল-বিল, নদী উদ্ধার ও খনন করে সীমানা চিহ্নিত করতে হবে। বিদেশী গাছ নয়, দেশীয় গাছ রোপন করে এ দেশের গ্রামগুলোকে সবুজায়ন করতে হবে। কৃষক ও কুঠির শিল্পে নিয়োজিতদের সহজশর্তে ঋণ সহ সকল সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে। কৃষি জমি রক্ষায় সুনির্দিষ্ট বিধিমালা তৈরী করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্বপ্রদান জরুরি। এ দেশের মাটি, পানি ও কৃষক জাতীয় অর্থনীতির জনক। গ্রামের উন্নতি মানেই দেশের উন্নতি। গ্রামই আমাদের জাতীয় অর্থনীতির মেরুদন্ড।