পাকিস্তানি গণহত্যার দায় এড়াতে পারে না

Uncategorized
শেয়ার করুন

১৯৭১সালের ২৫মার্চ ছিল বৃহস্পতিবার। সেই দিন রাতে বাংলার মাটিতে ঘটেছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক বর্বরতম মানব হত্যাযজ্ঞ। বিভীষিকাময় এ রাতে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে হিংস্র জানুয়ারের মত নিরীহ বাঙালির উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল। নতুন প্রজন্মকে সেই কালো রাতের ভয়াবহতা বুঝাতে ও স্মরণীয় করে রাখতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় ‘ব্লাকআউট’ কর্মসুচী ঘোষনা করেছে। ২৫শে মার্চ রাতে ১মিনিট সমগ্র দেশে অন্ধকারে রেখে ‘ব্লাকআউট’ মধ্য দিয়ে দেশবাসিকে সেই ভয়াল রাতের কথা স্মরণ করানো হবে।

২০১৫সালের ডিসেম্বরে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গণহত্যার সংখ্যা নিয়ে তাঁর প্রশ্ন আছে, এমন বক্তব্যের পর দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই প্রচারিত জনৈক জুনায়েদ আহমদ রচিত ‘ক্রিয়েশন অফ বাংলাদেশ মিথ্স এক্সক্লোডেড নামক বই প্রকাশ করেন। যে বইতে মুক্তিযোদ্ধাদের এই বলে দোষারোপ করা হয়েছে যে, ২৫মার্চ গণহতার জন্য মুক্তিযোদ্ধারাই দায়ি। তারাই নিরিহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছেন। বইটিতে গণহত্যার ছবিকে বাঙালির হাতে বিহারি হত্যার ক্যাপশন লিখে প্রকাশ করা হয়েছিল। এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে এ বছর ১৫ফেব্রæয়ারি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার ইন্সটিটিউটে ঘাতক দালাল নিমূল কমিটির এক সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন ডাকসুর সাবেক ভিপি তোফায়েল আহমদ। সভায় ঘাতক দালাল নিমূল মিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ও অধ্যাপক মুনতাসির মামুন ২৫মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষনার দাবি করলে এদিন তোয়ায়েল আহমদ মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে পয়েন্ট অব অডারে গণহত্যার প্রস্তাব পেশ করলে ১১মার্চ আলোচনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১১মার্চ ৫৬জন সংসদ সদস্য আলোচনা করে গণহত্যা দিবস পালনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। ২০মার্চ মন্ত্রী পরিষদে এ প্রস্তাব অনুমোদন হলে ২১মার্চ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় গণহত্যা দিবসের প্রজ্ঞাপন জারি করে।

১৯৭১সালের ফেব্রæয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ভূট্টোর লার্কানাস্থ বাগান বাড়িতে হরিণ শিকারের অজুহাতে সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে মিলিত হয়ে গণহত্যার সুনিদিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং ১২ ১২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিপুল পরিমান সমরা¯্র এবং সেনাবাহিনীর প্রথম চালান আসে পূর্ব বাংলায়। ভারতীয় বিমান হাইজ্যাকের কারনে ভারতের উপর দিয়ে পাকিস্তানের বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় শ্রীলংকা হয়ে চালান আসে। ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী, ভুট্টো, কসাই টিক্কা খান, জেরারেল পীরজাদা, জেনারেল ইফতেখার জানজুয়ার, রাও ফরমান আলী ও খাদিম রাজা নামে রক্ত পিপাসু ঘাতক ছিল গণহত্যার ভুমিকায়। পাকিস্তান বর্বর বাহিনীর সঙ্গে সামিল হয়েছিল ধর্মের নামে কিছু বাঙালি-অবাঙালি রাজাকার আলবদর আলশামস এবং শান্তি কমিটির সদস্যরাও।

২৫ শে মার্চ রাতে পাক বাহিনীর ট্রাংক, কামানের গোলা, মর্টারসেল আর মেশিন গানের গর্জনে রাত ১২টায় ভয়াবহ গণহত্যা শুরু হয়। রাজারবাগ, পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো ঢাকা শহর প্রকস্পিত হয়ে উঠে। রাতে আগুনের লেলিহান শিখায় লাল হয়ে গিয়েছিল ঢাকা রাজধানি। বঙ্গবন্ধুকে ৩২নম্বর থেকে গ্রেফতারের পর ওয়ারলেসে বলা হয়েছিল, ‘বড় মাছটিকে’ ধরা হয়েছে। গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছিলেন। জগন্নাথ হলে বর্বরোচিত হামলা করে কয়েক শত হিন্দু ছাত্রকে হত্যা করা হয়। নিহতদের সাথে জীবিতদেরও গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেয়া হয়। তারপর ট্রাংক দিয়ে মাটি সমান করে দেয়া হয়েছিল। সলিমুল্লাহ হলে ১১জন ছাত্রকে হত্যা, রোকিয়া হলে আগুন দেয়ার পর ছাত্রীরা দৌড়ে বের হলে মেশিনগান দিয়ে তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়। ৬জন ছাত্রীকে ধর্ষনের পর হত্যা করে মৃতদেহ সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রেখে হায়েনার দল তাদের প্রভুকে খুশি করে এবং বাঙালির হৃদয়ে অনন্তকাল আগুন জ্বালিয়ে যায়। ইকবাল হলে ২০০ছাত্রকে হত্যার ২দিন পর্যন্ত পুড়া ঘরগুলোর দরজা জানালায় মৃত দেহকে ঝুলিয়ে রাখে। এভাবে ২৬৬দিনে ৩০লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা য়ায়, যুদ্ধে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৬হাজার থেকে ১১হাজার পর্যন্ত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ২৫শে মার্চ রাতে শুধু ঢাকাতেই ২লক্ষাধিক লোককে হত্যা করা হয়েছে। চুকন নগরে একদিনে ৮থেকে ১০হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ১৯৩৯-১৯৪৫পর্যন্ত সময়ে ৬লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষিতা এবং উদ্বাস্তুর সংখ্যা ধরলে, জেনেভা কনভেনশন সজ্ঞার মতে, বাংলাদেশের গণহত্যার সংখ্যা ১কোটি ৩৫লাখ হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট গবেষক মুনতাছির মামুনের মতে, ৫লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছেন। এই দাবির সমর্থনে অস্টেলিয়ার ডাক্তার জেফর্রি ডেভিসসহ অন্যান্য গবেষকদের তথ্যে পাওয়া য়ায়। টিক্কা খান নিজেই বলেছিলেন অপারেশন সার্চলাইটকালে যে গণহত্যা হয়েছে তা চেঙ্গিস খানের হত্যাকান্ডকেও হার মানিয়েছে। পাকিস্তানের জেনারেল কামাল উদ্দিন তার বই ঞৎধমবফু ঊৎৎড়ৎ এ বিভিন্ন জায়গায় লিখেছেন বাংলাদেশে যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছে, তার ফলে শকুনদের খাদ্যের সন্ধানে অন্যত্র যেতে হয়নি। ইয়াহিয়া বলেছিলেন, পাকিস্তান রক্ষার জন্য কয়েক হাজার লাশ ফেলা কোন ব্যাপার হবেনা। মুক্তিযুদ্ধের পর সোভিয়েত সংবাদ সংস্থা ‘তাস’ বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় তদন্ত করে মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০লাখ বলে রিপোর্ট করেছে। স্যামোয়েল টটেন সম্পাদিত ‘সেনঞ্চুরি অব জেনোসাইড গ্রন্থে গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ৩০লাখ বলা হয়েছে। ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিংক ২৫মার্চ গণহত্যায় তিনি ঢাকায় যে চিত্র দেখেছেন, এবং পরে ৯মাস যা অব্যাহত ছিল তার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০লাখ বা তার বেশি হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। মার্কিন সিনেটর এ্যাডলাই স্টিভেনশন কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বৈধ্যভুমি দেখে বলেছিলেন, পাক বাহিনীর নৃশংসতা ছিল ভয়াবহ এবং মানবজাতির ইতিহাসে কোন নজির নেই। বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দক্ষিণ এশিয়া প্রধান মি: স্যান্ডারলেন্ড এর মতে ঢাকাতে নিযুক্ত ব্রিটিশ উপরাষ্ট্র দূত ২৬মার্চ ঢাকার রাস্তায় বের হলে, লাশের ঢলে রাস্তায় এগোতে পারেননি বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানের পরাজয় নির্ণয় করতে ১৯৭২সালে হামুদুর রহমান কমিশন ঘঠন করে পাকিস্তান সরকার। কমিশনের রিপোর্ট ২৮বছর গোপন রাখার পর ২০০০সালে গণমাধ্যমে তা প্রকাশিত হলে দেখা য়ায়, কমিশনের নিকট স্বাক্ষ্য দিতে গিয়ে পাকিস্তানের সিনিয়র সেনা কর্মকর্তারা প্রায় সকলেই বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের কথা স্বীকার করেছেন। আমেরিকার সেন্টলুইস পুষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে লিখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোলান্ডে নাৎসিদের গণহত্যার পর বাংলাদেশের গণহত্যা সবচেয়ে নৃশংস। বাংলাদেশ সরকারের হিসাবানুযায়ী প্রথম ৪মাসে, ২লাখ থেকে ৭লাখ বাঙালি নিহত হয়েছেন এবং ৬৫লাখ নিরিহ বাঙালি শরনার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। ২০০২সালে যুক্তরাষ্ট্রের জজ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ তাদের অবমুক্তকৃত দলিলে বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে ঝবষবপঃরাব এবহড়পরফব হিসেবে চিহ্নত করা হয়েছে। বিশ্বের বিবেকবান নাগরিক ও খ্যাতনামা ইতিহাসবিদদের ভাষায়, পাকিস্তান দেশটি ইতিহাসের ঘাতক বলে পরিচিতি লাভ করেছে।
ইংরেজি জেনোসাইড শব্দটির বাংলা অর্থ হচ্ছে গণহত্যা। ১৯৪৯সালের জেনেভা কনভেনশনে জাতিসংঘের জেনোসাইডের সংজ্ঞা মতে, ২৫শে মার্চ থেকে ১৬ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মাটিতে যে হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল, তা সব অর্থেই হত্যা বা জেনোসাইড। এটা ছিল ২০শতাব্দির অন্যতম জঘন্যতম নৃশংস গণহত্যা। এ গণহত্যার স্বরূপ বা চিত্র ছিল ভয়ঙ্কর। পাকিস্তানের সিভিল সমাজ বাংলাদেশের গণহত্যার ও নারী নির্যাতনের জন্য পাকিস্তানকে, বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি চেয়ে আসছেন বছরের পর বছর। পাকিস্তানিরা ১৯৪৭থেকে ১৯৭১সাল পর্যন্ত প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে তারা, হয় বিকৃত করেছে, না হয় মিথ্যা দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। ১৯৭২সালের ফেব্রæয়ারিতে জেনারেল নিয়াজিসহ ১৯৫জন সেনা অফিসারকে বিচার করার ঘোষনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৪সালে ত্রি-পাক্ষিক চুক্তির পর ৯৩হাজার পাকিন্তানি যুদ্ধবন্দিসহ ১৯৫জন সেনা যুদ্ধাপরাধিরা পাকিস্তানে ফিরে যায়। মূলত যুদ্ধের কারনে ৪লাখ বাঙালি পাকিস্তানে আটকা পড়ে থাকায় এবং এই সুযোগে জুলফিকার আলী ভুট্টো তাদের বিচারের জন্য পান্টা ঘোষনা দেন এবং ২শ জন বাঙালিকে বিচারের লক্ষ্যে কারাগারে আটকও করেন। ২০০২সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফ ৭১সালের যুদ্ধকে ভাড়াবাড়ি বলে দু:খ প্রকাশ করলেও কেউ তারা ক্ষমা চাননি। ২০১৫সালে যৃদ্ধাপরাধিদের বিচার শুরু হলে পাকিস্তানের মায়াকান্না শুরু হয়ে য়ায়। এসময নয়াজ শরীফ ও তার সরকার আগের অবস্থান থেকে ফিরে এসে গণহত্যার দায় অস্বিকার করেন। এসময় বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া পাকিস্তানের সাথে সুর মিলিয়ে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিতর্কিত হয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের ৫১বছর পেরিয়ে গেলেও ২৫মার্চের কালো রাতের ভয়াবহতা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের তেমন কোন ধারনা নেই। এদেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল এখনও মুক্তিযুদ্ধকে মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। তাই নতুর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে সোনার বাংলা গঠনে নিজেকে আত্মনিয়োগ করবে এটাই এখন সময়ের দাবি।

লেখক কলামিষ্ট, রাজনৈতিক ও সমাজ বিশ্লেষক
এ এইচ এম ফিরোজ আলী
০১৭১১ ৪৭৩১৫৫


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *