জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ড. মুহম্মদ ইউনূস জাতীয় সংসদ নির্বাচন কখন হবে সে সিদ্ধান্ত নেবেন রাজনীতিকরা :: বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময়, মুক্ত, উদার, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ
অনলাইন ডেস্ক :: নতুন বাংলাদেশ গড়তে দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা আন্দোলেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আমরা সেই স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। ফ্যাসিস্ট সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে গণতন্ত্রহীনতায় দেশের যে পরিস্থিতি হয়েছিল তা থেকে উত্তরণে চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আমরা প্রস্তুত। রাতারাতি এ অবস্থা থেকে দেশের উত্তরণ কঠিন। দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে হয়েছে। বর্তমান সরকারের দুই সপ্তাহ শেষে জনগণের যে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেছে তা অনুপ্রেরণামূলক। কথা দিচ্ছি দেশ আর পুলিশী রাষ্ট্র হবে না। আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। ১৫ বছরের আপনাদের বঞ্চনা আমরা জানি। তবে জিম্মি করে দাবি আদায় না করার অনুরোধ করছি। আমাদের কাজ করতে দেন। ছাত্র জনতার অভ্যূত্থানে ৫ আগন্ট পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালনোর পর ৮ আগস্ট শপথ নেয় নতুন সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার ১৭ দিনের মাথায় দ্বিতীয়বারের মত জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রধান উপদেষ্টার এ ভাষণ রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে সবকিছু দলীয়করণ করা, দুর্নীতি লুটপাট, ব্যবসা ও ব্যাংকিং সেক্টর ধ্বংস করা, দেশকে পুলিশ রাষ্ট্র বানানো, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রবাসীদের অবদান, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করা, কৃষকদের বঞ্ছিত করাসহ প্রতিটি সেক্টর নিয়ে কথা বলেছেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন কখন করা হবে সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্তের ব্যাপার জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা হবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনি ব্যবস্থা, আইন-শৃংখলা খাত এবং তথ্য প্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর লক্ষ্য হবে দুর্নীতি, লুটপাট ও গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি জবাবদিহিতামূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে উপদেষ্টারা তাদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করবেন। কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও নিয়মিত এবং বাধ্যতামূলক করা হবে। আমাদের সব উপদেষ্টা পর্যায়ক্রমে এটি সব সরকারি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে প্রতিশ্রুত ন্যায়পাল নিয়োগে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হবে।
জুলাই-আগস্ট মাসে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত সবার রুহের মাগিফরাত কামনা করে ড. মুহম্মদ ইউনূস বলেন, তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার শপথ নিয়ে আপনাদের কাছে কিছু কথা বলতে চাই। স্মরণাতীত কালের ভয়াবহ বন্যায় যারা মৃত্যুবরণ করেছন, যারা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বা যারা সর্বস্ব হারিয়েছেন, যারা দুঃসহ জীবনযাপন করেছেন তাদের স্মরণে রেখে কথা বলছি। বন্যাদুর্গতদের জীবন দ্রুত স্বাভাবিক করার জন্য যাবতীয় উদ্যোগ সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়ার আয়োজন করেছি। ভবিষ্যতে সব ধরনের বন্যা প্রতিরোধে আমাদের অভ্যন্তরীণ এবং প্রতিবেশীদর সঙ্গে যাতে যৌথভাবে নেওয়া যায়, সে আলোচনা শুরু করছি। তিনি বলেন, বিপ্লবী ছাত্র-জনতা জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমাকে এক গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তারা নতুন এক বাংলাদেশ গড়তে চায়। নতুন প্রজন্মের এই গভীর আকাঙ্কাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার সংগ্রামে আমি একজন সহযোদ্ধা হিসেবে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছি। দেশের সব বয়সের, সব পেশার, সব মতের, সব ধর্মের সবাইকে বিনা দ্বিধায় এই সংগ্রামে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
প্রধান উপদেস্টা বলেন, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে লাখো মা-বোনের আত্মদানের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছিলাম, তা ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচারের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। আপনারা দেখেছেন আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তারা কীভাবে শেষ করেছে। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে দুর্নীতি। এমন এক দেশে আমাদের দেশ রূপান্তরিত হয়েছে যেখানে স্বৈরাচারের পিওন দুর্নীতির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ করার মতো অকল্পনীয় কাজ করে গেছে নির্বিবাদে। শিক্ষা খাতকে পঙ্গু করে দিয়েছে। ব্যাংকিং ও শেয়ার বাজার খাতে লুটপাট, প্রকল্প ব্যয়ে বিশ্বরেকর্ড, অবাধ সম্পদ পাচার, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থাকে নিজ দলের পুতুলে রূপান্তর, বাক স্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার হরণ এসব হিমশৈলের অগ্রভাগমাত্র। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ফ্যাসিবাদী সরকার খর্ব করেছে জনগণে সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অধিকার। দুঃশাসন, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার নিপীড়ন, বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে জনসুরক্ষা বিপন্ন করেছে। জনগণকে নির্যাতন ও বঞ্চনা ও বৈষম্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের মানুষসহ কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকার বছরের পর বছর হরণ করেছে। মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে স্বৈরাচার তার নিজের, পরিবারের ও দলের কিছু মানুষের হাতে দেশের মালিকানা তুলে দিয়েছে। কিন্তু এই দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েই আমাদের গড়তে হবে স্বপ্নের বাংলাদেশ। বৈষম্যহীন, শোষনহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা আন্দোলেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। আপনাদের সবাইকে এই শুভ লগ্নে তাদের স্বপ্নপূরণে সব শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। তাদের স্বপ্ন আমাদের স্বপ্ন। জাতীয় জীবনে তরুণরা একটি মহাসুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। আমরা সবাইকে সুযোগ ব্যবহার করার কাজে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাচ্ছি।
ড. মুহম্মদ ইউনূস বলেন, গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকার-প্রধান দেশত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটিই। উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার। আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যহত করতে না পারে সেজন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের দুই সপ্তাহ শেষ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কর্মযাত্রার প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে আপনাদের কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছি। আমরা অনুধাবন করছি যে আমাদের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রত্যাশা পূরেণ আমরা বদ্ধপরিরকর। যদিও দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য পর্বতসম চ্যালেঞ্জ রেখে গিয়েছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আমরা প্রস্তুত। আমি সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করতে আপনাদের সামনে এসেছি। তিনি বলেন, শুধু আমি বলব আপনাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেপ্তারকৃতকে আদালেত হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা তা থেকে বের হতে হবে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের গৌরব ও সম্ভাবনা এসব কাজে ম্লান হয়ে যাবে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টাও এতে ব্যহত হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, রাতারারি এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কঠিন। নড়বড়ে এক কাঠামো, আমি বরং বলব জনস্বার্থের বিপরীমুখী এক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে হয়েছে। আমরা এখান থেকেই বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই যেন এ দেশে জনগণই সত্যিকার অর্থে সকল ক্ষমতার উৎস হয়। বিশ্ব দরবারে একটি মানবিক ও কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে সমাদৃত হয়। তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষার্থী ও জনতার আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে সফল আমাদেরে হতেই হবে। এর আর কোনো বিকল্প নেই।
দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনারা ইতোমধ্যে জেনেছেন জুলাই-আগস্ট মাসে গণ-অভ্যুত্থানে বলপ্রয়োগ ও হতাহতের যে দুঃসহ ঘটনা ঘটানো হয়েছে তার স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধানকে বাংলাদেশে এসে তদন্ত শুরু করতে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তদন্তের প্রক্রিয়া এ সপ্তাহেই শুরু হবে। তাদের প্রথম দল ইতোমধ্যে এসে গেছে। আমরা ইতোমধ্যে ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে যে শত শত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়েছিল তার অধিকাংশ প্রত্যাহার করেছি এবং আটক ছাত্র-জনতার মুক্তিলাভের ব্যবস্থা করেছি। পর্যায়ক্রমে মিথ্যা ও গায়েবি সব মামলার ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করে মানুষকে দুঃসহ ভোগান্তি থেকে মুক্ত করা হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গণ-অভ্যুত্থানে সকল শহীদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে।
ড. ইউনূস বলেন, আন্দোলনের সময় সকল আহত শিক্ষার্থী ও জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে। সে লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী দুইজন উপদেষ্টার সহায়তায় একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। এই কার্যক্রমের জন্য এবং গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে সরকার অতি দ্রুত ‘জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে এনেছি। আপনাদের সবার এবং বিদেশে অবস্থানরত ভাই-বোনদের অনুদান এই প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করেছি।
পতিত হাসিনার দুশাসনের চিত্র তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার ধ্বংস করেছে। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে দুর্নীতি। শিক্ষাখাতকে পঙ্গু করে দিয়েছে, ব্যাংকিং ও শেয়ার বাজার খাতে লুটপাট, প্রকল্প ব্যয়ে বিশ্বরেকর্ড, অবাধ সম্পদ পাচার, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থাকে নিজ দলের পুতুলে রূপান্তর, বাকস্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার হরণ এসবই হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ফ্যাসিবাদী সরকার খর্ব করেছে জনগণের সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অধিকার। দুঃশাসন, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার নিপীড়ন, বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যম জনসুরক্ষা বিপন্ন করেছে। জনগণকে নির্যাতন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের মানুষসহ কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকারকে বছরের পর বছর হরণ করেছে। মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে স্বৈরাচার তার নিজের, পরিবারের ও দলের কিছু মানুষের হাতে দেশের মালিকানা তুলে নিয়েছে। তিনি বলেন, গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকারপ্রধান দেশ ত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটিই। উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দায়িত্ব গ্রহণ করেই আমাদের আইনশৃংখলা অঙ্গনে অস্থির পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে। আপনাদের সহযোগিতা ও সমর্থনে দেশপ্রেমিক সব আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজে যোগ দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকার প্রশাসনে চরম দলীয়করণ করার ফলে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। আমরা ইতোমধ্যে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছি। তবে প্রশাসনকে গতিশীল রাখতে এবং একইসঙ্গে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সময় প্রয়োজন। প্রশাসনের সবল ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো যেন জনগণের আস্থা ফিরে পায় সেটি আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছি। এই খাতে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে শৃংখলা স্থাপন, ব্যবসা বাণিজ্যের সহায়ক পরিবেশ তৈরি এবং জনগণের জীবনযাপন সহজ করতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার আমরা উদ্যোগ সচল করেছি। ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন করা হবে। আর্থিক খাতে সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করা হবে যা দ্রুত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। শেয়ার বাজার, পরিবহন খাতসহ যেসব ক্ষেত্রে চরম বিশৃংখলা বিরাজ করছে তা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
ছাত্র জনতার আন্দোলনে প্রবাসীদের ভুমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে ড. ইউনূস বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশীরা যে ভুমিকা রেখেছেন জাতি তা স্মরণ রাখবে। এখন দেশ গড়তে আপনারা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠান। আপনাদের রেমিট্যান্স পাঠানোর সহজ করার ব্যবস্থা করা হবে। আপনাদের পাঠানো টাকায় আমরা দেশ গড়বো।
বিচার বিভাগকে দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মতো চরম ঘৃণ্য সব অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সকলের বিচার নিশ্চিত করা হবে। তালিকা প্রস্তুত করে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। দূর্নীতি ও সম্পদ পাচারের বিচার করা হবে। তিনি আরো বলেন, আইনশৃংখলার ক্ষেত্রে জনমুখী ও দলীয় প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিতামূলক কাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে পুলিশ কমিশন গঠন করা হবে। জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন, দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল সংস্থা ও জনগণের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে কমিশনের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। বাংলাদেশকে আর কোনও দিন কেউ যেন কোনও পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত না করতে পারে তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিতিশ্চতের কথা জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। ফ্যাসিবাদী সরকার গণমাধ্যমের ওপরও দলীয়করণ ও নির্যাতনের বোঝা চাপিয়েছিল। জনগণের তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তথ্যের প্রবাহে বিদ্যমান আইনি ও অন্যান্য বাধা অপসারণ করা হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করে এমন সব আইনের নিপীড়নমূলক ধারা সংশোধন করা হবে। ইতোমধ্যে এধরনের আইনগুলো চিহ্নিত করে এই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
বিদেশি সংবাদ কর্মীদের এদেশে আসার ওপর যে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল ইতোমধ্যে আমরা তা তুলে নিয়েছি। বিদেশি সাংবাদিকদের দ্রুত ভিসা দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম কর্মীরা নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা চালিয়ে যাবেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার করা হবে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠিত করে গেছে বিগত সরকার। আমরা তার পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের উদ্যোগ নেবো। এটা আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। আপনারা জানেন দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য সৃজনশীল, নিরাপদ ও ভীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের অঙ্গীকার। একই সাথে পাঠ্যক্রমকেও যুগোপযোগী করার কাজও দ্রুত শুরু করা হবে। সুত্র-দৈনিক ইনকিলাব