৩৪ ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতবিনিময় সভা
অনলাইন ডেস্ক :: গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আওয়াজ উঠেছে। ইতোমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে আপাতত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায় না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
তাদের সিদ্ধান্ত হলো, দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়ে আসলে সকল ছাত্রসংগঠন মিলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। ছাত্ররাজনীতি কী আকারে থাকবে সেটাও আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ সময়ে ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে আলাদা কোনো কর্মসূচি দেবে না কোনো ছাত্র সংগঠন।
সোমবার রাতে ‘প্রতিবিপ্লব ঠেকানো এবং গণঅভ্যুত্থানকে সুসংহত করার লক্ষ্যে’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে ছাত্রশিবিরসহ ৩৪টি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটি। এতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। সভায় তারা এসব সিদ্ধান্তে ঐক্যমত্যে পৌঁছেছেন। তবে এতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রসমাজের (এরশাদ) কোন প্রতিনিধিত্ব ছিল না।
জানতে চাইলে লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক মাহফুজ আব্দুল্লাহ সমকালকে বলেন, এখনও আন্দোলন মুখ্য; গণঅভ্যুত্থান এখনও সংহত হয়নি। প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা বাস্তব রূপ নিয়েছে ফলে ছাত্র সংগঠনের আলাদা ব্যানারে কর্মসূচি সমীচীন নয়। এজন্য আমরা (ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি) সিদ্ধান্তটি স্থগিত রেখেছি। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আমরা ছাত্রসংগঠনের ব্যানারে আরও কয়েকটি মতবিনিময় সভা করব। এটা একমাসের মধ্যে হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘সবার মতামতের ভিত্তিতে আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ একটি সিদ্ধান্তে আসব কে কে থাকবে সংগঠন আকারে; কী ধরনের রাজনীতি থাকবে; যদি কেউ সন্ত্রাস করে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে; যদি (ক্যাম্পাস ছাত্ররাজনীতি) না থাকে ছাত্ররা কীভাবে সংগঠিত হবে, কীভাবে রাজনীতি করবে।’
সভায় তারা বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এতে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন না করার বিষয়ে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
জাতীয় শোক দিবস নিয়ে বিরোধিতার ব্যাখ্যায় তাদের বক্তব্য হলো, যেহেতু ১৫ আগস্টকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতীকে রূপান্তর করা হয়েছে এবং এ দিবসকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পুনরায় সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
তাই জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা ও অভ্যুত্থান সংহত করার লক্ষ্যে ১৫ আগস্টকে রাষ্ট্রীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করাটা সমীচীন নয়। মতবিনিময় সভায় ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দ জুলাই-আগস্টকে বাংলাদেশের জনগণের শোক, সংহতি ও প্রতিরোধের মাস হিসেবে সাব্যস্ত করেন।
এই মতবিনিময় সভায় যে সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তা হলো- জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে সুসংহতকরণের লক্ষ্যে ন্যুনতম এক মাস বা পরিস্থিতি অনুযায়ী আরও বেশি সময় সব ছাত্রসংগঠনগুলো ক্যাম্পাসগুলোতে নিজেদের আলাদা করে কোনো কর্মসূচি দিবেন না।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যানার ব্যবহার করে কোনো ছাত্র ক্যাম্পাসে বা অন্য কোথাও কারো ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, হুমকি কিংবা ট্যাগ-ব্লেইম দিতে পারবে না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের কোনো কর্মী বা নেতা ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে পারবে না।
ফলত, ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চলবে কিনা সে বিষয়ে আলোচনা আন্দোলন অব্যাহত থাকা পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ছাত্রসংগঠনগুলোর ভূমিকা থাকবে না।
এ দিকে এই প্রথম ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে এসেছে। ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক নুরুল ইসলাম সাদ্দাম এবং ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক আহনাফ আব্দুল্লাহ সভায় উপস্থিত ছিলেন। এ দিকে সভায় শিবিরের অংশগ্রহণ থাকায় গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল এবং বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী সভা বয়কট করেছে বলে জানিয়েছে। গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি সায়েদুল হক নিশান বলেন, শিবির এবং ছাত্রসমাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদ কর্তৃক নিষিদ্ধ। তাই আমরা সভায় অংশ নেইনি।
তবে নুরুল ইসলাম সাদ্দাম সমকালকে বলেন, তাদের রাজনীতি করার গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। তিনি বলেন, ছাত্রশিবিরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করা হয়েছে—এটার কোনো ভিত্তি নেই। দমন নিপীড়নের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, ‘ছাত্রশিবিরকে ভালোবাসে এমন প্রচুর কর্মী আমাদের রয়েছে। সংবিধানবলে সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক। ১৯৭৭ সালে আমাদের সংগঠনের জন্ম হয়েছে। তাদেরকে পিছনে টেনে নিয়ে ট্যাগ দিয়ে নিষিদ্ধ করা এগুলো সুস্পষ্ট ইনটেনশন আছে, তারা একটা দলকে দমিত করে ফায়দা নিতে চায়।’
ছাত্রশিবিরের সভায় উপস্থিত থাকার বিষয়ে মাহফুজ আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বামপন্থীদের বিরোধিতা ছিল তাই আমরা শিবিরের কাউকে আসার জন্য বলিনি। কিন্তু তারা শুনে এসেছিল এবং টিএসসিতে অপেক্ষা করছিল। আমরা বলেছি, নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়া আপনাদের রাখতে পারি না। পরে আমরা বামপন্থীদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম তারা (শিবির) আসবে কিনা। তারা মতামত দিয়েছে আসার তাই এসেছে।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা আসতে পারে তবে ছাত্র সংগঠন হিসেবে আসবে কিনা এটা পরবর্তীতে ডিসিশন হবে। কিন্তু শিবির, ছাত্রসমাজ বা অন্যান্য সংগঠন বামপন্থী কিছু সংগঠন আওয়ামীলীগের সহযোগী ছিল তারা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারবে কিনা সেটাও সিদ্ধান্ত হবে।
তবে এখন আন্দোলন টিকিয়ে রাখা মুখ্য, এটা পর্যালোচনার ভিত্তিতে পরে বলব এটা হয়ত এক মাস পরে হতে পারে।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন- জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি গণেশ চন্দ্র সাহস, সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক আখতার হোসেন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের (গণসংহতি) সভাপতি মশিউর রহমান খান রিচার্ড, সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) সভাপতি রাগীব নাঈম, ঢাবি সভাপতি মেঘমল্লার বসু, সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) সভাপতি সালমান সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের (মুক্তি কাউন্সিল) সভাপতি মিতু সরকার, সহসভাপতি দীপা মল্লিকা, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের সংগঠক মাইনুদ্দীন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অঙ্কন চাকমা উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (জেএসএস), বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ (নুর), বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষ, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ, ছাত্র আন্দোলন (এনডিএম), বিপ্লবী ছাত্রসংহতি, রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র অধিকার পরিষদ (রেজা কিবরিয়া), বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র মজলিস, গণতান্ত্রিক ছাত্রদল (এলডিপি), নাগরিক ছাত্র ঐক্য, জাগপা ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ফোরাম (গণফোরাম-মন্টু), ভাসানী ছাত্র পরিষদ, জাতীয় ছাত্র সমাজ (কাজী জাফর), জাগপা ছাত্রলীগ (খন্দকার লুৎফর), ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রসমাজ, বাংলাদেশ ছাত্র মজলিস, বাংলাদেশ ছাত্রমিশন, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল ও জুম লিটারেচার সোসাইটির বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
তবে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ), বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট (বাসদ) ও গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের কোনো নেতা-কর্মী এ মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন না।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ, সাধারণ সম্পাদক রাহয়ান উদ্দিন ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা, সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দীন শুভ মঙ্গলবার বলেন, উক্ত সভায় ইসলামি ছাত্র শিবিরসহ অন্যান্য মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠনগুলোর উপস্থিতি সারাদেশের গণতন্ত্রকামী ছাত্র-জনতাকে হতবাক করেছে।
সুত্র-দৈনিক সমকাল