এ এইচ এম ফিরোজ আলী
আত্মমর্যাদাবোধের আরেক নাম স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের গর্ব এবং অহংকারের প্রতীক। স্বাধীনতার পর রিক্ত হস্তে যাত্রা শুরু করেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি। দেশ ছিল বিরান ভূমি। মানুষের পেটে ছিলনা ভাত, গায়ে (শরীরে) ছিলনা কাপড়। রাজকোষ ছিল প্রায় শূন্য। পাক হানাদার বাহিনী নিশ্চিত পরাজয় জেনে সব ধ্বংস করে দিয়েছিল। স্বাধীনতার আগে ও পরে অভাবী মানুষের চোখে ছিল শুধু কান্না, অপুষ্টিতে মানুষের দেহ ছিল কঙ্কাল। সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার ইমাজিং টাইগার। স্বাধীনতার পর বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। সে সময়ের বিশ্ব ব্যাংকের দুই অর্থনীতিবিদ ফ্যালান্ড ও পার্কিনসন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের যদি উন্নয়ন হয়, তাহলে যে কোন দেশই উন্নতি করতে পারবে’। যে পাকিস্তান, এ ভুখন্ড ২৩ বছর শাসন-শোষণ করেছে, তারা এখন অবাক নয়নে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা দেখছে। পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবিরা বাংলাদেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের অনেক সূচকে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করছে। উন্নয়নশীল দেশের গড় হারের তুলনায় সকল বাধা বিপত্তি মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে দারিদ্র বিমোচন সংগ্রামের বাংলাদেশের হিসাব কষছেন বিশ্বমোড়লরা। এদেশের পরিশ্রমি মানুষের হাড় ভাঙ্গা শ্রম, সঠিক নেতৃত্ব ও পরিকল্পনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে। এমডিজি সফলভাবে অর্জনের পর এসডিজি অর্জনের পথে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে জনসংখ্যার চাপ বেশি থাকার পরও উন্নয়নের বিপরীত মূখি বাধা ঠেকাতে পারেনি বাংলাদেশকে। ১৯৭৬ সালে স্বল্পোন্নত এবং ২০১৮ সালে মধ্যম আয়ের দেশে তালিকাভুক্ত হয় বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে নরওয়ের চেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের অর্জিত জ্ঞান-মেধা, অভিজ্ঞতা, কৌশল বিশ্বের কাছে এখন নতুন চমক। যে কারনে বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশ সর্ম্পকে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরী হয়েছে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর, এ ভুখন্ডের (পূর্ব পাকিস্তান অংশে) প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৮০ জন ছিলেন দরিদ্র। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে ছিল ৮৮শতাংশ। ১৯৯১ সালে ৫৫.৭ শতাংশ, ২০০৫ সালে ৪৩ শতাংশ, ২০০৯-১০ সালে ছিল ১৮শতাংশ এবং হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ১১.৩ শতাংশ। ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে বছর ওয়ারি ১.৮ শতাংশ হারে দরিদ্র কমছিল। ২০১৬ সালে দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ৪কোটি, তখন ভারতে ছিল ২৫কোটি। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল সময়ে দারিদ্রের হার কমেছে ১.২ শতাংশ হারে। বর্তমানে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ২ কোটি ৮০লাখ লোক হতদরিদ্র। তারা দিনে দু’বেলা আহার জোগাড় করতে কঠোর পরিশ্রম করছেন। বর্তমান সময়ে আশ্বিন-কার্তিক ও ফাল্গুন –চৈত্র মাসে দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা ও ক্ষুধার্থ মানুষ দেখা যায় না। গণমাধ্যমের তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে চরম দারিদ্রের হার ৩৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৩ শতাংশে আনা হলেও বাংলাদেশে ২কোটি লোক হতদরিদ্র বিবেচিত অবস্থায় বসবাস করছেন। ২০৩০ সালে হতদরিদ্রের হার ৩.০ নিচে আনা সম্ভব হলে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের তালিকায় নাম লেখাতে পারে। দারিদ্রের হার কমাতে প্রবৃদ্ধি ৮.৮ শতাংশ এবং কয়েক বছর তা অব্যাহত থাকতে হবে। তখন দারিদ্র কমে যাবে ১.৫ শতাংশ হারে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৌছে যাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে।
চীনের উহান নামক এক প্রদেশ থেকে উৎপত্তি হওয়া করোনা ভাইরাস বিশ্বে মানব সভ্যতার উপর চরম আঘাত হানে। বাংলাদেশের মানুষও এই আঘাতের বাইরে নয়। বিশ্ব ব্যাংক বলেছিল, চলতি বছর বিশ্বের অর্থনীতি ৫.২ শতাংশে সংকোচিত হতে পারে এবং মন্দা কাটিয়ে উঠতে ৫ বছর সময় লাগবে। এশিয়ার ৩ চতুর্থাংশ দেশের অর্থনীতি সংকোচিত হলেও চলতি বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬.৮ শতাংশ। করোনার কারনে দেশে শহরাঞ্চলে ৬৬ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ৪১ শতাংশ মানুষ চাকুরী হারিয়েছেন। এ মহামারী থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে ১ লাখ ১২ হাজার ৬৩৩কোটি টাকার (জিডিপির ৪৩ শতাংশ), ২১টি প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় ৭কোটি মানুষকে খাদ্য সহায়তা ও ২কোটি মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা দিয়ে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
১৯৭২-৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের মাত্র ৭৮৬কোটি টাকার প্রথম বাজেট পেশ করেছিলেন মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালিন অর্থমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদ। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট ঘোষনা করেছিলেন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মস্তফা কামাল ২০২০-২১ অর্থবছরের ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.২ শতাংশ। বর্তমান ২০২০-২১ অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৮.২ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশে রেমিট্যান্স আসে ১০কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার। দেশের ইতিহাসে এ সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। জুন মাসে আসে ১৮৩কোটি ৩০ লাখ ডলার এবং জুলাই মাসে ছিল ২৫৯কোটি ৯৫ লাখ মার্কিন ডলার। আগের অর্থ বছরে এই তিন মাসে রেমিট্যান্স ছিল ৪৫১কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিলে) রেমিট্যান্স আসে ১ হাজার ৩৩০কোটি ৩০লাখ (১৩.৩০বিলিয়ন) ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ছিল ১ হাজার ৫৯৮কোটি ১৭ লাখ (১৪.৯৮ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার, যা ছিল ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের চেয়ে ১৭.৩২ শতাংশ বেশি। ২০১৯ অর্থ বছরে রেমিট্যান্স আয় ছিল, ১ হাজার ৮২০কোটি ডলার। বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে ২শতাংশ প্রণোদনা ঘোষনা দেয়ায় এমন সাফল্য আসে। দেশের জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশ। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ ৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় ব্যাংকের হাতে প্রচুর তারল্য রয়েছে। বিদেশ থেকে ১৪ লাখেরও বেশি শ্রমিক ছাটাই হয়েছে। সৌদি ফেরত প্রবাসীদের ভিসার মেয়াদ ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বস্তি এসেছে। বাংলাদেশ বিমানের টিকেট নিয়ে চরম অনিয়ম, দূর্নীতি ও প্রবাসীদেরও হয়রানী করা হচ্ছে।
১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক টেলিভিশন ভাষণে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান আমাদের বড় শত্রæ। কিন্তু তার চেয়ে বড় শত্রæ দারিদ্র, ক্ষুধা, অভাব, রোগব্যাধি, অশিক্ষা, বেকারত্ব ও দূর্নীতি’। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর উল্টো পথে ঘুরে যায় বাংলাদেশ। বানের পানিতে ভেসে যায় স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়নে মুক্তিযোদ্ধা, বয়স্ক, বিধবা, দুঃস্থ, পঙ্গু, হিজড়া, বেদে, হরিজন, জেলেসহ ১৪৫টি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টুনী চালু করে প্রায় ২ কোটি মানুষকে সহায়তা দিচ্ছেন। ভিডিজি ভিজিএফ ১০টাকা মুল্যের চাল, ওএমএস চালু করে বাজার নিয়ন্ত্রন করা হচ্ছে। এসব কাজে ২২টি মন্ত্রনালয় যুক্ত হয়ে দারিদ্র নিরসনে কাজ করছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে, পুরুষ-মহিলা-শিশুদের মধ্যে বিরাজিত দারিদ্রকে হ্রাস করে অর্ধেকে নামিয়ে আনা। ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্রের হার ৩ শতাংশে কমিয়ে আনার কঠিন সংগ্রামে ব্যস্ত এখন বাংলাদেশ। দারিদ্র বিমোচনের সাফল্যের পথে বাংলাদেশের এমন খবর শুনে বাংলাদেশে ছুটে আসেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম, গণচীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তারা দেখে গেছেন অক্লান্ত পরিশ্রমি বাঙালির অপরিসীম কাজের শক্তি। ১৯৭১ সাল দেখলেও বুঝতে পারেননি বাঙালির ঐক্যের চেতনা।
এ যাবত কালের সরকারের বড় সাফল্য হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের উন্নতি। প্রতিদিন বিদেশ ও শহর থেকে গ্রামে ২ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয় মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে। মোবাইল ব্যবহার করছেন ১২কোটি এবং ইন্টারনেট দুনিয়ায় বিচরন করছেন ৭ কোটি মানুষ। গত বছর ৩৫০কোটি ডলার বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারত, সৌদি আরব, বাংলাদেশে বিনিয়োগে এখন আগ্রহী। দেশের উন্নয়নে শতবছরের ডেল্টা প্লান নামে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। গত ১দশকে নারীর কর্মসংস্থান ৬ থেকে ৩৬ শতাংশে উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ১০ লাখ মানুষ যুক্ত এবং আগামী বছর ৫ লাখ যুক্ত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। অবকাঠামোগত দৃশ্যমান উন্নতি হওয়ায় দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে স্বল্পমূল্যে সহজে এবং কমসময়ে পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে। এতে গরীব কৃষকরা পণ্যের নায্য মূল্য পাচ্ছেন। ৯৮ শতাংশ ঔষধ তৈরি করে ১৭২টি দেশে রপ্তানী করা হচ্ছে। করোনা টিকা আবিস্কার করছে বাংলাদেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের উন্নয়নের উৎকৃষ্ট উদহারণ। রেমিট্যান্স, পোষাক ও কৃষি খাতের অর্জন দারিদ্র বিমোচনে বড় ভূমিকা পালন করছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৪০ বিলিয়ান বা ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সমমূল্যের পণ্য রপ্তানী হয়েছে। গত এপ্রিল/ ২০২০ মাসে ৫২কোটি, মে মাসে ১৪৪কোটি, জুন মাসে ২৭১কোটি, জুলাই মাসে ৩৯১কোটি, আগষ্ট মাসে ২৯৭কোটি এবং সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে ৩০১কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানী আয় হয়েছে। পরনির্ভশীলতা কমেছে এবং মানুষের খাদ্যাভাসেরও পরিবর্তন হয়েছে।
১৭ অক্টোবর ১৯৮৭ সাল থেকে এ দিবসটিকে বিশ্ব দারিদ্র বিমোচন দিবস পালন করছে জাতিসংঘ। যেসব দেশ দারিদ্র বিমোচনে সাফল্য অর্জন করে, সেসব দেশ এ দিবসটি পালন করে থাকে। সাফল্যের যাত্রা পথে এ দিবসটি বাংলাদেশের জন্য একটি সু-সংবাদ। বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচনের অগ্রযাত্রার পেছনের সুদক্ষ এক কারিগরের ভূমিকায় আছেন, জাতির পিতার সুযোগ্য তণয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি একাই লড়ছেন এবং লড়বেন। দলবাজ, প্রতারক, দূর্নীতিবাজদের কারনে তার পরিশ্রমের সকল অর্জন ¤øান হচ্ছে। বাংলাদেশে বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঘূষ লেনদেন হয়, ৭০ হাজার কোটি টাকা যারা ঋন নেয় তারাই আবার ৩০/৪০ হাজার কোটি টাকার ঋন খেলাপী হয় এবং এসব টাকা বিদেশে পাচারও করা হয়। শক্ত হাতে এসব দমন করতে হবে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন বা দারিদ্র বিমোচনে পিছনের দিকে তাকানোর এখন আর কোন সুযোগ নেই। সামনের দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক, কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক