দারিদ্র বিমোচনে শতাব্দির শ্রেষ্ট কারিগর শেখ হাসিনা

Uncategorized
শেয়ার করুন

১৭ অক্টোবর বিশ^ দারিদ্র্র বিমোচন দিবস
এএইচএম ফিরোজ আলী::দারিদ্রতা মানব জীবনের এক পরম শত্রু ও অভিশপ্ত যন্ত্রনা। দারিদ্রতা ব্যক্তিজীবন বিকাশে এবং জাতীয় সমৃদ্ধির পথে প্রতিবদ্ধকতার সৃষ্টি করে। দারিদ্রের দৃশ্যমান চিত্র হচ্ছে, অপুষ্ঠি, ভগ্নস্বাস্থ্য, জীর্ণশীর্ণবাসস্থান, নিরক্ষতা ও বেকারত্ব। অন্যভাবে যারা দৈনিক ১ হাজার ৮০৫ কিলো ক্যালোরির কম খাবার খায়, তাঁরা চরম দরিদ্র এবং যারা ২ হাজার ১২২ কিলো ক্যালোরির কম খাবার খায়, তাঁরা দরিদ্র। কবি সুকান্তের পংক্তি, ‘অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো/দেখি এদেশে অন্ন নেই কারো’। প্রবাদ বাক্য আছে, ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট,‘পুড়া কপালি যেদিকে যায়, উপতা বাতাসে তারে পায়’।
১৭ অক্টোবর বিশ^ দারিদ্র বিমোচন দিবস। ১৯৮৭ সাল থেকে দারিদ্র বিমোচনে সাফল্য অর্জনকারী, দেশ দিনটি পালন করে। তাই ১৭অক্টোবর বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। দারিদ্র বিমোচনের সাফল্যে বিশে^ শুধু এ দেশটিকে স্বীকৃতি দেয়নি, বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল বলে অ্যাখা দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্দর্শী নেতৃত্ব, দক্ষতা এবং কৌশল বিশে^র নিকট এক নতুন সম্পদ। বাঙালি নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন, পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকা বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করেছে।
১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ^ব্যাংক এক রির্পোটে বলেছিল, ‘সবচেয়ে ভাল পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। এখানকার মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র, মাথাপিছুঁ আয় মাত্র ৫০-৭০ ডলার। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি কিলোমিটারে ১৪০০জন। আয়ুষ্কাল কম, জনসংখ্যার বড় অংশ অশিক্ষিত’। ১৯৭৬ সালে নরওয়ের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জাষ্ট ফালান্ড ও জেআর পার্কিসন দু’জনে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে, উন্নয়নের একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র। বাংলাদেশ যদি তাঁর উন্নয়ন সমস্যা সমাধান করতে পারে, তাহলে যেকোন দেশই উন্নতি করতে পারবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে, বাংলাদেশ ঠিকে থাকতে পারবে না। হেনরি কিসিঞ্জারও বাংলাদেশকে ‘‘বটম লেস বাস্কেট বা তলাবিহীন ঝুড়ি’’’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার আগেও পরে এ দেশের প্রায় ৮৫% লোক ছিলেন দরিদ্র। সব পরিবার ছিল, নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। একমাত্র কৃষি ও বিদেশী সাহায্যেরউপর নির্ভর ছিল বাংলাদেশ। বন্যা, খরা ফসলহানি হলে ঘরে ঘরে ছিল খাদ্যাভাব। অনাহারি মানুষের শরীর দেখতে ছিল, কঙ্কাল। ১৯৭১সালে বিশে^র দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশছিল বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে ৭ কোটির মধ্যে সোয়া ৫ কোটি ছিল দরিদ্র। রাস্তাঘাট নেই, কাঁচা ঘর বাড়ী ও বিদুৎবিহীন গ্রাম ছিল ভূতুড়ে অন্ধকার। ১৯৭৩-৭৪ গড় আয় ছিল ৪৬৪ টাকা, তখন দিনে একজন ২৬ গ্রাম মাছ, ৫ গ্রাম মাংস, ১.১৬গ্রাম ডিম খাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। ১৯৯৫ সাল সময় পর্যন্ত পুষ্ঠিহীনতার কারনে বছরে ৫ লাখ শিশু মারা যেত। আয়োডিনের অভাবে ২০ হাজার প্রতিবন্ধি শিশুর জন্ম এবং প্রায় ঘরে ঘরে মহিলারা গলগন্ড রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ভিটামিন ‘এ’র অভাবে বছরে ৩০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যেত। ৫ বছরের কম বয়সী শিশু ৯৩% অপুষ্ঠিতে ছিল। প্রতি ৩ শিশুর মধ্যে ২জন অপুষ্ঠিতে মারা যেত।
বাংলাদেশের দারিদ্রতার মুল কারণ হচ্ছে, বৃটিশের ২শত বছর এবং পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাষণ-শোষণ ও সম্পদ লুটপাট। পাকিস্তানের ২২ পরিবারের হাতে সম্পদ আটকে রেখে পূর্ব পাকিস্তানকে দারিদ্র করে রাখা হয়েছিল। ১৯৪৯-৫০সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধির হার ১.৭%, ১৯৬৪-৬৫সালে ছিল ৪.২%। এসময় পশ্চিম পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৫% ও ৬.২%। পূর্বপাকিস্তানে পাট সহ মোট ৭০% পন্য দ্রব্য উৎপাদন করলেও আয় পেয়েছে মাত্র ২৫%। ১৯৪৮সালে এদেশে কাপড়ের কল ছিল ১১টি, পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৯টি, ১৯৭১সালে আমাদের ছিল ২৬টি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের হয়েছিল ১৫০টি। পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হকের মতে, প্রথম পঞ্চম বার্ষিকী(১৯৭৩-৭৭) পরিকল্পনার পূর্বে ২১০ বিলিয়ন ডলার পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর হয়ে যেত। উন্নয়ন বাজেটের ৬২% পাকিস্তানে এবং মাত্র ১৭% এ ভুখন্ডে খরচ দেখানো হতো এবং ১৭% অব্যবহৃত থাকতো। ১৯৫০-৬০ (দশ বছরে) পূর্বপাকিস্তান সাহায্য এসেছিল ৯৩ কোটি। পশ্চিম পাকিস্তান গ্রহণ করেছিল ৪০৮ কোটি। এসময় পূর্বপাকিস্তান থেকে ২.৬ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করা হয়েছিল। ১৯৭১সালে আমাদের তুলনায় ৭০% বেশি সম্পদ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৪৫% বেশি সম্পদ রয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৫-১৬সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭% নিচে নামেনি। ২০২০-২১সালে মহামারী করোনা থাকা সত্বেও ৫.২৪% ছিল। অন্যদিকে গত ১৫ বছরে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ৬% বেশি হয়নি।
১৯৭১-২০২১ (৫০ বছরে) অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৭৩-৮০সালে গড়ে ৩.৮% হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। ২০১০-২০১৯ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার দাঁিড়য়ে ছিল ৬.৭%। স্বাধীনতার আগে মাথা পিছু আয় ছিল ১০০ ডলারের মতো। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে মাথাপিছু আয়২০৬৪ ডলার এবং ২০২১ সালে ছিল ২২২৭ মার্কিন ডলার। ৪০ বছরের আগে দেশে দরিদ্রের হার ছিল ৭০% এর বেশি। ১৯৯১সালে দারিদ্রের হার ছিল ৫৬.৭০%, ২০১৬সালে এসে দাঁড়ায় ২৪.২৩%। ২৫ বছরে দরিদ্র কমেছে ৩২.৪%। বিশেষ করে ২০০৯সাল থেকে ২০২১ এই ১২বছর সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্রুত দারিদ্রতা কমতে থাকে। দারিদ্রের হার ছিল ২৪.৩% এর নিচে। ২০১৯ সালে ২০.৫০% এ নেমে আসে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, স্বাধীনতার জন্মলগ্নে থেকে ৮২% দারিদ্রতা থেকে ৬০% এর বেশি কমেছে। বিশ^ব্যাংকের ঢাকার বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন দারিদ্র কমার কারন হিসেবে উল্লেখ্য করেছেন, জনসংখ্যা হ্রাস, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, শিল্প, পোষাক ও ঔষধ খাতে উল্লেখ্যযোগ্য উন্নতি হয়েছে। দেশে সড়ক যোগাযোড় ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় কৃষি পণ্য ৬/৭ঘন্টায় দেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে চলে যায়। এতে শতশত গরিব দিনমজুর লোক ফেরি করে তরিতরকারি শাক-সবজি ও বিভিন্ন ফলমূল বিক্রি করে আয় বৃদ্ধি করছেন।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে দারিদ্র বিমোচনে সর্বপ্রথম বিধবা, পঙ্গু, বয়স্ক, জেলে, বেদে, হিজড়া ভাতা, মাতৃত্বকালিন ও অস্বচ্ছ মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ বিভিন্ন ধরনের ভাতার প্রচলন করেন। আশ্রয়ন প্রকল্পের নামে ৩ ফেজে ৩১ লাখ ৯ হাজার ১৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন ৬৬হাজার ১৮৯টি পরিবারকে আধাপাকা ঘর, ৩৬টি উপজেলায় ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণ, আরও ৩৭১৫টি পরিবারসহ সব মিলিয়ে মুজিববর্ষের উপহার ৬৯,০৯৪টি গৃহহীন পরিবারকে ভূমিসহ ঘর নির্মাণ করে দেন। জাতিসংঘে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ১লাখ সরকারি গৃহে প্রায় ১০ লাখ লোক বসবাস করছেন। ২০২০সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২হাজার, ২০৩০সালের মধ্যে ৪০ হাজার এবং ২০৪০সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে দেশের প্রতিটি উপজেলায় ৯০% বিদ্যুৎতায়ন করা হয়েছে। যে কারনে কুঠির শিল্পসহ ছোট বড় শিল্প গড়ে উঠায় অর্থনীতির উন্নত সাধিত হয়েছে। ই-কমার্সের মাধ্যমে প্রতিদিন গ্রামে কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। হাস, মোরগ, কবুতর, পাখি, গরু, মহিষ, সাপ, কুমির, কচ্ছপ, মৎস্য খামার ইত্যাদি সহ ছোট ছোট শিল্প গড়ে দেশের অধিকাংশ লোক স্বাবলম্বি হচ্ছেন। চাকুরীতে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। ১ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি লোক বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণ করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন।
১৯৭২সালে সর্বপ্রথম জাতীয় সংসদে ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫ সালে দারিদ্রের হার ১৫.৫% এবং অতি দরিদ্রের হার ৭.৩% কমানোর জন্য ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার প্রাকল্পিত ব্যয় অনুমোদন করা হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জিত হলে দারিদ্রতা মুছে যাবে। আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এবং মৃদুভাষী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পৃথক অনুষ্ঠানে দেশের দারিদ্রতাকে যাদুঘরে পাঠানোর কথা বলেছেন।
স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছেন, তাঁর সুযোগ্য তনয়া শেখ হাসিনার হাত ধরেই ক্ষুধামুক্ত ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ বিশে^ মাথা উচুঁ করে দাঁড়াবে এবং শেখ হাসিনাই হবেন, দারিদ্র বিমোচনে এ শতাব্দির শ্রেষ্ট কারিগর।
লেখক: কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *