দারিদ্র বিমোচনে বাংলাদেশের বিশ্বরের্কড

Uncategorized
শেয়ার করুন

এএইচএম ফিরোজ আলী:: আজ ১৭ অক্টোবর বিশ্ব দারিদ্র বিমোচন দিবস। ১৯৮৭সালে থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালন করা হয়। যেসব দেশ দারিদ্র বিমোচনে সাফল্য অর্জন করে, সেই দেশগুলো এ দিন তাদের অতীত পর্যালোচনা করে ভবিষ্যত নির্ধারন করে থাকেন। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি চরম দরিদ্র ও অবহেলিত দেশছিল।

এক সময়ের নিন্দিত বাংলাদেশ এখন সমগ্র বিশ্বে নন্দিত ও প্রশংসিত। তলাবিহীন ঝুড়ি ও পরনির্ভশীল দেশ হিসেবে বদনামও কম ছিল না। পাকিস্তানের ২৩ বছর শোষণ ও শাসনে অভাবী মানুষের সংখ্যা ছিল বেশি। ছিল কাঁচা ঘর-বাড়ি ও রাস্তা-ঘাট। প্রাকৃতিক দূর্যোগ ছিল নিত্য সঙ্গী। কৃষি কাজ ব্যতীত আয়-রোজগারের অন্য কোন পথ ছিলনা গ্রামের মানুষের। মানুষের পেটে ছিল না ভাত, গায়ে-(শরীরে) ছিল না কাপড়। রাজকোষে ছিল মাত্র ১টাকা। অপুষ্ঠিতে রোগাক্রান্ত মানুষের দেহ ছিল মলিন। একটি রুটি পাওয়ার জন্য লঙ্গরখানায় মানুষের দীর্ঘ লাইন ছিল। নিজেও লাইনে দাড়িয়েছি রুটির জন্য। সব বদনাম মুছে বাংলাদেশ এখন বদলে গেছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে এখন উন্নয়নের ছোঁয়া। বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে বিশ্ব অনুসরণ করছে। এ দেশের পরিশ্রমি মানুষের হাড় ভাঙ্গা শ্রম, সঠিক নেতৃত্ব ও পরিকল্পনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে। এ যাবত কালের সরকারের বড় সাফল্য বিদ্যুখাতের উন্নতি। নারী উন্নয়ন, দেশে কৃষি, মৎস্য মাথা পিছু আয়সহ বিভিন্ন সূচকে উন্নতি করেছে বাংলাদেশ।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর, এ ভুখন্ড প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৮০ জন ছিলেন দরিদ্র। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে দরিদ্র ছিল ৮৮শতাংশ। ১৯৯১ সালে ৫৫.৭, ২০০৫ সালে ৪৩, ২০০৯-১০ সালে ছিল ১৮ এবং ২০১৫ সালে ছিল ১২.০৯ শতাংশ। হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ১১.৩ শতাংশ। ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে বছর ওয়ারি ১.৮ শতাংশ হারে দরিদ্র কমেছিল। ২০১৬ সালে দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি, তখন ভারতে ছিল ২৫কোটি। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল সময়ে দারিদ্রের হার কমেছে ১.২ শতাংশ হারে। বর্তমানে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ২ কোটি ৮০লাখ হতদরিদ্র। তারা দিনে দু’বেলা আহার জোগাড় করতে কঠোর পরিশ্রম করছেন। এখন দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা ও ক্ষুধার্থ মানুষ দেখা যায় না। গত ১৫ বছরে চরম দারিদ্রের হার ৩৪ শতাংশ থেকে কমে ১৩ শতাংশে এসে দাড়ায়। ২০৩০ সালে হতদরিদ্রের হার ৩.০ নিচে আনা সম্ভব হলে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের তালিকায় নাম লেখাতে পারে। দারিদ্রের হার কমাতে প্রবৃদ্ধি ৮.৮ শতাংশ এবং কয়েক বছর তা অব্যাহত থাকতে হবে। তখন দরিদ্র কমে যাবে ১.৫ শতাংশ হারে।
১৯৭২সালে দরিদ্র ছিল ৫ কোটি। ১৯৭৩সালে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার। দারিদ্রের হার ছিল ৮৮ শতাংশ, আমানত ছিল ৮শ কোটি। রেমিট্যান্স ছিল ০.৮০ কোটি টাকা। ১৯৭২সালে বিশ্ব ব্যাংক বলেছিল, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়নের সমস্যাটি এখন জটিল’। এখানকার মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলারের মধ্যে, যা গত ২০ বছরে বাড়েনি। জনাধিক্ষের এ দেশে বেকারত্বের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাষ্ঠ ফাল্যান্ড এবং মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেআর পার্কিসন, ‘দ্য টেষ্ট কেস ফর ডেভলাপমেন্ট’ নামে এক বইয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে, উন্নয়নের একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। বাংলাদেশ যদি তার উন্নয়ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে যেকোন দেশই উন্নয়ন করতে পারবে’। স্বাধীনতার পর বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও তা ঠিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিংঞ্জারের নেতৃত্বে গঠিত স্টেট ডিপাটমেন্টের একটি কমিটির এক প্রতিবেদনে বলেছিল, ‘বাংলাদেশ হবে এক আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ঝুড়ি, এই দেশে যতই খাদ্য সাহায্য দেওয়া হউক, তা শেষ পর্যন্ত সবাইকে বাঁচাতে পারবে না’। বিশ্ব বাংলাদেশকে নিয়ে এভাবেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিল! মার্কিন সাহায্য বন্ধ করে দেয়ায় ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।
বিশ্ব ব্যাংকের স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে ২০০৯সালে বাংলাদেশে শতকরা ৪১ভাগ মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে ছিল। ২০২০সালে সেটা নেমে শতকরা ২০ ভাগ হয়েছে। গত ১২ বছরে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ দারিদ্রের কষাঘাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। দারিদ্র বিমোচনের হার হিসেবে এটা বিশ্ব রের্কড। ২০৩০সালে দারিদ্রের হার ৫.৯৮ হারে পৌছে যাবে। ২০১৬সালে এসে দাড়াঁয় ২৪.০৮শতাংশ। দারিদ্র বিমোচনে অসামান্য অগ্রগতি সাধন করায় বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিং ইয়ান কিং ও গণচীনের প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং।
করোনাকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং জিডিপি ৭ শতাংশের উপরে ছিল। মাথাপিছু গড় আয় ২০৬৪ ডলার এবং ২০৪১সালে হবে ১২হাজার ৫শ ডলার। জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৯.৯ শতাশ। ২০৩০সালে প্রবৃদ্ধি ৮.৫ ভাগ অর্জন করার কথা। ২০১৮ সালের ৪ জুন করাচির ‘ডন’ পত্রিকায় আফসোস করে বলেছে যে, বাংলাদেশকে পাকিস্তান সব সময় তুচ্ছ তাচ্ছ্যিল করেছে, সেই বাংলাদেশের এখন অর্থনৈতিক অগ্রগতির শক্তিতে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে একটি পরামর্শ সভায় জানানো হয় যে, দেশের অর্থনীতির বিকাশে দশসালা একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যাতে সুইজারল্যান্ডের সমকক্ষ হতে পারে পাকিস্তান। ইমরান খান পাল্টা প্রস্তাব দেন, আপনারা পাকিস্তানের জন্য এমন একটি অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চয়ন করুন, যার বাস্তবায়ন আমরা দশ বছরে বাংলাদেশের সমকক্ষ হতে পারি। ‘দ্য’ ইকনমিষ্ট ২০১৭সালে বলেছিল, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৮ সালে হংকং এন্ড সাংহাই ব্যাকিং কর্পোরেশন তাদের গ্লোবাল রির্জাচে বাংলাদেশকে এশিয়াজ ইমাজিং টাইগার আখ্যায়িত করেছে।
মহামারি করোনার আঘাতে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি যখন ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত, তখন ২০২০-২১অর্থ বছরে রপ্তানি খাত থেকে ৩ হাজার ৮ শত ৭৫ কোটি ৮৩ লাখ (৩৮.৭৫ বিলিনয়) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫.১০ শতাংশ। শুধু পোষাক খ্যাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ১২ শতাংশ। যা রপ্তানি আয়ের ৮১.১৬ শতাংশ। এসময় পোষাক রপ্তানি হয় ৩হাজার ১শত ৪৫ কোটি ৬৭লাখ (৩১.৪৫বিলিয়ন) ডলার।
আওয়ামীলীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, দারিদ্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিবেন। সেই প্রতিশ্রুতি মতে, শেখ হাসিনা অসম্ভবকে সম্ভব করে প্রমাণ করেছেন তার হাতেই বাংলাদেশের উন্নয়নের চাবী। অভিরাম প্রচেষ্ঠার মাধ্যমে অনিশ্চয়তা ও উৎকন্ঠার মাঝে আলোর দিশারী হয়ে জাতিকে পথ দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক একটা ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে বহিবিশ্বে। পদ্মা সেতুর মত মেঘা প্রজেক্ট নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন শেখ হাসিনা। ১৯৭৩সালে ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পাকিস্তানের চেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে দারিদ্র। সেই শত্রু মুক্ত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *