তামাক সেবনে হৃদরোগ-স্ট্রোক-ক্যান্সারের ভয়াবহতাঃ কঠোর আইন জরুরী

অপরাধ জাতীয় সারাদেশ
শেয়ার করুন

এএইচএম ফিরোজ আলী:: তামাক মানব জাতির পরম শত্রু। সমাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিপক্ষ। তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারনে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য হুমকির সম্মূখীন। ধুঁমপানের ভয়াবহতায় ডুবে গেছে দেশ। ধুমপান শুধু মানুষের স্বাস্থ্যহানী ঘটায় না, মানুষকে নেশাগ্রস্থ বিবেকহীন, অমানুষ করে তুলে এবং পরিবেশেরও মারাত্নক ক্ষতি করে। তামাক চাষে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায় এবং খাদ্য নিরাপতত্তায় প্রভাব বিস্তার করে। তামাক সেবন, মাদকাসক্ত হওয়ার প্রথম ধাপ। তামাক করোনা ভাইরাসের চেয়েও ভয়ানক। করোনার কবল থেকে দেশ রক্ষা পেলেও তামাকের ছোবল দেশ জুড়ে। ধুঁমপান ও মাদকের সাথে অপরাধ অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। মাদক সেবন বাড়লে অপরাধও বাড়ে। তামাকের বহুবিধ ক্ষয়ক্ষতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০সালের মধ্যে ‘তামাক মুক্ত’ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গিকার ব্যক্ত করেছেন।
তামাক মানুষকে তিলে তিলে হত্যা করে। দেশের অর্থনীতির বড় এক বোঝা তামাক। ২০১৭-১৮অর্থ বছরে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হারানোর ক্ষতির পরিমান ছিল ৩০হাজার ৫৬০ কোটি টাকা এবং আয় ছিল, ২২হাজার ৮১০ কোটি টাকা। তামাক থেকে তৈরি বিড়ি, চুরট, সিগারেট, গুল-জর্দা, খৈনি, কিমাম, কাঁচাসাদা উৎপাদন ও বিক্রিতে কিছু এনজিও আমলাদের সহায়তায় বিক্রি বন্ধ হচ্ছে না। তামাক কোম্পানিগুলো এদেশের মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে তামাক পণ্যের বাজার প্রসারে প্রকাশ্যে কাজ করছেন। তামাক নিয়ন্ত্রন আইন থাকলেও কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। অথচ বিশে^র ১১৮টি দেশ তামাক ও তামাকজাত পন্য বিক্রি বন্ধ করেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২২সালে তামাক ব্যবহারের কারণে ৩০হাজার ৫৭০কোটি টাকা খরচ, ১লাখ ৬১হাজার লোকের মৃত্যু, ৪লাখ পঙ্গু এবং হৃদরোগ, ষ্ট্রোক,ব্রেইন ষ্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস সহ তামাক জনিত রোগে ১২লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছেন। ধুঁমপায়ীদের কারনে ৪২.৭শতাংশ লোক ধুঁমপান না করেও আক্রান্ত, গণ পরিবহনে প্রায় আড়াই কোটি লোক ধুঁমপানের শিকার হচ্ছেন। এক গবেষনায় বলা হয়েছে, তামাক সেবনকারী ৯৫শতাংশ লোক মাদকাসক্ত হয়। ধুঁমপায়ীদের সুরক্ষা দিতে থাইল্যান্ড, নেপাল, তুরষ্ক, মালেশিয়া, ও যুক্তরাজ্য সহ বিশে^র ৫৭টি দেশ ধুঁমপানমুক্ত আইন কার্যকর করেছে। কিন্তু আমাদের তথাকথিত কতিপয়ে অর্থনীতিবিদ ও আমলারা সরকারকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন, তামাক থেকে সরকার বেশি রাজস্ব পাচ্ছেন। তাই তামাক নিয়ন্ত্রনে কঠোর আইন হচ্ছে না, যতটুকু হচ্ছে তাও কার্যকর নয়। রাজস্ব আয়ের কারনে মানুষের জীবন বিপন্ন, পরিবেশ ধ্বংস, জমির উর্বরা শক্তি হ্রাস, সর্বোপরি নতুন প্রজন্মকে নেশাগ্রস্থ করে এমন রাজস্ব আয়ের প্রয়োজন আছে কি? তামাক সেবনের কারনে দেশের প্রতি ৪জনের ৩জনেই হৃদরোগে আক্রান্ত এবং স্ট্রোক-ব্রেইনস্ট্রোকের রোগীর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে মৃত্যুও হচ্ছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে রোগীদের স্থান সাংকুলান হচ্ছে না। বিশেষ করে হ্রদরোগ ও স্ট্রোকের রোগীর দেশে-বিদেশে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল বড় হচ্ছে। গবেষনা বলছে, যে হারে হৃদ রোগ ও স্ট্রোক বাড়ছে ২০২৩সালের মধ্যে বাংলাদেশ সহ বিশে^ ২৩মিলিয়ন লোক মারা যাবে।
বর্তমান সময়ে মানুষের মৃত্যুর কারন হচ্ছে, ধুঁমপান ও মাদকাসক্ত হওয়া। তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারনে প্রতি বছর দেশে প্রায় ১লাখ ২৫হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। বর্তমান সময়ে দেশে প্রায় ৩কোটি ৭৮লাখ লোক সরাসরি তামাক ব্যবহার করলেও আরও প্রায় ৪কোটি মানুষ ধুঁমপান না করেও আক্রান্ত। বৃটিশ পরিসংখ্যানবিদ, ডেবিল স্পাইগেল হলটার বলেছেন, বদঅভ্যাস আয়ু কমাতে সহায়তা করে। তিনি গবেষনা করে বলেছেন, ১৫-২৫সলা সিগারেট পান করলে ৫ঘন্টা আয়ু কমে । প্রতিটি সিগারেটের ধোঁয়ায় ৪হাজার রাসয়নিক পদার্থ থাকে যার মধ্যে ৫০টি ক্যান্সার সৃষ্টি করে। অপর গবেষনায় বলা হয় ধুঁমপায়ীদের ৯৮শতাংশ মাদকাসক্ত হয় এবং এর মধ্যে ৪৪শতাংশ ঘরে-বাইরে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়ায়। অনেক মাদকাসক্তের হাতে আামদের দেশে মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র খুন হওয়ায় ঘটনা ঘটছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন গবেষনা প্রতিষ্টানের মতে, বাংলাদেশে নিয়মিত তামাক সেবন করেন ৪কোটি লোক, এর মধ্যে ৩কোটি শুধু ধুঁমপায়ী এবং ১কোটি কাঁচা তামাকপাতা(সাদা), জর্দা, পান-সুপারির সাথে চিবিয়ে খান। গ্রামাঞ্চলে এদের সংখ্যা বেশি এবং অশিক্ষিত মেয়েরাই কাঁচা সাদা খায়। তামাক সেবিদের অধিকাংশ রোগাক্রান্ত লোক, দেশ-বিদেশে চিকিৎসা করতে গিয়ে সর্বস্বঃ হারিয়ে শেষ পরিণতি হয় মৃত্যু। মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, ইংল্যান্ড, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সুজারল্যান্ড, জার্মানীসহ ৫০টিরও বেশি দেশের শতাধিক ব্যান্ডের অবৈধ তামাক সেবনের বাজার বাংলাদেশ। সমুদ্র ও বিমান পথে নানা ব্যান্ডের সিগারেট দেশে আসে। অনেক প্রবাসী নিজের আত্নীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য উপহার সরূপ সিগারেট নিয়ে আসেন। এতে অনেকেই খুব বেশি খুশি হন। প্রতি বছর অবৈধ সিগারেটের বাণিজ্যের পরিমান ৯৫হাজার কোটি টাকা এবং সরকার রাজস্ব হারায় ২৪ কোটি টাকা। তামাক পণ্যের চোরাচালনের সাথে ভদ্রবেশি অনেক রাগববোয়ালও জড়িত। এয়ারপোটে লাগেজ কেটে সিগারেট চুরি হয় বেশি।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে তামাকের উপকারের কথা এ পর্যন্ত আবিস্কার হয়নি। কিন্তু তামাকের ক্ষতির বিশাল দিক বর্ণনা করা হয়েছে। একসময় তামাক ছিল, এদেশের অর্থকরী ফসল। দেশের সব জেলাতেই তামাক উৎপন্ন হতো। বেশি তামাক উৎপন্ন হয় রংপুর ও কুষ্টিয়া জেলায়। দেশের জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোর বড় বড় মার্কেটে প্রকাশ্যে টন টন করে সাদা বিক্রি হচ্ছে। অথচ এ ধরনের বিক্রি আইনত নিষিদ্ধ। পুইশাকের পাতার মত, সবুজ-শ্যামল ভয়ানক তামাকের পাতা থেকে ফুঁসফুসে ক্যান্সার, হৃদরোগ, যক্ষা, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, কফ, স্বরযন্ত্র শ্বাসনালী, খাদ্যনালী, দাঁত ও দাঁতের মাড়ি, মলদারে ক্যান্সার, হৃদরোগ, ব্রেইন স্ট্রোক, প্যারালাইসেস, আলসার, মহিলাদের গর্ভ নষ্ট, অসময়ে শিশু জন্ম, পুরুষের যৌনতা হ্রাস, চেহারা নষ্ট, মুখে ও শরীরে চরম গন্ধ,বিবেকহীন কর্মকান্ড, মানবতা-মানবিক গুনাবলি হ্রাস বা নষ্টের জন্য একমাত্র দায়ী তামাক। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক প্রভাবশালী চিকিৎসা সাময়িকি ল্যানসেটের এক গবেষনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তামাক ব্যবাহরে প্রতিবছর ক্ষতি হয় ৫২হাজার কোটি টাকা, আয় হয় মাত্র ২হাজার কোটি টাকা। কিন্তু রাষ্টের ক্ষতি হয় ৫০ হাজার কোটি টাকা। তাতে আরও বলা হয়, তামাক সেবন করে ৫০শতাংশ তরুন-তরুনী জীবনের ঝুঁকিতে থাকে এবং যারা ৭০-৭৫ বছর বাঁচার কথা, ধুঁমপানের কারণে তাদের জীবন থেকে ২২ বছর কমে যায়। গবেষনায় আরও বলা হয়, প্রতি বছর বাংলাদেশে ধুঁমপায়ীরা ৮হাজার কোটি টাকার সিগারেট পান করে ধোঁয়া বাতাসে উড়িয়ে দেয়।
লেখাটির সাথে গুরুত্ব থাকায় এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। গত ৪ জানুয়ারী আমার হৃদরোগের সমস্যা জনিত কারনে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ১৬নং ওয়ার্ডে(হৃদরোগের)ভতি হই। ওয়ার্ডটিতে ১০৬টি বেড থাকলেও ফ্লোর বারান্দাসহ মাটিতে প্রায় ২৫০জন রোগী ছিলেন। দেখা গেল, প্রতি ঘন্টায় ৪-৫জন করে রোগী ভর্তি হচ্ছেন। চোখের সামনে ২দিনে ১৮জন লোকের মৃত্যু নিজ চোখে দেখলাম। এটা যেন হৃদ রোগে আক্রান্ত রোগীরদের মৃত্যুর মিছিল। রোগীদের আত্নীয় স্বজনের হাঁক-চিৎকার ও কাঁন্নাকাটিতে হাসপাতালে এক করুন দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। তার পর আমাকে ঢাকা র্হাট ফাউন্ডেশনে প্রেরন করা হয়। সেখানে হার্ট-স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের ভীড় দেখে ভয়ে আমি ভীত হয়ে যাই। প্রতিদিন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শতশত আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছেন। সেখান থেকে অনেকেই চিকিৎসার জন্য বিদেশও যাচ্ছেন। হাসপাতালটি ২৪ ঘন্টা সন্তুযজনক সেবা দিচ্ছে। ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমি জীবনে ‘ধুঁমপান করিনি পান-সুপারি ও সাদা খাইনি’ তার পরও আমার হার্টঅ্যাটাক হল কেন? ডাক্তারের সোজা উত্তর, বাংলাদেশে আপনি একা বাস করেন না। ধুঁমপায়ীদের ধোঁয়ার কারনে হাজার হাজার অধুঁমপায়ী আক্রান্ত হচ্ছেন।
২০০৫সালে ধুঁমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রন আইন প্রণয়ন করা হলে ২০১৩সালে কিছুটা সংশোধন করা হয়। পাবলিক প্লেস বা খোলা জায়গার ধুঁমপান করলে ৫০ থেকে ২০০টাকা জরিমানার কথা শুনা গেলেও বাকিসব আইন কাগজে কলমে। সংশোধিত আইনে শিক্ষা প্রতিষ্টানের ১০০মিটার দূরে তামাকজাত দ্রব্যের দোকান, খোলা, খুচরা ও ভ্রাম্যমান তামাক বিক্রি নিষিদ্ধ। তামাক পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ই-সিগারেট বা বেপিংয়ের আমাদনি, উৎপাদন বিক্রি ইত্যাদি নিষিদ্ধ। সংশোধনী আইনে তামাকের পক্ষে ১হাজার ১০০জন এবং তামাকের বিপক্ষে মতামত দেন ১৬হাজার লোক। কতিপয় স্বার্থবাদী বিবেকহীন মানুষের কারনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তামাক ও মাদকের কারনে অকাল মৃত্যু হচ্ছে। দেশের সকল গনমাধ্যমে তামাকের সব ক্ষতিকর, সচিত্র অবস্থা তুলে ধরে ব্যাপক প্রচারনা চালাতে হবে এবং দেশে গনসচেনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধি, সেচ্ছাসেবী ও সমাজ সচেতন লোকদের অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে। সর্বাবস্থায় উন্নত রাষ্ট্র গঠনে জনস্বাথের কথা বিবেচনা করে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন,বিপনন ও সেবনের কঠোর আইনের কোন বিকল্প নেই।

লেখকঃ কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক

 


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *