জয়বায়ু পরিবর্তনঃ শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনুন্নত দেশগুলো

Uncategorized
শেয়ার করুন

এএইচএম ফিরোজ আলী:: এক সময় বাংলাদেশে ছিল, বাঁশ-বেত-ছন-মাটির তৈরি ঘর-বাড়ি। বন-জঙ্গল ছিল প্রচুর। প্রকৃতিতে ছিল মনোমুগ্ধকর হিমেল বাতাস। এখন কড়া রোদের তেজ। দিনভর তীর্ষক সূর্যের দহন। প্রচন্ড খর তাপে পুড়ছে সারা দেশ। রাতে ও দিনে দাবদাহে শরীর ঝলসানো ও ঘাম ঝরানো গরম। গ্রাম-শহরে একই অবস্থা। রাস্তা-ঘাট, গাছ তলায় কোথাও একটু ঠান্ডা বাতাস নেই। লোহা পুড়ানোর মত, গরমে নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর, পুকুর সব শুকিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে প্রচন্ড গরমে জন-জীবন বিপর্যস্ত। নলকুপে পানি আসছে না। প্রাণীকোল হাঁসফাঁস। প্রতিদিন ভোরে পূবাকাশে সূর্য ওঠার পর বুঝা যায়, সূর্য যেন মাথার উপরে। কৃষি ক্ষেতে কৃষক দিনে কাজ করতে পারছেন না। চুতরদিকে আগুন জ্বলছে। শিশু, বৃদ্ধ, কর্মজীবি, শ্রমজীবি লোকজন নানা রোগে আক্রান্ত। বর্জপাতে মানুষ মারা যাচ্ছেন। সব এখন উলট-পালট। দেশে সময় মতো বৃষ্টিপাত হয় না।
পৃথিবীতে যত বেশি উন্নয়ন, তত উষ্ণায়ন। ২০১৬ সালে শক্তিশালী এল নিনোর কবলে ছিল পৃথিবী। এ সময় এলনিনোর প্রভাবে আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরিও অঞ্চল এবং এশিয়া মহাদেশ দাবদাহে পুড়েছে। তখন বিশ্বের ছয় কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। এ বছর এল নিনোর প্রভাবে ভারত বাংলাদেশে কোন বৃষ্ঠিপাত হয়নি। গরমে ভারতের এক মহিলা পাকা রাস্তার উপর ডিম বাজি করে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ২০১৬সালে থাইল্যান্ডে ৬৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছিল। এল নিনো হ্েচ্ছ, বায়ুমন্ডলীয় ও গ্রীস্মমন্ডলীয় অঞ্চলের সমূদ্রগুলোর মাঝে একটি পর্যায়বৃত্তের পরিবর্তন। এল নিনোর প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দেখা দেয়। এলনিনো পর্যায়বৃত্তের উষ্ণ পর্যায়, লা নিনো হচ্ছে, শীত পর্যায়। পর্যায়বৃত্তের পরিবর্তনের নির্দিষ্ট কোন সময় নেই। তবে ৩ থেকে ৮ বছরের মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয়। এল নিনো বন্যা, খরা সহ অনান্য প্রাকৃতির দূর্যোগের সাথে সর্ম্পকযুক্ত। পৃথিবী নামের এই গ্রহটি মানুষের কর্মকান্ডের কারনে চরম ক্ষতির সম্মুখীন। বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ তাপ মাত্রার দেশ হলেও গত কয়েক দশকে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবহাওয়া ক্ষনে ক্ষনে বদলাচ্ছে। ছয় ঋতুর চরিত্র এখন একটাই গরম। দেশের মোট আয়তনের চার ভাগের এক ভাগ বন ভূমি থাকার কথা। কাগজে কলমে, বই পুস্তকে লেখায় ১২ ভাগ, প্রকৃত অর্থে আছে ৭/৮ভাগ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদাপন্ন দেশের তালিকায় অন্যতম বাংলাদেশ।
আর্ন্তজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিক্স ইনডেক্স এর তথ্যতে বলা হয়, জলবায়ুর পরিবর্তনের বিচারে শীর্ষ দশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথম অবস্থানে বাংলাদেশ। জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের জন্য দায়ী কার্বন। শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বনের কারনে অনুন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মাথা পিছু কার্বন উদগীরণের হার ১৭.৬২ মেক্টিক টন, রাশিয়ার ১২.৫৫ মেক্টিক টন, চীন ৬.৫২ মেক্টিক টন, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, সৌদিআরবসহ অনেক দেশ কার্বন ছড়াচ্ছে বেশি। অথচ বাংলাদেশের মাথাপিঁছু কার্বন উদগীরণের হার মাত্র ০.৩৭ মেক্টিক টন। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, ধনী দেশগুলোর ভোগবাদি মানসিকতা ও আচরনের নির্মম শিকার হচ্ছে, বাংলাদেশের মত দেশগুলো। বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০সালের মধ্যে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ১ থেকে দেড় ডিগ্রি বাড়বে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, ১৩ কোটি ৪০ লাখ লোক। এ সময় দেশের আর্থিক ক্ষতি হবে, ৪০ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা এবং মানুষের জীবন যাত্রার মান ৬.৮ শতাংশের নিচে নেমে যেতে পারে। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক বলেছে, ২০১১-২০৫০ সালের মধ্যে এ দেশের ৯৬ লাখ মানুষ জলবায়ু তাড়িত বাস্তবচ্যুতির শিকার হবে এবং দারিদ্রের হার ১৫ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। অপর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আবাদযোগ্য ভূমির ৩০ শতাংশ উপকূলীয় এলাকাতে হওয়ায় ২০৩০-২০৫০ সালের মধ্যে ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা ৩০-৫০ ডিগ্রি সেন্টিমিটার বাড়বে এবং ৩ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ কৃষি জমি সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। উপকূলের ৩ কোটি ৫ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুতির শিকার হবে। ইতিমধ্যে লবনাক্ততায় ৬০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, ২০৫০সালে হবে দেড় কোটি আক্রান্ত। উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতিমধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের কারনে ৩৫টি জেলার ২০৯টি উপজেলায় ৬৩ হাজার হেক্টর জমির ফসল একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। দেশের অর্থকরী ফসল পাট এখন উধাও। ভোলা জেলার আয়তন অনেক কমেছে।
বায়ুমন্ডলে বিরাজমান জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস, ওজোন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বনকে গ্রীন হাউজ বলা হয়। বায়ুমন্ডলের উপরিস্থিত স্তরের সর্বপ্রথম উপাদান হচ্ছে ওজোনস্তর। যা পৃথিবীকে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি বিকিরণ থেকে রক্ষা করে। ভূ-গর্ভস্ত জ্বালানী, দাবানল, মানুষ ও অন্যান্য জীব জন্তুর নিঃশ্বাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, পশু পালন, আবর্জনা, শোধণপ্রনালী, গ্যাস বিতরণ লাইনের ছিদ্র, শিল্প কারখানা, ইট ভাটার ধৌঁয়া ও যানবাহনের ব্যবহৃত জ্বালানী তেলের দহনে নাইট্রাস অক্সাইড, রেফ্রিজারেটর, শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র, এরোসেল ব্যবহারে ক্লোরোফ্লোরো অক্সাইড এবং দহন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মিথেন গ্যাসে ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বায়ুমন্ডলের অতিরিক্ত পরিমান কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের কারনে গত ১ শতকে গড়ে ১.৭৪ শতাংশ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালে ৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা রয়েছে। আইপিসিসির মতে, ২০১০০সালে ১.৮ ডিগ্রি থেকে সর্বোচ্চ ৪.২ ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়বে। আর্ন্তজাতিক জ্বালানী সংস্থা (আইইএ)বলেছে, ২০২১সালে কার্বন ডাই-অক্সাইড ৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। আমাদের দেশে এখন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্টান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মদরাসা, বাসা-বাড়ীতে এয়ারকন্ডিশন (এসি) ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং শীতকালেও শীত অনুভূত হচ্ছে না। গাছ-বাঁশ-বনজঙ্গলের সবুজ লাতাপাতা বাতাসের অক্সিজেন ছড়ায় এবং হাট্রোজেন গ্রহন করে এক সময় পাতা ঝড়ে পড়ে যায়। পুনরায় কচি পাতা জন্ম নিয়ে অক্সিজেন দেয় এবং বায়ুমন্ডল শীতল থাকে। কিন্তু আমদের দেশে বনজঙ্গল উজাড় হওয়ায় দিনদিন উষ্ণতা বা গরম বেড়েই চলছে।
১৯৬০সালে বঙ্গীয় এলাকায় ৪২.০৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রের্কড করা হয়। এ বছর ৩০ এপ্রিল সিলেটে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৬ ডিগ্রি। ১৯৭২ সালের ৩০ মে রাজশাহীতে তাপমাত্রা ছিল ৪৫.১ ও ২০১৬ সালে ছিল ৪১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১৯৯৫ সালে যশোরে ছিল ৪৩.২ ও ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল ছিল ৪২.২ ডিগ্রি। ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল সিলেটে ছিল ৪২.৬ এবং ঐদিন ঢাকায় ছিল ৪০.২। আবহাওয়াবিদদের মতে, তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮কে মৃদু তাপ প্রবাহ, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রিকে মাঝারী তাপদাহ এবং ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলে তীব্র তাপদাহ বলে বিবেচিত করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে বহুপ্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী বিপন্ন হচ্ছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ, বন্যা, খরা, জলোচ্ছাস, সাইক্লোন, বর্জপাত, হিটস্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট, কিডনী রোগ, মানসিক রোগ, পানিবাহিত রোগ, হৃদরোগ বা হার্ট এর্টাক, হাপানী, এলার্জী, ফুসফুসে ক্যান্সার, চামড়ার ক্যান্সার, চোঁখের ছানি রোগ, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়াসহ সংক্রমক ও অসংক্রমক রোগ বাড়ছে।
বাংলাদেশের ক্লাইমেট চেইঞ্জ প্লান ২০০৯-২০১৮ স্কীমের মাধ্যমে এ দেশে ঝড়, জলোচ্ছাস, সাইক্লোন, বজ্রপাতসহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় ইতিমধ্যে বিশ্বে প্রসংশা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চেয়ারপার্সন করে ১২ সদস্যের ডেল্টা গর্ভন্যান্স কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। এ কাউন্সিল জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শতবছরের মহাপরিকল্পনা ডেলটাপ্লান বাস্তবায়ন করছেন। এ কাউন্সিল জলবায়ু পরিবর্তনে ২০৩০সালের মধ্যে ২ হাজার ৯৭৮ বিলিয়নের ৮০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০ সেপ্টেম্বর নিউইর্য়কে জাতিসংঘের মহাসচিব ও ব্রিট্রিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে এক বৈঠকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির নিচে রাখতে প্যারিস চুক্তির কঠোর প্রয়োগের আহবান জানিয়ে, ৬ দফা পেশ করেন এবং উন্নত দেশগুলোর নিকট থেকে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার কর আদায়ের উপর জোরদেন। বাংলাদেশ রক্ষায় এখনই সচেতন হওয়ার সময়। আসুন জলবায়ু থেকে রক্ষায় “সচেতন হই, একটি গাছ কাটলে, দশটি গাছ লাগাই। দেশ ও দেশের মানুষকে বাচাঁই”।

লেখক: কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *