জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন কর্মচারীদের প্রমোশন আটকা নিয়োগবিধিতে

Uncategorized
শেয়ার করুন

এএইচএম ফিরোজ আলী:: আজ ১১ জুলাই (রবিবার) বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, “ অধিকার ও পছন্দই মূল কথাঃ প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার প্রাধান্য পেলে কাঙ্খিত জন্মহারে সমাধান মিলে”। প্রতি বছর ১১ জুলাই বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ গুরুত্বসহকারে দিবসটি পালন করে থাকে। ১৯৯০সালে প্রথমবারের মত, পৃথিবীর ৯০টি দেশ এই দিবসটি পালন করেছিল। এ বছর মহামারী করোনার কারনে হয়তো জাক-জমক পূর্ণভাবে দিবসটি পালিত হবে না। প্রত্যেকটি দেশ জনসংখ্যা দিবসে, নিজ নিজ দেশের জনসংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধি, দেশের উন্নয়নে জনসংখ্যার প্রভাব, জলবায়ু পরিবর্তন, মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু বৃদ্ধি, উন্নয়নের অগ্রগতি সহ নানা বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা এক সময় সম্পদ ছিল না। অতিরিক্ত জনসংখ্যা আপদ হিসেবে গণ্য করা হতো। ১৯৭৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৫ বছরে ক্রমাগতভাবে জনসংখ্যা হ্রাস এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারনে জাতিসংঘ এখন বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করছে। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নের সম্ভাবনাময় দেশ। তারপরও জনসংখ্যাকে পুরোপুরি সম্পদ বলা যাচ্ছে না।
আমাদের দেশে প্রতিদিন মানুষ বাড়ছে, কিন্তু আয়তন বাড়ছে না। সকল কৃষি জমিতে ঘর-বাড়ী তৈরি হচ্ছে। শহর-গ্রাম সর্বত্র এখন আবাসনের চেয়ে মানুষ বেশি। অনাচার-অত্যাচার-অবিচার, সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, কলহ-বিবাদ, চোরাচালানি, প্রতারনা, সন্ত্রাস, চাদাবাজি, খুন-খারাবি এখন নিত্য নৈমিত্রিক ব্যাপার। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর বসবাসের অযোগ্য। বায়ু দূষণ, মাটি দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, বনজঙ্গল উজাড়, খাল-বিল, নদ-নদী ভরাট, পাহাড় পর্বত সবকিছুই মানুষ ধ্বংস করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একমাত্র মানুষই দায়ী। ষড়ঋতুর দেশ এখন গ্রীষ্মঋতুতে পরিনত হয়েছে। ১৮৬০ সালে পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২ কোটি, ১৯৭১ সালে ছিল ৭ কোটি, বর্তমানে ২০২০ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরোর তথ্যমতে ১৬ কোটি ৮২লক্ষ। এরমধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৪২ লক্ষ, নারী ৮ কোটি ৪০ লক্ষ। জন্ম থেকে মৃত্যু কম হওয়ায় জনসংখ্যা বাড়ছে। সফলভাবে টিকাদান কর্মসূচী বাস্তবায়ন হওয়ায় মাতৃ মৃত্যু ও শিশু মৃত্যু অকল্পনীয় ভাবে হ্রাস পেয়েছে। সংক্রমক ও অসংক্রমক রোগে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ লোক মারা যাচ্ছেন। বাল্য বিবাহ বন্ধ, বিরতির পর সন্তান জন্ম দানের সাফল্য এখন বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন কার্যক্রমের জন্য একটি নন্দিত দেশের নাম বাংলাদেশ। প্রতিবছর গড়ে ২৫লক্ষ শিশুর জন্ম হলে মৃত্যু হচ্ছে মাত্র ৬ লক্ষ লোকের। এই হিসাবে ১৯ লক্ষ লোক প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭৫ সালের মহিলা প্রতি গড় সন্তান বা মোট প্রজনন হার (টিএফআর) ৬.৩, ১৯৮৯সালে ৫.১, ১৯৯১সালে ৪.৩, ১৯৯৩সালে ৩.৪, ১৯৯৭সালে ৩.৩, ২০০২সালে ৩.৩, ২০০১ সালে ৩.২, ২০০৪ সালে ৩., ২০০৭সালে ২.৭, ২০১০সালে ২.৫, ২০১১সালে ২.৩ এবং বর্তমানে ১.৩ এ নেমেছে। তবে প্রতিবর্গ কিলোমিটারে বসবাস করছেন ১৪০জন। এর আগের বছর ছিল ১২৫জন।
১৯৭৫সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের কৃষি জমি বাঁচাতে এক বেতার ভাষনে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে জোরালো নিদের্শনা প্রদান করেন। এ নিদের্শনার পর ১৯৭৬সাল থেকে মাঠ পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা কর্মী নিয়োগ শুরু হয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে সাবেক তিনটি ওয়ার্ডে দুইজন করে ছয়জন মহিলা কর্মী এবং প্রতি ইউনিয়নে একজন করে পুরুষ কর্মী প্রচারের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। থানা পর্যায়ে তাদের কাজ তদারকি করার জন্য একজন কর্মকর্তা ও একজন কেরানী নিয়োগ হয়েছিল। ১৯৮৯সাল থেকে প্রত্যেক দম্পতির জীবনবৃত্তান্ত লিখিতভাবে লিপিবদ্ধের জন্য রেজিষ্টার কার্যক্রম শুরু করা হয়। থানা কর্মকর্তা ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মচারীদের প্রচার-প্রচারনায় তখন সহযোগিতা করতেন এবং কেরানীরা অফিসারদের ভ্রমন বিল তৈরি ও মাঠ কর্মচারীদের রির্পোট সংযুক্ত করতেন। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতাধীন মাঠ পর্যায়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের মূল ফাউন্ডেশন পরিবার কল্যাণ সহকারি (এফডব্লিউএ) এবং পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক (এফপিআই)গণের নিয়োগবিধি না থাকায় একই পদে সারা জীবন চাকুরী করে পদোন্নতি ছাড়া পেনশনে যাচ্ছেন। এফডব্লিউএ গণ তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও ১৭তম গ্রেডে অর্থাৎ চতুর্থ শ্রেণীর বেতন দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, রহস্যজনক অজুহাতে এসব কর্মচারীদের পেনশনের সময় ২০% টাকা কর্তন করে রাখা হচ্ছে। জীবনে কেউ কোনদিন এ টাকা ফেরত পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী শুরুর প্রথম দিকে সারা দেশে ছিল ৫৫ হাজার কর্মচারী। ১৯৯৮ সালে ছিলেন ৪৪হাজার, বর্তমানে প্রায় সাড়ে ২৯ হাজার এফপিআই এবং এফডব্লিউএ কর্মচারী রয়েছেন। এসব কর্মচারীরা জীবনের ঝুকি নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে জনবিস্ফোরন থেকে রক্ষা করতে গিয়ে অনেক লাঞ্চিত ও অপমানিত হয়েছেন, অনেকেই না খেয়েও মারা গেছেন। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিরামহীন কর্মের কারনে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন সফলভাবে বাস্তবায়িত না হলে, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা হয়ে যেত ২০-২৫ কোটি।
বাঙালি নোবেল বিজয়ী অমর্ত্যসেন বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের সাফল্যের প্রশংসা করছেন। পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকায় বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে মর্মে উল্লেখ করে পাকিস্তানকে বাংলাদেশের পথ অনুসরণের অনুরোধ করেছে। ১৯৯৮ ও ২০১৫ সালে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে ২টি নিয়োগবিধি হলেও এফপিআই ও এফডব্লিউএদের নিয়োগবিধি না হওয়ায় পদোন্নতি ও গ্রেড পরিবর্তন আটকে আছে। এতে কর্মচারীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে হতাশা, ক্ষোভ ও চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীদের সাথে বেতন বৈষম্য দূর হচ্ছে না। কেরানীদের প্রথমে সহকারী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং বর্তমানে ১৪৭জনকে পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এফপিআই ও এফডব্লিউএদের প্রমোশন বা গ্রেড পরিবর্তন করা হচ্ছে না। এফপিআই ও এফডব্লিউএদের সংগঠন বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা মাঠ কর্মচারী সমিতি ২০১৯সালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিশাল মানববন্ধনের মাধ্যমে এফপিআই ১১তম ও এফডব্লিউএদের ১২তম গ্রেড, পেনশনের ২০% কর্তন বাতিল এবং দ্রুত নিয়োগবিধি বাস্তবায়ন করে প্রমোশনের দাবী করলেও এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি। সিলেট জেলা মাঠ কর্মচারী সমিতির নেতৃবৃন্দ মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রীর সাথে স্বাক্ষাৎ করে তাদের দাবী সম্বলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করলে মন্ত্রী উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে বিষয়গুলো বিবেচনার সুপারিশ করলেও লাল ফিতায় আটকে আছে দাবীগুলো। এখন কর্মচারীরা একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাথারবাড়ি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে কর্মরত এফডব্লিউএ সুলতানা বেগমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, ১৯৯২ সালে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে চাকুরীতে যোগদান করেছেন। বেতন পাচ্ছেন, ১৭তম গ্রেডে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে। ২০০৫সালে সিএসবিএ প্রশিক্ষণ নিয়ে এ কেন্দ্রে ডেলিভারী কার্যকর্ম শুরু করেন। চলতি বছর জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত ৫২২জন মহিলার নরমাল ডেলিভারী করে জেলার শ্রেষ্ট কর্মী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এভাবে প্রায় সারা দেশে সাড়ে ৩হাজার এফডব্লিউএ গণ নরমাল ডেলিভারী করছেন। করোনাকালিন সময়েও বিরামহীন ভাবে কর্মীদের কাজ থেমে থাকেনি। অনেকেই ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকেই আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। সুলতানা আক্তার আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের কার্যক্রম বিশ্বে নন্দিত ও প্রশংসিত হলেও সরকারিভাবে আমাদেরকে উপযুর্ক্ত মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। আমাদের নিয়োগবিধি বাস্তবায়ন করে প্রমোশন, গ্রেড পরিবর্তন ও পেনশনের ২০% কর্তন বাতিল এটা আমাদের নায্যদাবী। তিনি সকল এফপিআই ও এফডব্লিউএ দের সচেতন হওয়ার অনুরোধ করেন। সিলেট জেলা মাঠ কর্মচারী সমিতির সভাপতি রাশেদা খানম রিনা বলেন, আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। ইজ্জত বাঁচাতে হলে আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। এ বিভাগের সকল স্তরের কর্মচারীদের প্রমোশন, গ্রেড পরিবর্তন হলেও আমাদেরকে কেন বঞ্চিত করা হচ্ছে? তা আজও জানতে পারিনি।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *