কুরবানীর ঐতিহাসিক পটভুমি ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কোরবানী

Uncategorized
শেয়ার করুন

‘কুরবান, আরবি শব্দ। ফার্সি বা উর্দূতে বলে, ‘কুরবানী,। আরবি কুনবান, কুরবত, কিরবান অর্থ ত্যাগ, নৈকট্য, উৎসর্গ। কোরআন মজিদে আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে ঘোষনা করেছেন যে, আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারন করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ’তো একমাত্র আল্লাহ। সুতরাং তাঁর আওতাধীন থাকো। কুরবানীর গোশত বা মাংস আল্লাহর কাছে পৌছে না । পৌছে আল্লাহর কাছে মনের তাকওয়া (সুরা- হজ্জ আয়াত ৩৪ ও ৩৭ এর অংশ বিশেষ)। কুরবানীর উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহর প্রেম অর্জনের মাধ্যমে ধর্ম নিষ্টা ও তাকওয়া অর্জন করা । স্রষ্টার নৈকট্য অর্জনের লক্ষ্যে জিলহজ্ব মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে শরিয়তের আদেশ মোতাবেক কোরবানীর যোগ্য পশু যবেহ করে আনন্দ- খুশি করাকে ঈদুল আযহা বলে।
৮৬ বছর বয়সে হযরত ইব্রাহীম (আ:) মোরাকাবায় বসে একদিন আল্লাহর দরবারে পুত্র সন্তান চাইলেন। আল্লাহ তাঁকে পুত্র সন্তান দান করলেন। হযরত ইসমাইল (আ:) এর বয়স যখন ১৩ বছর হল, তখন হযরত ইব্রাহীম (আ:)কে স্বপ্নে হুকুম দেয়া হল যে, তুমি তোমার কলিজার টুকরা ইসমাইলকে আল্লাহর রাহে কুরবানী কর। এভাবে তিনি ৩ বার স্বপ্ন দেখলেন। জিলহজ্ব মাসের অষ্টম রাতে তিনি সর্ব প্রথম স্বপ্ন দেখলেন যে, একমাত্র পুত্রকে তিনি নিজ হাতে যবেহ করছেন। অতপর নবম রাতেও তিনি আবার ঐ স্বপ্ন দেখেন। ঐদিন তিনি জানতে ও বুঝতে পারেন যে, এটা স্বপ্ন। তারপর দশম রাত্রে তিনি আবার স্বপ্ন দেখেন পুত্রকে কুরবানী করতে উদ্যত হয়েছেন। স্বপ্নের এই তিনটি দিনকে বিশেষ নামে বিশেষিত করা হয়েছে। জিলহজ্ব মাসের অষ্টম দিনের নাম, ইয়াওমুত তারভিয়াহ বা চিন্তা ভাবনার দিন। নবম দিনের নাম ইয়াওমুল আরাফাহ বা জানার দিন এবং দশম দিনের নাম ইয়াওমুল নাহার বা কুরবানীর দিন। হযরত ইব্রাহীম (আ:) পুত্র ইসমাইলকে কুরবানীর জন্য প্রস্তুত করলেন এবং স্বীয় বিবি হাজেরাকে বললেন, ছেলেটাকে হাত মুখ ধুইয়ে কাপড় পড়িয়ে দাও। পুত্রকে একটি কাজে নিয়ে যাব। পিতা পুত্র যখন ঘর থেকে বের হলেন তখন শয়তান বিবি হাজেরার নিকট গিয়ে বলল, তোমার পুত্রকে ইব্রাহীম যবেহ করতে নিয়ে যাচ্ছেন। বিবি হাজেরা বললেন আল্লাহর হুকুম পালন করতে তিনি ভাল কাজ করছেন। শয়তান নিরাশ হয়ে পিতা পুত্রের পিছনে ছুটতে লাগলো এবং শেষ পর্যন্ত পরাস্ত হলো। মিনায় পৌছে ইব্রাহীম (আ:) পুত্রকে মনের কথা জানালে ইসমাইল পিতাকে বললেন, আল্লাহ আপনাকে যা হুকুম দিয়েছেন, আপনি তাই করুন। এ ব্যাপারে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন (সুরা-সা ফ্ফাত-১০২)। পিতা পুত্র একমত হওয়ার পর দু’জনই আল্লাহর কাছে নিজেদের সপে দিলেন। ইসমাইল (আ:) পিতাকে বললেন, আপনি আমাকে চোখে দেখাবস্থায় যবেহ করতে পারবেন না। ছেলের মায়া দেখলে ছুরি নাও চলতে পারে। আমি ছটফট করলে আপনার কাজের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাই আমার হাত থেকে ঘাড় পর্যন্ত বেঁধে দিন এবং আপনার কাপড়টা সামলে নিন যাতে আমার রক্ত আপনার শরীরে না লাগে। আমার মাকে সালাম দিবেন এবং আমার জামাটাও মায়ের কাছে দিবেন। হযরত ইব্রাহীম (আ:) ছেলের এমন কথা শুনে চুমু খেয়ে ছলছল চোখে পুত্রকে বাঁধলেন।
মক্কা শহরের মিনার ঐতিহাসিক মরু প্রান্তরে পিতার হাতে ১৩ বছরের এক শিশু পুত্রের যবেহ করার অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে আকাশ যেন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। আদম সৃষ্টির সময় প্রবল আপত্তিকারী ফেরেস্তাগন যেন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। চতুর দিকে পিন পতন নিরবতা। গাছ পালা নড়ছেনা, পশুপাখি চলা ফেরা করছেনা। বাতাসের গতি স্তব্দ। হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর ছুরি অনবরত পুত্রের গলায় চলছে। কিন্তু যবেহ হচ্ছেনা। অবশেষে মহান আল্লাহ’র কৃপায় জান্নাত থেকে জিব্রাইল (আ:) এর মাধ্যমে একটি দুম্বা পাঠিয়ে ইসমাইলকে বাঁচিয়ে দুম্বা যবাই করলেন। ইব্রাহীম যখন পুত্র ইসমাইলকে যবেহ করছিলেন, তখন জিব্রাইল বলেছিলেন, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ইসমাইল বলেছিলেন, লা’ইলাহা ইল্লালাহু আল্লাহু আকবার। অতপর ইব্রাহীম (আ:) বললেন আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ। এর পর থেকে এই তকবীরটি চিরস্থায়ী সুন্নতে পরিনত হয়। জন্ম দিন থেকে জীবনের ৯৯ টি বছর ধরে একটার পর একটা পরীক্ষা দিয়ে আল্লাহ তা’য়ালা যখন তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, তখন হযরত ইব্রাহীম (আ:) কে ‘খলিলুল্লাহ, উপাধীতে ভুষিত করলেন। তাঁর মহান ত্যাগের স্মৃতি বহন করে আজও মুসলিম জাতি সুন্নতে ইব্রাহীম হিসেবে কুরবানী করে থাকেন। সুরা বাকারা, আল ইমরান, মায়েদা আনআম, হজ্জ, কাওসার প্রভৃতি সুরায় কুরবানীর বিবরণ পাওয়া যায়। সুরা সাফফাতে ইব্রাহীম (আ:) এর কাহিনী বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন,‘সুন্নাতা আবিকুম ইব্রাহীম, অর্থাৎ এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহীম (আ:) আদর্শ (মেশকাত)। হিজরতের পর কুরবানীর বিধান চালুর পর হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৯ বছর জীবিত ছিলেন এবং তিনি প্রতিবার কুরবানী করেছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন কুরবানীর দিন আদম সন্তান যত আমল করে তাঁর মধ্যে আল্লাহর দরবারে সব চেয়ে প্রিয় হলো কুরবানী করা। সুতরাং তোমরা কুরবানী করে চিত্তের প্রফুল্লতা অর্জন কর। অবহেলা বা অভাবের কারনে যেন কুরবানী বাঁধাগ্রস্থ না হয়। এজন্য প্রিয় নবী (সা.) এর কঠোর বাণী হচ্ছে, ‘সামর্থ থাকা সত্তেও যে কুরবানী না করে, সে যেন, আমার ঈদগাহে না আসে। সামান্য অভাবের সময় ধার দেনা-করে হলেও কুরবানী করা উচিৎ। এক হাদিসে আছে হযরত আয়েশা (রা.) রাসুল (সা.)কে জিজ্ঞাস করলেন,‘আমি কি কর্জ করেও কুরবানী দিব, জবাবে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন হাঁ, কারন এ দেনা শোধ করা হবেই। নামাজ রোজার ন্যায় কুরবানী করার আদেশ পূর্ববতী নবীগনের উম্মতদেরকে দেয়া হয়েছিল। পৃথিবীর প্রথম মানব আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ:) থেকে কুরবানী প্রথা চালু এবং কিয়ামত পর্যন্ত নামাজ রোজার ন্যায় হজ্বও কুরবানীর প্রচলন অব্যাহত থাকবে এটা স্বত:সিদ্ধ।
আমাদের দেশে কুরবানীর ঈদের পরিচয় ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ নামে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কুরবানীর ঈদ বা ঈদুল আযহার ভিন্ন নাম রয়েছে। মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মিসর, কুরবানীর ঈদকে বলা হয় ঈদুল ‘কিবির,। আফ্রিকার অনেক দেশে তাবাসকি বা তোবাসকি নামে পরিচিত। নাইজেরিয়া এবং পূর্ব আফ্রিকায় বলা হয় রাব্বার সালদ, সুমালিয়া কেনিয়া ইথিওপিয়ায় বলা হয় এসিডওয়েনি, ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ঈদুল আযহাকে বলে বকরি ঈদ। এসব দেশে বেশি ছাগল কুরবানী দেয়া হয়। তুরস্কে বলা হয় কোরআন বা বেরামি বা ত্যাগের উৎস। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা আলবেনীয়া এবং বুলগেরিয়ায় বলা হয় কুরবান বা বাজরাম। ইন্দোনেশিয়ায় ঈদুল আযহা বললেও মালেশিয়ায় বলে আইদিল আদহা।
১৩৬ কোটি জনসংখ্যার দেশ চিনে মোট জনসংখ্যার শতকরা ১২ ভাগে সাড়ে ১৬ কোটি মুসলমান রয়েছেন। হুই, ইউঘুর, কাজাক, উজবেক, তাতিক, তাতার, খালঘাস, সালার, ডংমিয়াং ও বায়নার মুসলমানরা সংখ্যা লগু গোষ্টিতে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন এলাকায় বাস করেন। চাঁন্দ্র বছরের পঞ্জিকা দেখে তাঁরা ঈদ উদ্যাপন করেন। নিংঝিয়া প্রদেশের হুই মুসলমানরা ঈদুল ফিতকে বড় ঈদ মনে করে। তারা নারী-পুরুষ একত্রে মিলে নতুন জামা কাপড় পরিধান করে। ঈদের নামাজের আগে মসজিদে সাইরেন বা ঘন্টা বাজানো হয়। কুরবানীর ঈদে কয়েক জন মিলে পশু কুরবানী করেন। অষ্টেলিয়ায় ঈদুল আযহার দিন সরকারী ছুটি থাকেনা। সাবাবান শহরকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা বসবাস শুরু করেন। এখানে পশু কিনে লালন-পালনের সুযোগ না থাকায় কয়েটি পরিবার মিলে পশু কেনা ও যতœ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। মুসলমানরা মসজিদে নামাজ শেষে কুরবানী করেন এবং কুরবানীর গোশত মুসলমান ছাড়াও অন্য ধর্মালম্বিদের গোশত ও চামড়া বিক্রির টাকা দান করেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ৮০ হাজারের মত বাংলাদেশি বাস করেন। যাদের মধ্যে বেশির ভাগ মুসলমান। ঈদুল আযহার বড় জামাত হয় জ্যামাইকায়। এখানে প্রায় ১৫ হাজার নারী-পুরুষ ঈদের জামাতে অংশ গ্রহণ করেন। আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া। সেখানে রোযার ঈদকে খুব আনন্দের সহিত পালন কররেলও কোন রকম পালন করা হয় কুরবানীর ঈদ। সাধারণত যারা হজ্ব করেছে তারাই কুরবানী দেয় এবং শুধু তাদের উপর নাকি কুরবানী দেয়া ফরজ। সেখানে এলাকায় যতগুলো ঘর থাকে গোশতের ততটি ভাগ করা হয়। সেখানে ধনীরা গোশত রাখে না তারা গরিবকে দেয়ার জন্য ফিরিয়ে দেয়। জার্মানিতে প্রায় ৪৩ লাখ মুসলমান রয়েছেন। এদের মধ্যে ১৯ লাখ জার্মান নাগরিক। আর মুসলমাদের ৬৩টি ভাগ তুর্কি বংশোদভুত। এখানে ঈদের কোন ছুটি থাকেনা। মুসলমানরা ধর্মীয় উৎসবের ছুটি ঘোষনার দাবি করে আসছেন। দক্ষিন আফ্রিকার মুসলমানরা পবিত্র ঈদুল ফিতর পালন করেন। দেশটির রাজধানীতে ঈদের জামাতে লাখো মুসল্লির ঢল নামে। নামাজের শেষে তারা কুরবানী দেন। ধনী গরিব মালিক শ্রমিক সবাই একে অপরকে দাওয়াত দিতে ঈদের দিন ব্যস্ত থাকেন। সুইডেনে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় মসজিদে ঈদের বড় জামাত অনুষ্টিত হয়। এতে অনেক প্রবাসি অংশ গ্রহন করেন। মালেশিয়ায় ভেড়াই কুরবানীর প্রধান পশু। তবে গরু ও ছাগল কুরবানী দেয়া হয়। স্থানীয় মসজিদে এক সঙ্গে পশু যবাই করে বন্টনকরা হয়। আরব দেশ গুলোতে উট, গরু ভেড়া, দুম্বা কুরবানী দেয়া হয়। সৌদি আরবে খুব বেশি পশু কুরবানী দেয়া হয়। তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্থানের মত এশিয়ার অনেক দেশে ভেড়া কুরবানী দেয়া হয়। ফিনল্যান্ড জুড়ে মুসলমানগণ ত্যাগের মহিমায় ঈদুল আযহা উদযাপন করেন। রাজধানীর হেলসিঙ্কিতে অনুষ্টিত হয় ঈদের জামাত। যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩০ লাখ মুসলমান রয়েছেন। সেখানে মোট জনসংখ্যার ৫ভাগ হচ্ছেন মুসলমান। দুই ঈদে মুসলমানরা ট্রাফাল স্কয়ারে মিলিত হন। যুক্তরাজ্যে প্রকাশ্যে পশু কুরবানী দেয়া যায়না। ঈদের দু’মাস আগ থেকে গ্রোসারী দোকানে নাম লিখে টাকা পরিশোধ করে আসতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গরুর বা ভেড়ার গোশত দোকানীরা ঈদের পরের দিন সরবরাহ করেন। ফলে অধিকাংশ প্রবাসিরা নিজ দেশের বাড়িতে কুরবানী করে থাকেন (বাংলাদেশিরা)।

এ এইচ এম ফিরোজ আলী
লেখক, কলামিষ্ট ও সমাজ বিশ্লেষক


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *