কারারক্ষীর হাতে রোহিঙ্গা বন্দির করুণ মৃত্যু

অপরাধ সারাদেশ
শেয়ার করুন

ডাক ডক্স : কক্সবাজার জেলা কারাগারে এক রোহিঙ্গা বন্দিকে পিটিয়ে হত্যার চাঞ্চল্যকর অভিযোগ পাওয়া গেছে। গভীর রাতে  দুই রোহিঙ্গার মধ্যে মারামারিকে কেন্দ্র করে পরদিন এক হাজার টাকার জন্য বিচারের নামে সুবেদার শাহাদাত হাত-পা বেঁধে দুই বন্দিকে নির্মমভাবে পেটান। এ সময় লাঠির আঘাত অণ্ডকোষে লেগে ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ওই রোহিঙ্গা বন্দি। তার নাম মোহাম্মদ জাফর (৪০) ।

ঘটনাটি ঘটে ৪ আগস্ট বিকালে। ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে জেল সুপার চেস্ট পেইনে আক্রান্তের কথা বললেও জেলারের আদেশ বইয়ে লেখা তথ্য মৃত্যুর প্রকৃত কারণ ফাঁস করে দিয়েছে।

এ ঘটনায় রফিক ছালাম নামে অপর বন্দি কারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পায়ে প্রচণ্ড ব্যথার কারণে তিনি হাঁটতে পারছেন না। ঘটনার পর বিভাগীয় মামলা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে জেল সুপারের আবেদনসহ এ সংক্রান্ত নথিপত্র এবং জামিনে আসা কয়েকজন বন্দির সঙ্গে কথা বলে নির্যাতনের ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে।

কারা সূত্র জানায়, কারাভ্যন্তরে এমন অমানবিক ও বর্বর ঘটনা আড়াল করতে সুকৌশলে জেল সুপার মো. শাহ আলম খান চেস্ট পেইনে (বুকে ব্যথা) হঠাৎ অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে হত্যার ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করেন। ঘটনার সাত দিন পর কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ১০ আগস্ট কারাভ্যন্তরে গিয়ে বন্দিদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। কিন্তু হত্যার ঘটনা আড়াল করতে আহত রফিক ছালামকে জেলা প্রশাসকের সামনে আনা হয়নি।

জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো বন্দিকে শারীরিক আঘাত করার নিয়ম থাকার প্রশ্নই আসে না। কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে ওই বন্দির বুকে ব্যথার কথা জনিয়েছেন। তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে সেভাবেই পোস্ট মর্টেম করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আশা করি, ময়নাতদন্তের মাধ্যমে তার মৃত্যুর প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে।

ঘটনার বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা জানতে চাইলে সিনিয়র আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, এ ঘটনা সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘন। আলোচ্য বন্দিকে যদি লাঠি দিয়ে পেটানো হয়, তাহলে এটা বিভাগীয় মামলা নয়, ফৌজদারি মামলা হতে হবে। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে চেস্ট পেইন বলার কোনো সুযোগ নেই। যারা প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করেছেন, তাদেরও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।

বিভ্রান্তিকর তথ্য নথিপত্রে : ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে জেল সুপার শাহ আলম খানের স্বাক্ষরিত আবেদনে বলা হয়, ‘কারাবন্দি মোহাম্মদ জাফর ৪ আগস্ট ৪টা ৪৬ মিনিটে এইচ/ও চেস্ট পেইন রোগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারা হাসপাতালের চিকিৎসকের পরামর্শে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পাঠানো হয়। সেখানে বিকাল ৫টা ৫ মিনিটে ভর্তিপূর্বক তাকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে জানানো যাচ্ছে যে, কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে বন্দিকে মৃত ঘোষণা করেন।’

কারাগারের জেলারের নিয়ন্ত্রিত আদেশ বইয়ে এ ঘটনায় তিন কারারক্ষীর বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়। তারা হলেন কারারক্ষী আল মামুন, আহম্মদ উল্লাহ ও আব্দুল জলিল। ঘটনার দিন রাতে এই তিন কারারক্ষীর বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে জেলার শওকত হোসেন মিয়া আদেশ বইয়ে পৃথক অভিযোগনামায় উল্লেখ করেন, ‘তাদের গোয়েন্দা কারারক্ষী/প্রধান কারারক্ষী হিসাবে দায়িত্ব নির্ধারিত ছিল।

৩ আগস্ট রাত ৪টা ৩০ মিনিটে কর্ণফুলী ২নং ওয়ার্ডে হাজতি নং ১২০৬/২১ মোহাম্মদ জাফর এবং হাজতি নং ৭৪০/২৩ রফিক ছালাম কম্বল গায়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে দুজন মারামারি করে। বিষয়টি কর্তব্যরত রক্ষী নং ২২১৮৩ মো. শাহাদাত হোসেন বিচারের জন্য উপস্থাপন না করে বন্দিদের হিস্ট্রি টিকিট নিজের কাছে রেখে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে ৪ আগস্ট দুপুর ১২টায় কারাভ্যন্তরে ডিউটিতে গিয়ে কারারক্ষী শাহাদাত হোসেন ও ইনচার্জ কারারক্ষী আব্দুল জলিল তাদেরকে (হাজতি জাফর ও রফিক ছালাম) কর্ণফুলী ও বাকখালী ভবনের নিচতলার মধ্যবর্তী করিডরে মারধর করে।’

আদেশে বলা হয়, ‘কারা অভ্যন্তরে তাদের গোয়েন্দা নজরদারির দায়িত্ব ছিল। দুজন বন্দি মারামারি করার ঘটনাটি যথাসময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা তদের দয়িত্ব ছিল। কিন্তু তারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। যথাসময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি অবহিত করলে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটত না। তাই দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে তাদেরকে অভিযুক্ত করা হলো।’

অন্যদিকে মারামারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই কারারক্ষীসহ তিনজনকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। তাদের মধ্যে শাহাদাত হোসেনকে লক্ষ্মীপুর জেলা কারাগারে, সেলিম উদ্দিনকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং আব্দুল জলিলকে নোয়াখালী জেলা করাগারে পাঠানো হয়।

অণ্ডকোষে আঘাতে মৃত্যু : রোহিঙ্গা বন্দি জাফর অণ্ডকোষে লাঠির আঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যাওয়ার প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে বের হয়ে একাধিক বন্দি যুগান্তরকে বলেছেন, কারারক্ষী শাহাদাত হোসেনের লাঠির আঘাতেই রোহিঙ্গা হাজতি জাফর ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তার হাত-পা বেঁধে পায়ের নিচে ধারাবাহিক আঘাতের সময় একটি লাঠির বাড়ি তার অণ্ডকোষে লাগে। এরপর চিৎকার করতে করতে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর আর তার জ্ঞান ফেরেনি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারাগারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা একজন কারারক্ষী বলেন, ঘটনার সময় জেল সুপার শাহ আলম খান ফুটবল খেলতে গিয়েছিলেন। জেলখানায় ফিরে আসার পর জাফরকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, তার মৃত্যুর বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে ঘটনার বিচার চেয়ে কক্সবাজার জেলা কারাগারের সব বন্দি খাদ্য গ্রহণ না করে অনশন শুরু করেন। রাত ৯টার দিকে জেল সুপার শাহ আলম খান এবং জেলার শওকত হোসেন কারারক্ষীদের নিয়ে বন্দিদের সামনে কান্নাকাটি করে ক্ষমা চান।

পরের দিন চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক আলতাব হোসেন কক্সবাজার জেলা কারাগার পরিদর্শনে যান। এরপরই তিন কারারক্ষীকে নিজ দপ্তরে ক্লোজ করা হয়। কিন্তু হত্যা মামলা না হয়ে এ ঘটনায় কক্সবাজার সদর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়।

এ বিষয়ে উপমহাপরিদর্শক আলতাব হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। গত রাতে বারবার তার সরকারি মোবাইল ফোনে কল করা হয়। কিন্তু তিনি প্রতিবারই লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে খুদে বার্তা পাঠিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়। তারপরও এই বিভাগীয় কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। স্ত্রী হত্যার দায়ে চার সন্তানের জনক জাফর ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর থেকে কক্সবাজার কারাগারের হাজতি ছিলেন। তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটি সংশ্লিষ্ট জেলার আদালতে বিচারাধীন ছিল।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *